প্রতিবন্ধী নারীর অধিকার ও সামাজিক বৈষম্য


হীরেন পণ্ডিত: আমাদের সমাজে নারীরা কিছুটা হলেও অবহেলিত, তাহলে আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী নারীরা আরও বেশি মাত্রায় অবহেলিত। প্রথম হলো সে নারী, আর দ্বিতীয় হলো সে প্রতিবন্ধী নারী, তাকে যুদ্ধ করতে হয় নারী হওয়ার জন্য, আবার যুদ্ধ করতে হয় মানুষ হওয়ার জন্য। বিয়ে যেকোনো সমাজের একটি সাধারণ সামাজিক রীতি।

অভিভাবক নির্ধারিত বিয়ে এখনও বাংলাদেশের সমাজে একটি প্রচলিত নীতি বা নিয়ম। কিন্তু প্রতিবন্ধী নারী ও কিশোরীদের ক্ষেত্রে এ অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। এক্ষেত্রে কিশোরী প্রতিবন্ধীদের বিয়ের হার মাত্র ২ শতাংশ। প্রতিবন্ধী নারী ও তার পরিবারের হতাশার অন্যতম কারণ হচ্ছে, মানুষ একজন প্রতিবন্ধী নারীকে বিয়ে করতে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করে না। আজও একটি প্রচলিত কুসংস্কার হচ্ছে, পরিবারে প্রতিবন্ধী সদস্যের উপস্থিতি সম্পূর্ণ পরিবারের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। মানুষ স্ত্রীর কাছ থেকে দৈহিক অথবা আর্থিক অথবা উভয় ধরনের অবদানই প্রত্যাশা করে। সমাজে একটি সাধারণ বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে যে, প্রতিবন্ধী নারীরা পরিবারের জন্য বোঝা ব্যতীত অন্য কোনো কাজেই আসে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামী আরও বেশি যৌতুক দাবি করেছে এবং না পেয়ে স্ত্রীকে ত্যাগ করেছে।

গবেষণালব্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হচ্ছে, অনেক পরিবারই মনে করে যে প্রতিবন্ধী নারীদের গৃহবধূ হওয়ার বা সন্তান ধারণ ও লালন-পালনের সামর্থ্য নেই। যে স্ত্রী তার ঘর বা বাচ্চার যত্ন নিতে পারে না, তাকে কেউ পছন্দ করে না। বাস্তবে কিছু ঘটনায় দেখা যায়, অনেক পরিবারই প্রতিবন্ধী নারীদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিবন্ধী পুরুষের অন্বেষণ করেছে। প্রতিবন্ধী পুরুষ ও নারী পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে-এমন একটি প্রত্যাশাই এর কারণ হতে পারে। ঘটনা যা-ই হোক, বিয়ের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য নির্ভর করে স্ত্রীর প্রতিবন্ধিত্বের ধরন ও মাত্রা এবং সর্বোপরি প্রদত্ত যৌতুকের ওপর।

অতিরিক্ত রক্ষণশীল বা সনাতন মনোভাব সম্পন্ন পরিবারে প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীদের সাধারণত কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়। যদিও এসব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা সামাজিক দক্ষতাগুলো অর্জন করতে পারত। পরিবেশগত বাধাসমূহ যেমন পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা বা বিনোদন সুবিধায় প্রবেশগম্যতার অভাব তাদের সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীদের সম্পর্কে সমাজের বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি ও ভ্রান্ত ধারণার কারণেই তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যার ফলে তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো বাধাপ্রাপ্ত হয় যা তাদের বিয়ের সুযোগ ও পরিসরকে আরও সীমিত কে র ফেলে।

একজন কিশোরী বা নারী প্রতিবন্ধীর সার্বিক মানসিক ও দৈহিক বিকাশ নির্ভর করে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন আঙ্গিক থাকতে পারে, যেমন-পরিবার, সমাজ, শিক্ষা, পেশা ইত্যাদি। আলোচ্য আঙ্গিকগুলোর প্রেক্ষিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। নারী ও কিশোরী প্রতিবন্ধীদের মৌখিকভাবে উত্ত্যক্ত করাকে একটি সাধারণ সামাজিক আচরণ হিসেবে পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রধানত মাকেই প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সম্পূর্ণ পরিবারই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

পরিবারের অভ্যন্তরেও প্রতিবন্ধী শিশু, নারী বা কিশোরীদের অন্যান্য অপ্রতিবন্ধী সদস্যের মতো সম-দৃষ্টিতে দেখা হয় না। তারা অন্যদের তুলনায় শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির মতো মৌলিক অধিকারগুলো প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হয়। পিতামাতারাও তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য তেমনভাবে বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না। মেয়ে প্রতিবন্ধীদের প্রতি এ অবহেলা সর্বাধিক, কারণ মেয়েদের পরিবারের মধ্যে অনুৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের সাধারণত গৃহস্থালি কাজকর্ম দেখার জন্য বাড়ির মধ্যে রাখা হয়। এমনকি ভাইবোনরা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে একত্রে ঘুমায় না, বসে না অথবা খাবারও খায় না অর্থাৎ কোনোরূপ যোগাযোগ করে না। কারণ তারা ভাই বা বোনেরা মনে করে তাদের পরিবারের সব দুর্ভোগের মূলে রয়েছে এই প্রতিবন্ধী সদস্যটি। তারা এটাও মনে করে, এই প্রতিবন্ধী সদস্যের উপস্থিতির কারণে তাদের বিয়েতেও ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে অভিভাবক আয়োজিত ও সম্মত বিয়েতে।

কিছু কিশোরী ও নারী প্রতিবন্ধী উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও পরিবারে তাদের অবদানের জন্য কোনোরূপ স্বীকৃতি বা পুরস্কার দেওয়া হয় না। তবে অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেউ বাবা-মা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি লাভের কারণে সামাজিক স্বীকৃতি পায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিশোরী ও নারী প্রতিবন্ধীদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোন ভূমিকা থাকে না, এমনকি নিজের সন্তানের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়েও।

অন্যদিকে এমন কিছু দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় যেখানে কিছু কিছু পরিবার তাদের প্রতিবন্ধী সদস্যদের প্রতি সত্যিকার অর্থেই ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। এ ধরনের পরিবারের পিতামাতারা তাদের প্রতিবন্ধী কন্যাকে শিক্ষিত করতে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। এমন উদাহরণও পাওয়া যায় যে প্রতিবন্ধী সন্তানকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য পিতামাতা সরকারি চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে মেয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি বাসস্থান স্থানান্তর করেছেন।

অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী নারী ও কিশোরীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আত্মীয় বা প্রতিবেশীরা তাদের চলাচলের সহায়তা বা প্রয়োজনীয় সাহায্য করার সুযোগ গ্রহণের মাধ্যমে যৌন নির্যাতন করে থাকে। পিতামাতা তাদের প্রতিবন্ধী মেয়ের যৌন নির্যাতনের কথা জানলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে চায় না কারণ এ ধরনের ঘটনাগুলোতে সমাজ নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিকে দোষারোপ করে, নির্যাতনকারী তথা দোষীকে নয়।

প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী তাদের যত্নকারী বা সঙ্গদানকারী, অতিথি, আত্মীয়, আগন্তুক, সমবয়সী ও প্রতিবেশী এবং অনেক ক্ষেত্রে স্কুল শিক্ষকদের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হয়।

প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীরা তাদের মা, ভাই, বড় বোন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য কর্তৃক মানসিক বা আবেগিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। তারা তাদের প্রকৃত নামের বদলে প্রতিবন্ধিত্বের ধরন ভিত্তিক নামে পরিচিত লাভ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের প্রকৃত নামের সঙ্গে প্রতিবন্ধিত্বের ধরন যুক্ত করে বিকৃতভাবে সম্বোধন করা হয়। এটা সত্যিকারভাবেই দুঃখজনক, নিষ্ঠুর এবং একইসঙ্গে অমানবিক। দৈহিক প্রহার, আঘাত, দৈহিক শাস্তি, খাদ্যপ্রদান থেকে বিরত রাখা ইত্যাদি দৈহিক বা শারীরিক নির্যাতন খুব সাধারণ ঘটনা হিসেবে প্রতিনিয়তই ঘটছে বলে গবেষণায় দেখা যায়। যাহোক প্রতিবন্ধী সদস্যদের প্রতি পিতামাতা থেকে দাদি বা নানিকে বেশি সহানুভূতিশীল দেখা যায়।

বেশিরভাগ তরুণী, বালিকা বা কিশোরী দৈহিক বিকাশের ধাপসমূহ বা বয়ঃসন্ধিকালীন বিবর্তন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করে তাদের সমবয়সি, বড় বোন, ননদ, ভাবী, নানি, দাদিদের কাছ থেকে।

বেশিরভাগ প্রতিবন্ধী মেয়ে প্রথমবারের ঋতুস্রাবের সময় গভীর হতাশা, ভয়, বিষণ্ন্নতা ও লজ্জার সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী কিশোরীদের পক্ষে এ পরিবর্তনগুলো মানিয়ে নিতে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের এ ধরনের লজ্জা বা অস্বস্তির সাধারণ কারণ হচ্ছে, এই সমস্যা নিয়ে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় বা যোগাযোগে তাদের অসামর্থ্যতা। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা তাদেরকে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বা বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী কিশোরীদের ক্ষেত্রে এ সময়টি খুবই জটিল। এই সময়ে তাদের নিজস্ব যত্ন নেওয়ার কৌশলপদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া খুবই সমস্যাজনক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *