ডিজিটাল যুগ, অ্যানালগ রাজনীতি

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দটি শোনার পর সবার মনে প্রশ্ন ছিল বিষয়টি আসলে কী? ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে এক সুখী, সমৃদ্ধ, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বৈষম্যহীন জনগণের রাষ্ট্র, যার মুখ্য চালিকাশক্তি হলো ডিজিটাল প্রযুক্তি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারের ২০২১ রূপকল্পে একুশ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ডিজিটাল বিষয়টি এখন সারা দুনিয়ার প্রবণতা। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর—যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মিল রয়েছে তাদের জন্য এই কর্মসূচি। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচিতে জড়িয়ে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক বিষয়। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য রাষ্ট্র তথা সরকারকে পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা। জনগণ রাষ্ট্রকে কর দেবে, কিন্তু রাষ্ট্র জনগণের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান বা চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটাবে—এটাই তো প্রত্যাশা ডিজিটাল বাংলাদেশের কাছ থেকে।

রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি হবে বৈষম্যহীন ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, ছাত্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের অনুকূলের। ডিজিটাল মাধ্যমসহ সব মিডিয়ায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এসংক্রান্ত সব তথ্য প্রকাশ করা হবে, যা ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনগণ অনায়াসে পাবে। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব জনগণের ওপর ন্যস্ত করার জন্য একটি কার্যকর ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও সরকারের সব স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়েই দেশ পরিচালিত হচ্ছে। একটি নির্বাচিত সরকার কাজ করছে। জাতীয় সংসদকে কার্যকরী করে এগোচ্ছে দেশ। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা হিসেবে জেলা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ কাজ করছে। সরকারি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করছে। দেশটি পুরোপুরিভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে এবং এর সব কর্মকাণ্ড এমনভাবে পরিচালিত হবে যে জনগণ রাষ্ট্রীয় সব কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নিতে পারবে এবং রাষ্ট্রীয় সব তথ্যে জনগণের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে। প্রশাসনকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রশাসনের সব তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হচ্ছে। সরকারকেও হতে হবে আরো ডিজিটাল সরকার। জনগণ ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে যাতে সরকারের সঙ্গে অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দেশ পরিচালনায় অংশ নিতে পারে ও মতামত দিতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে, যা ব্যাপকভাবে করতে হবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালুতে উদ্যোগ নিতে হবে। শিশু শ্রেণি থেকে কম্পিউটারসহ অন্যান্য বিজ্ঞান বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ করার ব্যবস্থাসহ কম্পিউটারকে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা এখনই জরুরি। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ডিজিটাল যুগ বা জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। বিচার বিভাগ, কর্মকমিশন, নির্বাচন কমিশন ও মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাও ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি অংশ। রাজনৈতিক দলগুলো বিধিবদ্ধ ও জবাবদিহিমূলকভাবে স্বচ্ছতাসহ গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এখনই। এসব ব্যবস্থার সব তথ্য জনগণের কাছে পাওয়ার উপযোগী করার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবি। সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও রাজনীতিকদের রাজনৈতিক জীবনাচারসংক্রান্ত সব তথ্য উন্মুক্তভাবে জনগণের জন্য প্রকাশ করা এই ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি অংশ।

একুশ শতকে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশের যুগে রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি নতুন জোয়ার এসে জীবনধারায় নতুনত্বের আবাহনই তৈরি হতে যাচ্ছে। অ্যানালগ যুগ পেরিয়ে দেশ ডিজিটাল যুগে ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাই একালের নেতৃত্ব জ্ঞানে, মেধায়, তথ্য-প্রযুক্তি আর মননে সমৃদ্ধ হয়ে উন্নয়নশীল দেশ গঠনের পথকে করে তুলবে মসৃণ। সংস্কৃতিহীন যে মানবসমাজ তৈরি হয়েছে তা সমাজে নানা অসংগতি তৈরি করতেই হয়েছে পারদর্শী। কিন্তু সুবিধাবাদী চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়ে নানা পথে আর্থিক সুবিধা নিয়ে রাজনীতিতে পদ ও পদবি অর্জন করার মতো ক্ষমতাবান হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই রাজনীতিতে এত মতলববাজ, কুচরিত্রের সমাহার ঘটেছে। স্বল্প সময়ে অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়ারা যখন জাতীয় রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান নেন, তখন রাজনীতির গুণগত মান অনেক নিচে নেমে যায়, রাজনীতি ডিজিটাল না হয়ে অ্যানালগ হয়ে যায়। রাজনীতি তাই অনেকের কাছে হয়ে গেছে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার। একুশ শতকের রাজনীতিতে তাই গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি। গণবিচ্ছিন্ন, গণবিরোধীরা রাজনৈতিক অঙ্গনে দাপটের সঙ্গে ছড়ি ঘুরিয়ে চলছে শিক্ষিত, মেধাবী নেতৃত্বের ঘাটতির সুযোগে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকে রাজনীতি যে অবস্থানে ছিল, আজকে তার লেশটুকুও নেই। একসময় নেতারা সাধারণ মানুষের কাছেও সম্মান পেতেন, এখন তাঁরা আর সেই সম্মান অর্জন করতে পারেন না। রাজনীতিকেও জনগণ সহজ এবং ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে বলে মনে হয় না। বরং রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের একটা বীতশ্রদ্ধ ভাব দেখা যায়। তাই এই ডিজিটাল যুগে রাজনীতিকেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। ডিজিটাল এই যুগে রাজনীতিকেও ডিজিটাল হতে হবে, এটা এখন সময়ের দাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *