আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, নিরাপত্তা, গবেষণা, বিনোদন ইত্যাদিতে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে; বেড়েছে সার্বিক বাণিজ্যও। তার উদাহরণ আমরা পাই দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধি এবং শপিংয়ে অনলাইন পদ্ধতির দ্রুত প্রচলন। এ পরিবর্তনের ছোঁয়া নিঃসন্দেহে ডিজিটাল বিপ্লবের হাতছানি দিচ্ছে, যা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে একটি মডেল হিসেবে তৈরি করবে।
প্রথম শিল্প বিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার দিয়ে। এরপর ১৮৭০ সালে দ্বিতীয়টি বিদ্যুৎ আবিষ্কার ও ১৯৬৯ সালে তৃতীয়টি হলো ইন্টারনেটের আবিষ্কার। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে যেতে পারে ডিজিটাল বিপ্লব। এ নিয়েই এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। এটি হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। ডিজিটাল বিপ্লবকে কেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলা হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। বিজ্ঞজনরা বলছেন, আমরা চাই বা না চাই এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তা ও চেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সব কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে। প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে; যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়া। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্য-প্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে দিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয়, গুগলে ৪২০ কোটি বার বিভিন্ন বিষয় খোঁজা হয়। এক যুগ আগেও এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়। চতুর্থ এই শিল্প বিপ্লব সারা বিশ্বের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া যাচ্ছে। একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, এর ফলে সব মানুষেরই আয়ের পরিমাণ ও জীবনমান বাড়বে। বিশ্বের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ায়ও ডিজিটাল প্রযুক্তি আনবে ব্যাপক পরিবর্তন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ অনেক কমে আসবে, ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। তবে আরেক দল অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ডিজিটাল বিপ্লব বিশ্বের অসাম্য ও দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরো দুর্বিষহ পর্যায়ে নিয়ে যাবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে মানুষের দ্বারা সম্পন্ন অনেক কাজ রোবট ও যন্ত্রপাতি দিয়ে সম্পন্ন করা হবে। এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে তা সমস্যা তৈরি করবে। এ ছাড়া শ্রমবাজারে অল্প কর্মদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও বাজার কমে যাবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বেশি করে সমস্যায় ফেলবে। ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে সারা বিশ্বে সম্পদবৈষম্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাড়বে বলে অনেকের আশঙ্কা। ডিজিটাল প্র্রযুক্তির আবিষ্কারক ও বিনিয়োগকারী দেশগুলো যতটা লাভবান হবে, অন্য দেশগুলো সে রকম বঞ্চিত হবে। বিষয়টিকে জয়ী পক্ষের সব ছিনিয়ে নেওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল বিপ্লবের প্রভাব হবে ব্যাপক। ব্যতিক্রমী পণ্যসেবার পাশাপাশি নিয়ত পরিবর্তনশীল গ্রাহক চাহিদা পূরণে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি ব্যবহারে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সরকার পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণেও ডিজিটাল বিপ্লব আনবে বড় পরিবর্তন। প্রযুক্তি বিপ্লব সরকারি সেবাকে একদিকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসবে, অন্যদিকে বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের সহজলভ্যতা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঝুঁকিও বাড়াবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সঙ্গে মানবিক সম্পর্কের বিকাশ যে নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে তার ছোঁয়া এ দেশেও এসে পড়েছে। শিল্প বিপ্লবের পর একটা জটিল সাপ্লাই চেন গড়ে উঠেছিল নকশা থেকে উৎপাদন, পণ্য বিতরণ, আমদানিকারক, পাইকারি আর খুচরা বিক্রেতার সমন্বয়ে। এর ফলে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে শত কোটি ধরনের পণ্য উৎপাদনের, বিপণনের এবং তা পৌঁছে যাচ্ছে ভোক্তার দুয়ারে। এভাবে শিক্ষাদান পদ্ধতিরও পরিবর্তন হয়েছে। সাপ্লাই চেন ম্যানেজ করার লোক তৈরি করতে উঠেপড়ে লেগেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ফলে মৌলিক বিজ্ঞান চর্চার চেয়ে রাতারাতি অন্য ডিগ্রিগুলোর কেমন যেন কদর বেড়েছে।
আমরাও নিজেদের তৈরি করছি এই পথে। দেশজুড়ে চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্কের বিস্তার, দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল এবং ছয়টি টেরেস্ট্রিয়াল কেবলের সংযোগের মাধ্যমে আমাদের ইন্টারনেট যোগাযোগ এখন বহুমুখী। ব্রডব্যান্ড আর ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন সহজে যুক্ত হতে পারছে জ্ঞানের মহাসড়কে। এর পাশাপাশি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে ক্রমান্বয়ে রোবটিকস, বিগ ডাটা অ্যানালিটিকস কিংবা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে জন্য বানানো হয়েছে বিশেষায়িত ল্যাব।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তিতে অনেক ভালো করেছে এবং বর্তমান বিশ্বের আধুনিক সব তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে। আগামীর প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতেও প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে সমানভাবেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও ই-গভর্নেন্স, সার্ভিস ডেলিভারি, পাবলিক পলিসি অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন, তথ্য-প্রযুক্তি, বিকেন্দ্রীকরণ, নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা এবং এসডিজি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও প্রশাসনিক নীতি কৌশল নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ক্লাউড সার্ভার, ইন্টারনেট অব থিংস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ এরই মধ্যে এশিয়ান টাইগার বলে পরিচিত।
বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘসহ সবার প্রতিবেদনেই আমরা দেখি আগামী বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের হাইটেক পার্কগুলো হবে আগামীর সিলিকন ভ্যালি। এরই মধ্যে ৬৪টি জেলার চার হাজার ৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদের সবই ডিজিটাল নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের প্রধান সেবাগুলো বিশেষ করে ভূমি নামজারি, জন্ম নিবন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বা চাকরিতে আবেদন ইত্যাদি ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাগরিকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি মৌলিক সেবাগুলো প্রদানের বিষয়টিকে আরো সহজ ও সাশ্রয়ী করে তুলেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে আরো কর্মক্ষম বাংলাদেশ, আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বাংলাদেশ, আরো ন্যায়সংগত বাংলাদেশ, আরো শক্তিশালী ও সমৃদ্ধতর বাংলাদেশ।