বাংলাদেশে নারী মুক্তির ইতিহাস

বাংলাদেশে নারী মুক্তির ইতিহাস
দীর্ঘদিনের, স্বাধীনতাযুদ্ধে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে তাদের
ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রশংসনীয়। সুদৃঢ় প্রশাসনিক ও
আইনিকাঠামো, সচেতন নাগরিক সমাজের কারণে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন শক্ত
ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে, যা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং নারীবান্ধব পরিবেশ
সৃষ্টিতে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য
দূরীকরণ (সিডও) সনদে স্বাক্ষর করেছে।

শিক্ষায় নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক
শিক্ষাসহ উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি তাদের ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত
করাই হলো অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে উন্নয়নের
প্রধান বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কারণ লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন
দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ
প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য অনেকটাই কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে এবং
অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা অর্জনে অনেক অগ্রগতি সাধিত
হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে সমতা আনয়নের লক্ষ্যে ও সেবা খাতে নারীর অংশগ্রহণ
বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রবর্তন করা হয়েছে। নারীর
ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়, যেমন—ইউনিয়ন এবং উপজেলা পরিষদ
নির্বাচনে নারীদের সরাসরি অংশগ্রহণ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। জাতীয় সংসদে
নারীর অংশগ্রহণের হার আশাব্যঞ্জক।

‘সবার জন্য শিক্ষা’ এই কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার হার বাড়ানো
এবং বিশেষ করে নারী শিশুদের শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা। শিক্ষাবৃত্তি
কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে
নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা, যা শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা তৈরির
ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী অর্জন এনে দিয়েছে। এই শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রম
বিশ্বে একটি বেস্ট প্র্যাকটিস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ কথা অবশ্যই উল্লেখ
করা প্রয়োজন যে গত কয়েক দশকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন
কার্যক্রম যেমন—বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, দুগ্ধবতী মায়েদের জন্য ভাতা,
প্রতিবন্ধী ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা প্রদান, যা অতি দরিদ্র নারীদের
জীবনযাত্রায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।

নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতা তৈরিতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও নারীর
প্রতি সহিংসতা এখনো অনেক পিছিয়ে। এখনো ৬৭ শতাংশের বেশি নারী তাদের
পারিবারিক জীবনে কখনো না কখনো সহিংসতার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন ও
লিঙ্গবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে সাফল্য অর্জন করেছে, কিন্তু
সার্বিক বিষয়ে অগ্রগতি মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের
ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ কথা সত্য,
সপ্তম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম
আয়ের দেশ হিসেবে পরিণত করার জন্য এ দেশের নারীসমাজকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক
কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের আরেকটি বড় অর্জন হলো স্থানীয় সরকার আইন। এই আইনের ফলে
নারীদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন করার
অধিকার। নির্বাচিত নারীদের এলাকায় সম্মান ও ক্ষমতা দুটিই বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির ফলে তৃণমূল পর্যায়ের
নারীরা তাদের সমস্যাগুলো সহজেই তুলে ধরতে পারছে।

নারীদের উন্নয়নের জন্য ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তাদের মালিকানা
স্থাপন জরুরি। দেখা যাচ্ছে যে ভূমির ওপর নারীদের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ
প্রতিষ্ঠা হলে পরিবার ও জনগোষ্ঠীর খাদ্য সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা,
পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ ও টেকসই কৃষিব্যবস্থার নিশ্চয়তা তৈরি হয়। অনেক দেশেই
ভূমির ওপর নারীর অধিকার আইন, পারিবারিক আইন ও বৈবাহিক সূত্র দ্বারা সীমিত
করা হয়েছে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে ভূমি শুধু আয়ের উৎস নয়, এটা সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক অধিকারের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। ভূমির ওপর নারীদের অধিকার ও
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পানি, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য
ইত্যাদির ওপর তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা ও তা নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করতে হবে।

এরপর আসে মানসম্মত কাজের পরিবেশ এবং মজুরি। নতুন উন্নয়ন মডেলের বিষয়ে
ভাবতে হলে প্রথমেই আমাদের শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির বিষয়টি আলোচনায় আনতে
হবে, বিশেষ করে নারী শ্রমিকের মজুরির বিষয়টি। মানসম্মত কাজের পরিবেশ ও
ন্যায্য মজুরি ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন কখনোই সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও এটা
সত্য যে আমাদের শ্রমিকের বেশির ভাগই নারী, যারা গার্মেন্ট, কৃষি,
ঘর-গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এবং তাদের অবস্থা
শোচনীয়, দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। দারিদ্র্য ও  ঋণের কারণে তারা
নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত কাজ করছে, ফলে তাদের নিজস্ব স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা
ও পরিবারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উপেক্ষিত হচ্ছে। আমাদের এমন একটি উন্নয়ন
মডেল দরকার, যেখানে শ্রমিক পরিবারের নিরাপত্তার পাশাপাশি মানসম্মত মজুরি
নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকবে, যাতে করে নারী শ্রমিক সম্মানের সঙ্গে তার
জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।

লিঙ্গ সমতা একটি মৌলিক অধিকার। লিঙ্গ সমতা তৈরি একটি দেশের উন্নয়নের
জন্য বাস্তব এবং কার্যকরী পদক্ষেপ। দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার
পাশাপাশি একটি একীভূত সমাজ বিনির্মাণে টেকসই উন্নয়ন খুবই জরুরি। নারীর
প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে এবং নির্মূলে একটি শক্তিশালী জাতীয় পরিকল্পনা
প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব পর্যায়ে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ থাকতে হবে।
জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে বহু অংশীদারিমূলক
অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রাখা, যাতে ৬০ শতাংশ নারী ও কমপক্ষে ২৫ শতাংশ নারী
আন্দোলনের কর্মীদের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা। নীতিনির্ধারণে লিঙ্গ
সমতা ও এর অগ্রাধিকার থাকতে হবে, তাহলেই বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে
পারবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *