নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে

নিজেদের প্রাপ্তির জন্য আমরা সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে কাজ করছি। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আছি। দেশ আর সমাজকে নিয়ে ভাবছি আমরা? আর কত সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় প্রয়োজন আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য? আর কত দিন অপেক্ষার প্রয়োজন হবে নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য? এই প্রশ্ন কার কাছে রাখব? সমাজের কাছে রাখব? রাষ্ট্রের কাছে রাখব? সমাজের অধিবাসীদের কাছে রাখব? সরকারের কাছে রাখব? সবাই নিজেকে নিয়েই শুধু ব্যস্ত রয়েছি, শুধু ভাবছি নিজেকে নিয়ে। সরকার ব্যস্ত রয়েছে সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে গণতন্ত্রকে রক্ষাসহ দেশের উত্তরোত্তর কল্যাণের জন্য। আর বিরোধী দলগুলো ব্যস্ত রয়েছে গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য, তাদের ভাষায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য। তবে আমরা যারা সাধারণ জনগণ রয়েছি, তাদের কী হবে? আমাদের নিয়ে কেউ কি ব্যস্ত আছেন অথবা ভাবছেন, কিংবা ভাবার সময় কি আছে? এটা কিন্তু মোটেই দৃশ্যমান নয়। আমরা কেমন জানি একটা বেড়াজালের মধ্যেই আছি। জাতি হিসেবে কি আমরা খুব একটা এগোতে পারছি? খুব একটা এগোচ্ছি বলে মনে হয় না, দু-একটা ভালো অর্জন আমাদের আছে! সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায় কাদা ছোড়াছুড়িতে। তা ছাড়া সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় তো রয়েছেই। এই নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আমাদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের অর্জনকে ধরে রাখতে পারছি না। শিক্ষক ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে ব্যস্ত থাকেন তাঁর কোচিং সেন্টার নিয়ে। এই ছাত্ররা যে আমাদের ভবিষ্যতের হাল ধরবে তাদের সেভাবে তৈরি করতে হবে, তা নিয়ে ভাবার সময় কি আছে? আর সন্তানের মা-বাবা ব্যস্ত রয়েছেন জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য। দিন-রাত পরিশ্রম করে আনা অর্থ কোনো কাজে লাগছে কি না, সে বিষয়ে কারো চিন্তা করার সময় নেই। সন্তান কী শিখছে, কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, সে খেয়াল রাখার মতো অবস্থায় আমরা নেই। কিন্তু কেন? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! কেন এমন হলো, তা নিয়ে সরকার ও নাগরিক সমাজকে ভাবতে হবে। সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এগুলো থেকে বের হয়ে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

একসময় ছিল—মানি ইজ লস্ট, নাথিং ইজ লস্ট, হেলথ ইজ লস্ট, সামথিং ইজ লস্ট, হোয়েন ক্যারেক্টার ইজ লস্ট এভরিথিং ইজ লস্ট; কিন্তু এটার একটু পরিবর্তন হয়েছে এভাবে এখন ক্যারেক্টার ইজ লস্ট নাথিং ইজ লস্ট, হেলথ ইজ লস্ট সামথিং ইজ লস্ট, হোয়েন মানি ইজ লস্ট এভরিথিং ইজ লস্ট। এখন টাকাই সব, টাকার জন্য সব কিছুই করা সম্ভব। আমরা শুধু টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছি। টাকার জন্য মানসম্মান, আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি! অন্যদিকে সমাজ বিনির্মাণে, রাষ্ট্রের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে আমাদের যে কিছু দায়িত্ব রয়েছে, সেগুলো আমরা সঠিকভাবে পালন করছি কি না কিংবা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি কি না, সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। সব কিছুতেই আমাদের ভেজালের ছড়াছড়ি। ওষুধে ভেজাল, খাবারে ভেজাল, পরীক্ষায় ভেজালসহ সব কিছুতেই ভেজাল। এমন অবস্থা তো চলতে পারে না এবং চলতে দেওয়া যায় না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের সব অর্জন ধ্বংস হতে বেশি সময় লাগবে না। একটি ওষুধ কম্পানির মালিক যদি মনে করেন, তাঁর ওষুধে কোনো ভেজাল দেবেন না, তাহলে কি অন্যরা নিশ্চয় তাঁর ওষুধে ভেজাল দিতে আসবেন না। একজন মালিককে ভাবতে হবে তাঁর কম্পানির ওষুধ খেয়ে লাখ লাখ মানুষ বাঁচবে, তাঁর ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য চেষ্টা করা একেবারেই উচিত নয়। একজন খাবারের দোকানের মালিক যদি মনে করেন, কম লাভে তাঁর চলবে, তাহলে তাঁকে খাবারে ভেজাল মেশাতে হবে না। ব্যবসায় মুনাফা করতে হবে, এটাই নিয়ম। তবে নিজের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে নয়। দেশের মানুষের কল্যাণ হয় না, শুধু নিজের লাভের জন্যই তা আমরা অনেক সময় করে থাকি। শুধু নিজের মুনাফা অর্জনের জন্য আমরা যেন একটি জাতিকে ধ্বংস করে না দিই, সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে। একজন ওষুধ কম্পানির মালিক, খাবার প্রস্তুতকারী কম্পানির মালিকের এটা মনে রাখতে হবে, তাঁর ভেজাল মেশানোর কারণে হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে, এমনকি তাদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ভেজাল খাবার ও ভেজাল ওষুধ একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এসব দিক মনে রেখেই কাজ করতে হবে। কিন্তু আমরা কি তা করছি? আমার ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে পারলেই হলো। অন্যের কী হলো, দেশের কী হলো, তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর সময় নেই।

একজন শিক্ষকের কাছে থাকা প্রশ্ন যদি পরীক্ষার আগেই ফাঁস হয়ে যায়, তিনিই বা কেমন শিক্ষক? তিনিই বা কী নৈতিকতা শিক্ষা দেবেন তাঁর ছাত্রকে! আর জাতিই বা তাঁর কাছ থেকে কী আশা করতে পারে? আমি যদি আমার পবিত্র নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে দিই, তাহলে তো আর কিছু বলার থাকবে না। আমি আমার ‘বাংলাদেশকে ভালোবাসি’ এই স্লোগানে আমাদের সবাইকে এক কাতারে এসে দাঁড়াতে হবে। এ জন্য নাগরিক সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ আগে জাতি হিসেবে আমাদের সব সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় দূর করতে হবে। নৈতিক অবক্ষয়ের দিক থেকে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। চলুন, আমরা আবার সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়াই, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে, বাংলাদেশকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে এক সুন্দর বাংলাদেশে পরিণত করি।

হীরেন পণ্ডিত, লেখক : প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *