হীরেন পণ্ডিত: জীবনের তাগিদে, কাজের তাগিদে মানুষকে যে কত জায়গায় যেতে হয় তার কোন শেষ নেই। কাজের পরিবীক্ষণ বা গবেষণা করতে গিয়ে ইতিমধ্যে দেশের ৬৪ জেলার ৬২টিতে যাবার সুযোগ হয়েছে। আমার ইচ্ছে করে কাজের পরে যদি সময় পাওয়া যায় তাহলে যে কোন জায়গার দর্শনীয় স্থানগুলো একটু দেখে নিতে। অফিসের কাজে ভারতের তামিলনাড়–র মাদুরাই শহরে যাবার সুযোগ হয়েছিলো। আসলে অনেকগুলো জায়গায় যাবার সুযোগ হয়েছে সেগুলো অধিকাংশ অফিসের কল্যাণেই। ঢাকা-কোলকাতা-চেন্নাই-মাদুরাই বিমান যাত্রা। ঢাকা থেকে চেন্নাই সরাসরি কোনো বিমান নেই আপনাকে যেতে হবে কোলকাতা তারপর চেন্নাই তারপর চেন্নাই থেকে এক ঘন্টায় মাদুরাই পৌঁছাতে পারবেন। কোলকাতা থেকে ট্রেনেও যাওয়া যায় লেগে যাবে ৩৬ ঘন্টার বেশি
মাদুরাইকে বলা হয় কবিদের শহর এর কারণ মাদুরাই অনেক তামিল জনপ্রিয় কবির জন্ম দিয়েছে। মাদুরাই ছোট একটি শহর। তবে দেখার মত রয়েছে অনেক কিছু। ড. প্রাজনা আমাদের আগ্রহ করেই বললেন যেন একবার হলেও মীনাক্ষী টেম্পল দেখতে যাই। এ ছাড়াও আরো অনেক কিছুই আছে মাদুরাইয়ে দেখার। উপরে পাহাড়ে থাকা ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকানো যেতেই পারে। তারপর পেরিয়ার বাসস্ট্যান্ড, টেপ্পকুলাম মারিয়ামান ট্যাঙ্ক, ভাইগাই নদী, মাদুরাই মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দির, মাদুরাই শহরের দিগন্ত, তিরুমালাই নায়ককর প্রাসাদ এবং মাদুরাই কর্পোরেশন ভবন দেখতে পারেন।
মাদুরাই ভারতের তামিলনাড় রাজ্যের একটি মহানগর। এটি ভারতের ২৬তম বৃহত্তম ও তামিলনাড়–র তৃতীয় বৃহত্তম মহানগর। তামিলনাড়–ও পৌর সংস্থার মধ্যে মাদুরাই দ্বিতীয় বৃহত্তম। এই শহরটি মাদুরাই জেলায় অবস্থিত। মাদুরাইকে তামিলনাড়–র সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। শহরটি তামিলনাড়– রাজ্যের দক্ষিণাংশে অবস্থিত।
তামিলনাড়–র পশ্চিমঘাট পর্বতের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, ভাইগাই নদীর তীরে উর্বর সমতলভূমিতে মাদুরাই অবস্থিত। ভাইগাই নদী এই শহরের উত্তর পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বয়ে গেছে। এই শহরের উত্তর এবং পশ্চিম দিকে সিরুমালাই ও নাগামালাই নামে দু’টি পাহাড় আছে। মাদুরাইয়ের বেশিরভাগ ভূমি কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। প্রধান ফসল ধান, এছাড়া বিভিন্ন প্রকার ডাল, মিলেট, তেলবীজ, কার্পাস ও আখের চাষ হয়।
বছরের আট মাস মাদুরাইয়ের আবহাওয়া উষ্ণ ও শুষ্ক প্রকৃতির। মার্চ থেকে জুলাই এখানে গরমের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। আগস্ট থেকে অক্টোবর এই কয় মাস এখানের আবহাওয়া মাঝারি প্রকৃতির। এই সময় বজ্রবিদ্যুৎসহ ভারী বৃষ্টিপাত হয়। নভেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারি হালকা শীতল প্রকৃতির। তামিলনাড়–র অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত।
আমরা যখন মাদুরাই পৌঁছাই তখন মধ্যরাত। বিমান বন্দরে আমাদের জন্য হোটেলের গাড়ি আসাতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। গাড়ির তামিল ড্রাইভার সাহেব নামের ছোট সাইনবোর্ড তুলে ধরতেই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম, আমিই তার সেই লোক যার জন্য সে অপেক্ষা করছে। আমন্ত্রণ জানালেন গাড়িতে উঠার জন্য। গাড়ি হোটেলের দিকে যাচ্ছে রাস্তায় দেখলাম রাত ১২ টায় পুরুষ পুলিশ কর্তকর্তার পাশাপাশি নারী পুলিশ কর্মকর্তা মোটর সাইকেল চেপে রাস্তা টহল দিচ্ছে। সত্যি ভালো লাগার বিষয় বা এজন্যই তামিলনাড়– অনেক এগিয়ে ভারতের অন্য রাজ্য থেকে। বলে রাখা ভালো বিশ^বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সুরকার এ আর রহমানের আদি নিবাস কিন্তু তামিলনাড়–। ভারতের যে কয়েকজন গুণী ব্যক্তি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তার বেশ কয়েকজন তামিলনাড়–তে জন্মগ্রহণ করেছেন। তবে মাদুরাই শহরের প্রায় সব সাইনবোর্ড তামিল ভাষায় লেখা থাকার কারণে প্রাথমিক কিছু সমস্যা পোহাতে হয়েছিলো যাক সেটা বড় কোনো বিষয় নয় মাতৃভাষার প্রতি যথেষ্ট সম্মান রয়েছে সবার।
মাদুরাই শহরের হিন্দু জনসংখ্যা ৮৫.৮%, মুসলমান জনসংখ্যা ৮.৫%, খ্রীস্টান ৫.২% এবং ০.৫% অন্যান্য। তামিল এখানকার প্রধান মাতৃভাষা। মাদুরাই থেকে কেরালা, ব্যাঙ্গালোর যাওয়া যায় খুব সহজেই। মাদুরাই রেল স্টেশনটি শহরের প্রধান রেল স্টেশন। মাদুরাই শহরের মাদুরাই রেল ডিভিশনের সদর দপ্তর অবস্থিত। ডিভিশনটি দক্ষিণ রেল এর অন্তর্গত। স্টেশনটি থেকে মাদুরাইয়ের সঙ্গে কোচি, চেন্নাই, রামেশ্বরম, তুথুকুডি, ব্যাঙ্গালোর ও কোয়েম্বাটুর শহরের সঙ্গে রেল যোগাযোগ রয়েছে।
মাদুরাই বিমানবন্দর ১৯৫৭ সালে মূল শহর থেকে ১২ কি.মি. দূরে অভনিয়াপুরমে স্থাপিত হয়। চেন্নাই, কোয়েম্বাটুর, এবং তিরুচিরাপল্লীর পর, এই বিমানবন্দর তামিলনাড়– রাজ্যের চতুর্থ ব্যস্ততম বিমানবন্দর। এখানে এয়ার ইন্ডিয়া, স্পাইসজেট, ইন্ডিগো এবং শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের বিমান পরিষেবা পাওয়া যায়। মাদুরাই বিমানবন্দর তামিলনাড়– রাজ্যের চতুর্থ বৃহত্তম বিমানবন্দর। বিমানবন্দরটি থেকে মুম্বাই, কলকাতা, দিল্লি, চেন্নাই,ব্যাঙ্গালোর ও কোয়েম্বাটুর বিমানবন্দরের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ রয়েছে। তবে চেন্নাই হলো কাছাকাছি অন্তর্জাতিক বিমান বন্দর।
মাদুরাই ঐতিহ্যগতভাবে একটি কৃষিনির্ভর সমাজ, প্রধান ফসল ধান। কৃষকের আয় বাড়াতে মাদুরাই জেলার কৃষ্ণমাটিসহ অঞ্চলগুলিতে তুলার চাষাবাদ ষোড়শ শতাব্দীতে নায়ক শাসনকালে চালু হয়। মাদুরাই উত্তর, মেলুর, নীলকোটাই এবং উথামপালায়ম জুড়ে ভাইগাই ব-দ্বীপে যে ধানের জমিতে আবাদ করা হয়। কৃষকরা তাদের আয়ের পরিপূরক হিসাবে দুধের গরু পালন, হাঁস-মুরগি-পালন, মৃৎশিল্প, ইট তৈরি, মাদুর-তাঁতী এবং কাঠের কাজ করে।
বাংলাদেশের যশোরের মত মাদুরাইয়ের জুঁই বাগানের খ্যাতিযুক্ত শহরটি মাদুরাই মল্লী নামে পরিচিত, মূলত কোডাইকানাল পাহাড়ের পাদদেশে এবং মাদুরাইয়ে সকালের ফুলের বাজারে কেনাবেচা হয়। ফুলের বাজারে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার কৃষক ফুল বিক্রি করেন। ধন্যবাদ ড. প্রাজনাকে এসব তথ্য দেয়ার জন্য।
ক্ষুদ্র শিল্পের আবির্ভাবের সাথে সাথে মাদুরাইয়ে শিল্পায়নের ফলে জেলা জুড়ে এই খাতে কর্মসংস্থান মাদুরাইয়ে রাবার-ভিত্তিক শিল্প রয়েছে। গেøাভস, ক্রীড়াসামগ্রী, ম্যাটস, অন্যান্য ইউটিলিটি পণ্য এবং অটোমোবাইল রাবার উপাদানগুলি এই শিল্পগুলির দ্বারা সর্বাধিক উৎপাদিত পণ্য। অটোমোবাইল উৎপাদনকারীরা শহরে উৎপাদিত রাবার উপাদানগুলির প্রধান গ্রাহক। মাদুরাইয়ে প্রচুর টেক্সটাইল, গ্রানাইট এবং রাসায়নিক শিল্প রয়েছে। শহরটি বিশাল অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করেছে
মাদুরাই আইটি-র জন্য দ্বিতীয় স্তরের শহর হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে এবং কিছু সফ্টওয়্যার সংস্থা মাদুরাইয়ে তাদের অফিস চালু করেছে। এই জাতীয় বেশ কয়েকটি সংস্থাকে ভারত সরকারের সংস্থা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কস অফ ইন্ডিয়া জাতীয় তথ্য প্রযুক্তি বিকাশ কর্মসূচির আওতায় সুবিধা পাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। রাজ্য সরকার মাদুরাইয়ে দুটি আইটি-ভিত্তিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তাব করে এবং এগুলি সম্পূর্ণভাবে আইটি সংস্থার দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এইচসিএল টেকনোলজিস এবং হানিওয়েলের নিজস্ব ক্যাম্পাস রয়েছে মাদুরাইয়ের ইলক্যাট আইটি পার্কে।
তামিলনাড়–র প্রধান খাবার আমরা যাকে বলি নিরামিষ বা সবজি ওরা এটাকে বলে সাম্বার খেতে খুব সুস্বাদু। তবে তামিলদের মধ্যে অনেক ভেজেটেরিয়ান আবার নন-ভেজেটেরিয়া আছে। তবে অধিকাংশকেই দেখলাম ভেজেটেরিয়ান।
ড. প্রাজনা আমাদের জানালেন মীনাক্ষী মন্দির, মীনাক্ষী, এর এক ধরন পার্বতী, শিব এবং তার স্ত্রী, সুন্দরেশ্বর, এর এক ধরন শিব। তামিল সঙ্গম সাহিত্যে উল্লিখিত প্রাচীন মন্দির শহর মাদুরাইয়ের কেন্দ্রস্থলে মন্দিরটি রয়েছে, ষষ্ঠ শতাব্দীর গ্রন্থগুলিতে দেবী মন্দিরটির উল্লেখ রয়েছে। কথিত আছে মাদুরাই মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বরর মন্দিরটি রাজা কুলাসেকার পাÐ্য দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি চ‚ড়া এতই উঁচু যে ড. প্রাজনার সাথে একটু রসিকতা করলাম, কারণ মন্দিরের উচ্চতা দেখে মনে হলো স্বর্গে অবস্থানরত ভগবান শিবকে কাছে পাওয়ার একটা চেষ্টা হয়তো করা হয়েছে, হাসলেন ড. প্রাজনা।
হিন্দু সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় বিষয়কে চিত্রিত করে ফ্রেসকোস এবং ত্রাণগুলির নামে এই গোপুরামটির নামকরণ করা হয়েছে। চৌদ্দ শতকের পরে পুনর্র্নিমাণ করা হয়েছে মন্দিরটি। মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দির হিন্দুদের ধর্মতাত্তি¡ক এবং সাংস্কৃতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। অধ্যাপক ক্রীস্টোফার ফুলার তার মত প্রকাশ করেন যে, মন্দিরটির মিনাক্ষী দেবী ও সুন্দরেশ্বর শিবের বিবাহের সূ² ঘটনাবলীর বিবরণ, দেশান্তকরণের অধিকারের দিব্য গুরুত্ব এবং “সুমঙ্গলী” তথা বিবাহিত নারীর স্বামীর সাথে বাস করেও তার প্রাপ্য স্বাধীনতা ও মঙ্গলময়তা প্রভৃৃতি আচার আচরণগুলি দেবতার সাথে দেব ও দেবীর বিবাহ প্রতীকীভাবে মানব বিবাহকেই তুলে ধরে। মীনাক্ষী মন্দিরটি হিন্দুধর্মের অন্যতম তিনটি মূল ধারাকে একত্রিত করেছে। এই মন্দিরটি হিন্দু বিবাহের জন্য একটি উত্তম মন্দির, যদিও খুব বেশি বিবাহকার্য এই মন্দিরে সম্পন্ন হয় না। শুধুমাত্র কম সময়সাপেক্ষ বিবাহের মূল কাজটি এখানে সম্পন্ন করা হলেও অন্যান্য রীতিনীতি অন্যত্রই করা হয়। মীনাক্ষী মন্দিরটি শুধু একটি ধর্মীয়স্থল নয় এটি ঐ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্র ও বটে। মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পূজার সামগ্রী এবং অন্যান্য একাধিক সামগ্রী মাদুরাই শহরের অর্থনীতিতে বিরাট বড় ভূমিকা রাখছে।
মন্দিরটির ইতিহাসের ঐতিহ্যবাহী সংস্করণ রয়েছে যা এটি কল করে শিব-লীলা এবং এর মধ্যে ষাটটি পর্ব মন্দিরের দেয়ালের চারপাশে ম্যুরাল হিসাবে আঁকা হয়েছে। ১ অক্টোবর, ২০১৭ এই মন্দিরটিকে ভারতের সেরা আইকনিক প্লেস হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। ধন্যবাদ ড. প্রাজনাকে শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের সময় দিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য। আবার রসিকতা করলেন ড. প্রাজনা দেখো তামিল পর্যটন কর্পোরেশনের আমি কিন্তু কেউ না তবে যারা এই শহরে আসে তাদের কে দেখে যেতে বলি ৬ষ্ঠ শতাব্দীর এই মন্দির। মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দিরের অনেক আকর্ষণীয় কারুকার্য রয়েছে তবে বিভিন্ন রংয়ের ছোঁয়া রয়েছে। আমাদের দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরও অনেক সুন্দর।