বিদ্যুৎ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে জনগণের নাভিশ্বাস

হীরেন পণ্ডিত
জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এতে ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। ব্যয় বাড়ার অসংখ্য কারণ আছে, যা আমরা অনেকেই জানি। ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফা করছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এসব নানা কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এতে মানুষের ব্যয়ও বাড়ছে।

আবারও বিদু্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাব ছিল ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়ানোর। এর বিপরীতে যাচাই-বাছাই করে বিইআরসির কারিগরি টিম ৫৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। সম্প্রতি রাজধানীর বিয়াম অডিটোরিয়ামে বিইআরসি আয়োজিত গণশুনানিতে এই সুপারিশ করা হয়।

এদিকে অনেক দিন ধরে দেশে ভোজ্যতেলের বাজার বেসামাল। ভরা মৌসুমে বাড়ছে চাল ও পেঁয়াজের দাম। সেই সঙ্গে বাড়ছে আটা, ময়দা, রসুন, আদাসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম। এরই মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিইআরসি। আগামী সপ্তাহেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসতে পারে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বর্তমানে পিডিবির পাইকারি বিদ্যুতের দাম প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ৫ টাকা ১৭ পয়সা। পিডিবি এই দাম ৬৬ ভাগ বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৮ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তাদের প্রস্তাব মূল্যায়ন করে বিইআরসির কারিগরি কমিটি ভর্তুকি দিলে আগের দাম অর্থাৎ ৫ টাকা ১৭ পয়সা এবং ভর্তুকি না দিলে ৮ টাকা ১৬ পয়সা করার সুপারিশ করেছে। পিডিবির পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় খরচ বেড়ে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মূসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকা। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে পিডিবির।

শুনানিতে বিইআরসির চেয়ারম্যান জানান, প্রশ্ন উঠতে পারে গ্যাসের দামের গণশুনানির ঘোষণা না দিয়ে কেন আমরা বিদ্যুতের দামের শুনানি নিচ্ছি। দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সরকারের পলিসির বিষয় থাকে, সেটি দালিলিকভাবে প্রমাণের বিষয় থাকে। সেটার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। শেষ হলে গ্যাসের দামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) শীর্ষ নেতাদের মতে, বিদ্যুতের দাম বাড়ালে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কৃষি, শিল্প উৎপাদন ও সেবা খাতের খরচ বাড়বে। এতে নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

গত ১২ বছরে বিদ্যুতের দাম ১১ বার বেড়েছে। এতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১১৮ শতাংশ। আর খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। অন্যদিকে বৈশি^ক করোনা মহামারী ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী আমদানি পণ্যের মূল্য বেড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ওপর।

জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় সংকটে আছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। অন্যদিকে আয় না বাড়ায় জীবনযাপনের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। মানুষের আয়-রোজগার যখন বাড়ে তখন নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়লেও তা সহনীয় হয়। কিন্তু অনেক মানুষের আয়-রোজগার বাড়েনি। কর্মজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষের অবস্থা বেশি সংকটাপন্ন। গত বছর খারাপ গেছে, এই বছর ভালো যাবে, তারও কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। ভোক্তারা সংগঠিত নয়। আবার তাদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব যাদের হাতে তারাই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ঢাকা মেগাসিটির ব্যক্তি পর্যায়ের ভোক্তারা খাদ্যবহির্ভূত ঝুড়িতে আপেক্ষিকভাবে খানিকটা বেশি ব্যয় করেন, যার মধ্যে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং বিভিন্ন পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে উচ্চ খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সৃষ্টিকারী এই জিনিসগুলোর এক ধরনের টেকসই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী খুব মৌলিক, কম দামের এবং সীমিত খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করে, যার মধ্যে কিছু দামের ক্ষেত্রে মৌসুমি প্রভাব এবং তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল মূল্যের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। কারণ এগুলোর সরবরাহ শক্তিশালী যেমন মোটা চাল ও সস্তা মাছ।

বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো উচিত। সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ক্যাব ও গণমাধ্যমকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আগামী বছরজুড়েও থাকবে। পণ্য সরবরাহ যতদূর সম্ভব স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে যতদূর সম্ভব আমদানিনির্ভরতা কমানো যায়। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে।

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকা ও টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে ক্রমাগত। অন্যদিকে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মান কমে যাচ্ছে। ব্যয়ভারে সংকুচিত হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। একই সঙ্গে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হয়েছে।

শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি ক্যাপটিভ পাওয়ার। সেই ক্যাপটিভ পাওয়ারের দাম এক লাফে ৮৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রতি ঘনমিটার ১৬ টাকার জায়গায় এখন দিতে হবে ৩০ টাকা। এতে পণ্য উৎপাদন খরচ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যাবে। যদিও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সব মিলে পণ্য ও মানুষের চলাচলের খরচ বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর কারণে কৃষি খাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে চলছে।

জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎকে বলা হয় অর্থনীতির লাইফ লাইন, যা অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালনের মতো। সব ধরনের পণ্য ও সেবা এবং মানুষের জীবনযাত্রায় এগুলোর প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ এসব পণ্য ও সেবা ছাড়া বৈশ্বিক বা মানুষের জীবনযাত্রা কল্পনাই করা যায় না। যে কারণে এসব পণ্যের দাম দেশে বা বিদেশে বাড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনায়ও পড়ে।

ভোক্তা পর্যায়ে নতুন করে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর ফলে সব খাতেই উৎপাদন খরচ বাড়বে। এবার গৃহস্থালি থেকে শুরু করে কৃষির সেচ, শিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্রশিল্প, নির্মাণশিল্প, ধর্মীয়, শিক্ষা এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান, পানির পাম্প, ইলেকট্রিক যানের ব্যাটারি চার্জ, মাঝারি, বড়, ভারী শিল্প খাতে গড়ে ৫ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।

এর প্রভাবে কৃষি উৎপাদনে সেচের খরচ বাড়বে। এসব খাতে শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে বাড়বে পণ্যের দাম। বিদ্যুৎচালিত ব্যাটারি চার্জের খরচ বাড়ায় এর ভাড়াও বাড়তে পারে। পানির পাম্পের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে এর দামও বাড়বে।

ডলারের দাম, জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম বাড়ানো ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ ইতোমধ্যেই ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে কৃষিপণ্যের দাম। শিল্পপণ্যের দামও ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এদিকে ভোক্তার আয় কমায় সার্বিকভাবে বিক্রি কমে গেছে।

সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় কৃষিতে সংকট আরও বেশি। একদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সেচের খরচ বাড়বে। বাড়তি দামেও গ্রামে বিদ্যুৎ মিলছে না। ফলে সেচ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ সেচের বড় মৌসুম চলছে এখন। মার্চ পর্যন্ত চলবে। এই সময়ে গ্রামে লোডশেডিংও বেড়েছে। এ ছাড়া সারের তীব্র সংকট তো আছেই। আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষি উপকরণের দাম বেশি হওয়ায় দেশেও এর দাম বেড়েছে। এদিকে ডলার সংকটের কারণে এসব পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে দাম আরও বাড়ছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে পর্যাপ্তভাবে কাভার করার জন্য যথাযথ পরিবীক্ষণের সঙ্গে ওএমএস কার্যক্রম শক্তিশালী করা উচিত। দেশে এক কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা বৃদ্ধি করা উচিত। দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতাও বাড়াতে হবে। এ ছাড়া অস্থায়ীভাবে আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য, খাদ্যবহির্ভূত মৌলিক পণ্য এবং দুস্থ জনগোষ্ঠীর কাছে নগদ টাকা হস্তান্তর কর্মসূচি বাড়ানো উচিত। যেহেতু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় শহুরে জনগোষ্ঠী মূল্যস্ফীতির কারণে বেশি চাপ এবং অসহায়ত্বের সম্মুখীন হয়, তাই সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করার মাধ্যমে শহুরে নিম্নআয়ের মানুষের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ ছাড়া শহুরে নিম্নমধ্যম ও মধ্যম আয়ের পরিবারের জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা স্কিম তৈরি করা উচিত, যাতে তারা সফলভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।

হীরেন পণ্ডিত : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *