হীরেন পন্ডিত
ছাত্রজীবনে অনেক প্রিয় শিক্ষকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। পরে তাঁদের ছাত্র হিসেবে পাঠ গ্রহণ করেছি এবং তাঁদের নিজ নিজ বিদ্যাপীঠের পাঠ শেষ করে বা দরোজা পার করে এগিয়ে চলেছি এবং ছাত্রজীবন শেষ করেছি। এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক গুণী শিক্ষকের সাথে পরিচিত হয়েছি। তাঁদের কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। প্রথম গৃহশিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম আমার বাবাকে তিনি প্রাথমিক স্কুলের পড়া তৈরির জন্য সহযোগিতা করতেন। পরে বড় ভাইদেরও পেয়েছি শিক্ষক হিসেবে উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাসের পড়া তৈরি করার জন্য। প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে আব্দুল মান্নান আকন্দ স্যার, নিখিল দেবনাথ স্যার, প্রফুল্ল দেবনাথ স্যার, কানন বালা দেবী ও মুনীরুজ্জামান স্যারের কথা না বললেই নয়। আমাকে মানুষ বানানোর জন্য প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে তাঁদের সকলের অক্লান্ত পরিশ্রম আজো মনে পড়ে। মানুষ আজো হতে পেরেছি কিনা সেটা এক বিরাট প্রশ্ন! মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন স্যার, রুহুল কুদ্দুস স্যার (নবাব স্যার), সিরাজ স্যার, সাহাবুদ্দিন স্যারের কথা উল্লেখ করতেই হবে তাঁদের কারণেই পরবর্তীতে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম তাঁদের পড়াশোনার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই। আরো অনেক স্যার আছেন যাঁদের কথা এখনো মনে পড়ে। নেত্রকোণা সরকারি কলেজ জীবনে অনেক স্যারের কথা মনে পড়ে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, অর্থনীতির অনুকূল নাথ স্যার, ইংরেজির বদরুজ্জামান স্যার, সাধারণ ইতিহাসের হুসেন আলী স্যার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আরজ আলী স্যারের কথা।
১৯৮৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আমরা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম অত্যন্ত গুণীজনদের। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. ডালেম চন্দ্র বর্মণ, ড. মোস্তফা চৌধুরি, অধ্যাপক সরদার ফজুলল করিম,অধ্যাপক সৈয়দ মকসুদ আলী, অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, অধ্যাপক আব্দুল ওয়াদুদ ভূইয়া, অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক আমিনুর রহমান, অধ্যাপক শরিফুল্লাহ ভূঁইয়া, অধ্যাপক হারুন অর রশীদ, অধ্যাপক শওকত আরা হোসেনসহ আরো অনেকে। যাঁরা অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি ছিলেন তাঁদের সাথে ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছি এখনও তাঁদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনাগুলো কানে বেজে উঠে এবং চোখে ভেসে উঠে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে আমাদের প্রথম ক্লাস নিতেন সরদার ফজলুল করিম স্যার। তিনি আমাদের ওয়েস্টার্ন পলিটিক্যাল থট বিষয়টি পড়াতেন। আমরা স্যার সম্পর্কে খুব একটা খোঁজ-খবর রাখতাম না। পরে যেদিন জানতে পারলাম আমাদের পাঠ্য বই প্লেটোর রিপাবলিক ও এরিস্টটলের পলিটিকস’বইটি তিনি ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন সেদিনই আমাদের সময়ের সক্রেটিস এর সাথে পরিচিত হই। এরপর থেকেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে স্যারের সব ক্লাস শুনেছি এবং স্যারের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা উপভোগ করেছি।
স্যার নিজে সব সময় ছাত্রদের প্রচুর পড়াশোনার কথা বলতেন এবং নিজের প্রতি যতœ নিতে বলতেন। এত বড় একজন মানুষ এত সাধারণভাবে জীবন-যাপন করতেন তা একমাত্র স্যারের পক্ষেই সম্ভব ছিলো। বন্ধু-বান্ধব সবাই বলতো স্যার একজন খাঁটি কমিউনিস্ট ছিলেন। মানুষের মাঝে আলো ছড়ানোর এক মহান দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। তাঁর বিভিন্ন লেখায় অবিভক্ত পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, মতবাদ ও রাজনীতি সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধে, লিখিত বক্তব্যে, সরদার স্যার বিভিন্ন আঙ্গিকে নিরপেক্ষ বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ করেছেন। গ্রিক দার্শনিক ও তাদের মতবাদ নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন ক্লাসিক বইয়ের অনুবাদক ও রচয়িতা ছিলেন তিনি। প্লেটোর সংলাপ, রিপাবলিক, এরিস্টটলের পলিটিক্স, অ্যাঙ্গেলসের অ্যান্টি ডুরিং, রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট, আমি রুশো বলছি, অন্যান্য প্রবন্ধ, নানা কথা ও নানা কথার পরের কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ :আলাপচারিতায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, চল্লিশের দশকের ঢাকা, স্মৃতিসমগ্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সরদার স্যার ছিলেন শিক্ষক, বিপ্লবী, জীবনঘনিষ্ঠ দার্শনিক, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নিরাপদ জীবন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ইস্তফা দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন আত্মগোপনের রাজনীতি, কারাভোগ, অনশন। তৃতীয় মেয়াদে কারামুক্তির পর সরদার স্যার সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থেকে আমৃত্যু রাজনৈতিক বিষয়ে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে তাঁর শ্রেণিকক্ষে, বক্তব্যে, সভা-সেমিনারে রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়। সরদার ফজলুল করিম স্যার মনে করতেন, পুরো জীবনটাই লাভের কোনো কিছুই তার হিসাবে লোকসান নয়। তার স্বপ্ন, আদর্শ আর কর্মের প্রবাহমানতায় নিশ্চিতভাবে আমাদের সমাজ ও প্রজন্ম অগ্রসর হবে আশা আর বিশ্বাসের মৃত্যুঞ্জয়ী অভিযাত্রায়।
সরদার স্যার মনে করতেন মানুষের জীবনকাল থাকে, একটি গ্রন্থেরও তেমনি একটি জীবনকাল থাকে ব্যক্তির জীবনের সঙ্গে গ্রন্থের জীবনের পার্থক্য এই যে ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য হলেও একখানি মূল্যবান গ্রন্থের জীবনকালের বৃদ্ধি বৈ কোন মৃত্যু ঘটেনা”এই উদ্ধৃতির মাধ্যমেই স্যারের শিক্ষার প্রতি যে অনুরাগ ফুটে উঠেছে তা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা এখনো আপনার আদর্শ লালন করি। স্যার আপনি যেখানেই আছেন ভালো থাকবেন।
হীরেন পন্ডিত, প্রাবন্ধিক