যৌন হয়রানি প্রতিরোধ

হীরেন পন্ডিত: সামাজিক অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে বখাটেরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পারিবারিক ও সামাজিক শাসনের অভাবে নারীর যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি ঘটনাটি ঘটে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়। এখানকার পূর্ব ডেঙ্গাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঢুকে শিক্ষার্থীদের সম্মুখেই একজন শিক্ষিকাকে লোহার শাবল দিয়া এলোপাতাড়ি পিটিয়ে আহত করে এক বখাটে। হামলায় তার দুই হাত ভেঙ্গে যায়। এই ঘটনার পর স্কুলটিতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গিয়েছে মারাত্মকভাবে। ক্লাসরুমে শিক্ষকের ওপর এই বর্বরোচিত হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। আমাদের দেশে বখাটেদের নারী উত্ত্যক্ত করার ঘটনা নজরে আসে গত শতকের আশির দশকের দিকে। বর্তমানে এই সামাজিক ব্যাধিটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। স্কুলছাত্রী থেকে শুরু করে তরুণী, এমনকি কর্মজীবী নারীদের রাস্তাঘাটে, এলাকায়, স্কুল-কলেজের সামনে পথ আগলাইয়া ধরে টিটকারী, অশালীন অঙ্গভঙ্গিসহ নানাভাবে উত্ত্যক্ত করছে বখাটেরা। এখন তারা এই কাজে মোবাইল, ফেসবুকসহ নানা প্রযুক্তিরও ব্যবহার করছে। অধিকাংশ সময় এইসব ঘটনার প্রতিবাদ জানালে ফল হয় উল্টো। বখাটেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এলাকার প্রভাবশালীদের সন্তান হওয়ায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করবারও সাহস পায় না। অনেক সময় অভিযোগ করলেও হুমকি কিংবা প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে নীরবে ফিরে আসতে হয় অভিভাবকদের। ফলে অনেক সময় বাধ্য হয়ে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেয় ছাত্রীটি। কখনো কখনো তাকে বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয় বা অপমান-অভিমানে দিতে হয় আত্মাহুতি। কখনো কখনো প্রতিবাদ করতে গিয়ে সে বা তার আত্মীয়-স্বজন হামলার শিকার হয়। দিতে হয় প্রাণও। বাধা না পাওয়ায় বা বিচার না হওয়ায় বখাটেরা এভাবেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে।

নারীদের কেন উত্ত্যক্ত করা হয় এবং কেন ঘটনাটিকে একটি ‘টার্ম’ দিয়ে প্রকাশ করতে হয়। নারীর যৌন হয়রানি বলতে যেমন একটা চিত্র চোখে আসে, কিছু মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে বা কয়েকজন নারী অফিসে বা নিজ নিজ কাজে বাইরে যাচ্ছে আর বখাটে কিছু ছেলে পথে দাঁড়িয়ে দু’টো শব্দ উড়িয়ে দিচ্ছে বা শিস দিচ্ছে। বাস্তবে নারীর যৌন হয়রানি বিষয়টা কিন্তু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা অনেক ব্যাপক এর প্রয়োগ এতই ব্যাপক যে, ‘নারীর যৌন হয়রানি’ শব্দটা পুরো ঘটনা ব্যাখ্যা করার সাপেক্ষে অনেক হালকা একটা শব্দ। একজন নারীকে হেয় করে কিছু বললে সেটাও নারীর যৌন হয়রানি। পুরুষ শিক্ষক নারী শিক্ষার্থীকে তুচ্ছ জ্ঞান করলেন বা কোনো দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখলেন সেটাও নারীর যৌন হয়রানি। বাসে মহিলা সিট খালি নেই বলে একজন নারীকে কন্ডাক্টর বাসেই উঠতে দিলেন না সেটাও নারীর যৌন হয়রানি। এমনকি পরিবারে বাবা ঠাট্টাচ্ছলে মাকে বললেন, ‘মেয়েলোকের বুদ্ধি কম’ এটাও নারীর যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। প্রতিদিনের এ রকম ছোট ছোট অসংখ্য ঘটনা একটি সামাজিক ধারণাতে এনে সমাজকে দাঁড় করায়, তা হচ্ছে একজন মানুষ নারী বলেই তার শক্তি কম, অপরদিকে একজন শুধু পুরুষ বলেই তার শক্তি বেশি। আর সেই শক্তিবলে পুরুষ চাইলেই নারীকে হেয় করতে পারে, তাকে তুচ্ছ করতে পারে, তাকে নিয়ে উপহাস করতে পারে এবং তাকে অবহেলাও করতে পারে। এরই নাম, ‘নারীর যৌন হয়রানি’। কোনদিন উত্ত্যক্তের শিকার হননি এমন নারী পাওয়া বিরল। খুঁজলে এমন পুরুষ পাওয়া যেতে পারে, যারা কখনোই কোন নারীকে ‘নারী বলেই উত্ত্যক্ত করেনি’। তবে কোনদিন নারীর যৌন হয়রানির শিকার হননি, এমনি নারী পাওয়া দুঃসাধ্য। পরিবারের একটা ছেলে যখন শিস দিতে গিয়ে ধরা পড়ে, তখনও সবাই মিলে মেয়েটার পোশাক, চাল-চলন, দিনের কোন সময় বের হয় ইত্যাদি নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত হয়। ফলে ছেলেরা জানেই কাউকে টিজ করা হলে দোষ ভিকটিমের দিকেই যাবে।

নারীর যৌন হয়রানি নিয়ে বাংলাদেশের আইনও খুব শক্তিশালী কিছু না। পেনাল কোড ৫০৯-এ শুধু বলা আছে যে, কোন নারীর শালীনতা ক্ষুণœ করার উদ্দেশ্য, কোন শব্দ উচ্চারণ, আওয়াজ বা অঙ্গভঙ্গি তৈরি বা কোন কিছু প্রদর্শন করে, এটা জেনে যে উক্ত নারী সেই শব্দ, আওয়াজ শুনবেন বা উক্ত নারী সেই অঙ্গভঙ্গি দেখবেন বা তা উক্ত নারীর গোপনীয়তায় আঘাত হানবে, সেক্ষেত্রে তিনি সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদ- অথবা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।

এ ধারার শাস্তি পর্যন্ত যেতে হলে একজন নারীকে অনেক বাধা পার করতে হবে, সমাজ উল্টো তার উপর দায় আনবে, তাকে লজ্জা দেবে, অনেকক্ষেত্রেই এইসব আইনের মারপ্যাঁচে লেগে থাকার মতো শক্তি খরচ করার আগে তাকে অনেক অনেক শক্তি খরচ করতে হবে সামাজিক শৃঙ্খল ছিঁড়তে। এর পরেও যদি ধরে নেয়া হয়, অপরাধীর শাস্তি হবে, তাহলে কে বলতে পারবে, এ সমাজে পরম-শক্তিশালী পুরুষ এক বছর কারাদন্ড ভোগ করে এসে এই নারীর জীবন ধ্বংস করে দেবে না? আসলে এত দূর যেতে হয় না। একজন নারী যখন রুখে দাঁড়ায়, তখন পুরুষের পৌরুষ বাঁচিয়ে রাখতে তার পাশে পুরো সমাজ দাঁড়িয়ে যায়। ফলাফল আট বছরের ধর্ষণের শিকার শিশুকন্যাকে নিয়ে বাবা বিচারের আশা বাদ দিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নারীর যৌন হয়রানি কিভাবে রুখে দেয়া যায়? চেষ্টা করলে এটাও রুখে দেয়া সম্ভব। তবে সম্ভব কাজটা খুব অসম্ভব হয়ে যায়, কারণ, নারী আক্রান্ত হলে, সবচেয়ে বেশি হেরে যায় জন সমর্থন তৈরিতে। দেখা যায়, যখন একজন নারী কোনভাবে হেয় হয়, আরেকজন নারী এসে তার পাশে দাঁড়ায় না। যে নিরাপদে আছে, সে নিজের গা বাঁচিয়ে সরে যায়। এমনকি যে আক্রান্ত হয়, সে-ও সহজে রুখে দাঁড়ায় না, কারণ, বাল্যকাল থেকে সে শিখে এসেছে ‘ভালো মেয়েরা গলার আওয়াজ তোলে না’। এমন বিষয়গুলো পুরুষদের সঙ্গে হয় না। ছেলেদের দলে একটা ছেলে সামান্য আক্রান্ত হলেও দলের সব ছেলে বের হয়ে আসে। রাজপথ থেকে বিদ্যালয়-সবখানেই আছে ‘নারীর যৌন হয়রানি করার লোক’।

যখন একজন নারীকে হেয় করা হয়, পাশের নারীটি যদি গলা তোলেন একজনকে দাবিয়ে রাখা যত সহজ, দশজনকে দাবানো এত সহজ নয়। যখন দশজন নারী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে, নারীর যৌন হয়রানি অনেক কমে যাবে। পরিবার থেকে মেয়েদের যেভাবে শিখানো হয়, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, ছেলেদেরও কি এভাবে শিখানো যায় না? অন্যকে আক্রমণ করা যাবে না? এটা অন্যায়? অবশ্যই যায়, তবে বিচিত্র কারণে পরিবারগুলো এখানে নীরব ভূমিকা পালন করে, যা এই দুষ্ট চক্রকে শুধু শক্তিশালীই করে যায়। পারিবারিক শিক্ষাটা আমাদের ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। যার জন্য আদব-কায়দা আমাদের সমাজ থেকে উঠে যাচ্ছে এর জন্য নারীর যৌন হয়রানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইনগুলোকে আরো শক্তিশালী করা যায়, এগুলো প্রয়োগে আরও কঠোর হওয়া যায়। দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়। যেসব ছেলে এ কাজগুলো করছে, তাদের আলাদা করে কাউন্সেলিং করা যায়। ২০০৯ সালের নারীর প্রতি নিপীড়ন বিষয়ে হাইকোর্টের একটি পূর্ণাঙ্গ রায় রয়েছে, সেটির ব্যবহারও খুব সীমিত। এতে বলা ছিল, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও চাকরি ক্ষেত্রে নারীদের হয়রানির অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য আলাদা সেল খোলা হবে। এর প্রয়োগও নেই বললেই চলে।

পাঠ্যপুস্তকে, গণমাধ্যমে, উপাসনালয়ে, খেলার মাঠে, ঘরে বাবা-মায়েদের মধ্যে এ ধরনের আলোচনা শুরু করা যেতে পারে, যা ছোটবেলায় ছেলেদের বুঝতে শিখাবে, নারীদের উত্ত্যক্ত করা অন্যায়। নারী পুরুষের চেয়ে ছোট নয়, বরং পুরুষেরই সম্পূরক অংশ। না শিখালে ছেলেগুলোই বা শিখবে কোথা থেকে? মানসিকতা বদলানো খুব সহজ কাজ নয়। তবে, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি অনেক উন্নত করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু বিশ্বাস যে, সমাজকে বদলাতে হবে আমাদেরকে এর জন্য প্রয়োজন একটি সামাজিক আন্দোলন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *