হীরেন পন্ডিত
১৮ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ে বা ২১ বছরের কম বয়সী কোন ছেলে যদি বিয়ে করে, তখন তাকে বাল্য বিবাহ বলে, ধরে নেয় হতো। কিন্তু ২৭ ফেব্রæয়ারি ২০১৭, বিশেষ বিবেচনায়, এই বিয়ের বয়স ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে কিছুটা কম করে বিধান করে বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল ২০১৭ সংসদে পাশ হয়েছে। প্রথমে এই বিশেষ বিধান মেয়েদের বেলায় কার্যকর রাখার প্রস্তাব করা হলেও পরে এই বিশেষ বিবেচনায় ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য করে এই বিলটি পাশ করা হয়। আইনের ১৯ দফায় বলা হয়েছে, এই আইনের অন্যান্য বিধান যাই থাকুক না কেন, কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোন নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশক্রমে এবং মাতা-পিতার সম্মতিতে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিয়ে সম্পাদিত হলে, তা এই আইনের অধীন অপরাধ বলে গণ্য হবেনা।
ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারেজ রিস্ট্রেইন্ট এক্ট-১৯২৯’ বাতিল করে নতুন আইনটি সংসদে পাশ করা হয়। এই আইনের কারণে দেশে বাল্যবিবাহের প্রকোপ বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সকলে। এই ধারাটি বাতিলের দাবি করেছিলেন দেশি-বিদেশী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। কিন্তু সে দাবিকে পাশ কাটিয়ে আইনটি পাশ করা হয়েছে। এই আইনে ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ অভিভাবক ও আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে ১৮ বছরের চেয়ে কম বয়সী মেয়েদেরও বিয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিয়ের ন্যূনতম কোনও বয়স নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি।
শিশুদের বিয়ের আইনি বৈধতা দেয়ায় যে ক্ষতি হবে, তা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার দিকেই এখন মনোযোগী হতে হবে সবাইকে। সতর্কতার সাথে কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারলে এই আইনের ফলে মেয়েদের যে ক্ষতি হবে তার পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের চেয়ে কম বয়সী ও ২০৪১ সালের মধ্যে ১৮ বছরের চেয়ে কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে শতভাগ বন্ধের প্রতিশ্রæতি দিয়েছে সরকার। ১৮ বছরের চেয়ে কম বয়সী মেয়েদের ‘বিশেষ পরিস্থিতি’তে বিয়ের আইনি বৈধতা দেয়ার পেছনে সরকার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, অবিবাহিত মেয়েদের ‘দুর্ঘটনাবশত বা অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণের’ বিষয়টিকে। তবে অবিবাহিত কিশোরীদের গর্ভধারণ রোধে তথ্যের অবাধ প্রবাহ বা প্রজনন বিষয়ক সেবার জন্য সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমাদের বিশ^াস।
তবে এ বিষয়ে কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে, যে নীতিমালায় ১৮ বছরের চেয়ে কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের অনুমতি দেয়ার বিশেষ পরিস্থিতিগুলোর ব্যাখ্যা থাকবে যা এমন বিয়ের আবেদনের ক্ষেত্রে তা বিচারের মাপকাঠি হিসেবে পরিগণিত হবে। এছাড়া, বাল্যবিবাহ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইনে কোন পরিস্থিতিতেই ১৬ বছরের চেয়ে কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়াকে অনুমোদন না দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ওই আইনকে মেনে বাংলাদেশেও ১৬ বছরের চেয়ে কম বয়সী মেয়েদের বিয়েতে সম্পূর্ণভাবে নিষেধাজ্ঞা জারী করা যেতে পারে।
আসুন আমরা দেখি বাল্য বিবাহের বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে। কি কি কারণে বাবা-মা তাদের সন্তানকে বাল্য বিবাহ দিতে বাধ্য হন, সে বিষয়গুলো একটু দেখি। আমাদের দেশে মেয়ে একটু বড় হয়ে উঠলে অনেক খারাপ লোকের চোখ তার উপর পড়ে, এজন্য নিরাপত্তার অভাবে বাবা-মা তাদের মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিতে উৎসাহী হন। অনেক গরিব বাবা-মা আছেন, যাদের কয়েকটি মেয়ে থাকলে দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ১৩-১৪ বছর বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। অনেকের ধারণা কম বয়সী মেয়ের বিয়েতে যৌতুক কম লাগে, তাই অনেক বাবা-মা বাল্যবিবাহে আগ্রহী হয়ে উঠেন। আমাদের দেশে গ্রামের অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত বাবা-মা মনে করেন যে মেয়েদের মাসিক পিরিয়ড হওয়া মানেই তাদের বিয়ের বয়স বা সময় হয়েছে, তাই তাদের মেয়েদের বিয়ে দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। আমাদের গ্রাম কিংবা শহরে বয়স্ক দাদা-দাদি, নানা-নানীরা সাধ-আহ্লাদ মেটানোর জন্য তাদের নাতি-নাতনিকে অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে মৃত্যুর পূর্বে তাদের বিয়ে দেখে যেতে চান, তাই বাল্য বিবাহ থেকে আমরা বের হতে পারছিনা।
আমাদের দেশের মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ বা উপযুক্ত পরিবেশ খুব কম এবং অনেক বাবা-মা বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের বাবা মায়েরা মেয়েকে লেখা-পড়া করাতে চান না। তখন তাদের আর ঘরে বসিয়ে না রেখে বিয়ে দিয়ে দেন। ফলে বাল্যবিবাহ কমানো যাচ্ছেনা।
বাল্যবিবাহের অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে, যেমন স্ত্রীর শরীর ভেঙ্গে যাওয়া, স্ত্রী অল্প বয়সে সন্তান ধারণ করে মা ‘কুড়িতেই বুড়ি’ হয়ে যাওয়া ও শিশুর মৃত্যু ঝুঁকিও থাকে। অপুষ্ট ও রুগ্ন শিশুর জন্ম হয়, শিশু মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হয়, মায়ের উপর শারীরিক ও মানসিক চাপ পড়ে, প্রসবকালে স্ত্রীর মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়, সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হয়। মানসিক অপরিপক্কতার কারণে অল্পবয়সী মেয়েরা শ্বশুরবাড়ির নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনা এর কারণে তালাকের প্রবণতা বাড়ে। এছাড়া আরও অনেক সামাজিক সমস্যাতো রয়েছে। তাছাড়া অল্পবয়সী নারী পুরুষের পক্ষে সংসারের দায়-দায়িত্ব নেয়া কষ্টকর হয়, স্ত্রী এবং সংসারের প্রতি অবহেলা দেখা দেয়, দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয় স্বামীর মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় ইত্যাদি।
দারিদ্র্যের কারণে বাংলাদেশের নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিঘিœত হয়, ফলে আমাদের দেশে মেয়েদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ। বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সে শতকরা ৩৯ ভাগ নারীর বিয়ে হয়ে যায়। এই বিবাহিত কিশোরীদের ৭৫ ভাগ ১৯ বছর বয়সে মা হয়ে যায় (সূত্র প্রগ্রেস ফর চিলড্রেন-২০১১, ইউনিসেফ)। বাল্যবিবাহের জন্য উচ্চ প্রজনন হার এবং কিশোরী মাতৃমৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। বাল্যবিবাহের কারণে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যায়। দারিদ্রপীড়িত বাংলাদেশের শতকরা ৪৫ ভাগ নারী সংগত কারণে অপুষ্টির শিকার হয় এবং কম ওজনের শিশু জন্ম দেয়। ফলে শিশু মৃত্যুর হার ও মোট প্রজননের হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। কম ওজনের শিশু সংবলিত উচ্চ প্রজননের কারণে এসকল শিশুদের পূর্ণ মানসিক শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, যার নেতিবাচক প্রভাব ভবিষ্যত কর্মজীবনে তারা নিজের তথা দেশের স্বাবাভিক উৎপাদনশীলতায় অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়। ফলশ্রæতিতে তারা নিজেরা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয় এবং দেশের প্রবৃদ্ধি হয় বাধাগ্রস্ত।
বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতা সৃষ্টি সবচেয়ে জরুরী মনে করছেন সকলে। অপ্রাপ্ত বয়সে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিলে তা কল্যাণের পরিবর্তে স্থায়ী ক্ষতি করা হয়-এই সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরী। বাল্য বিবাহে মেয়েদের যে অনেক সমস্যা ও অসুবিধা হয়, তা বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশী ও অন্যরা জানলে তারা আর অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দেবেন না, এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা একান্ত জরুরী। রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নতুন আইনে বিশেষ বিধান রাখা হলে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই এ বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার রয়েছে। প্রশাসন এবং সাংসদেরা নিজ নিজ এলাকায় বাল্যবিবাহ বন্ধ করার ওপর কথা বলছেন। অনেক এলাকায় বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন এবং এলাকার জনগণের প্রচেষ্টায় বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে আগামীতে যে বাল্যবিবাহ কমবে তা সহজেই বলা যায়।
হীরেন পন্ডিত