কবি নির্মলেন্দু গুণের সামাজিক দায়বদ্ধতা

হীরেন পণ্ডিত :: কবি, সাহিত্যিক, বা দার্শনিক বা যেই হোন না কেন মানুষের সামাজিক অবস্থান তাঁর চেতনাকে নির্ধারণ করে। স্বাভাবিকভাবে শিল্পী, কবি-সাহিত্যিকরা যা কিছু করেন তাতে সামাজিক অবস্থানের চিত্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিল্প শিল্পের জন্য, আনন্দ আর অনুভবের জন্য কোনভাবেই শিল্পী বা কবির সামাজিক দায়ের বিষয়টিকে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হয়নি। কবিতায় রাজনীতিই প্রথম আর একজন সচেতন কবির কবিতায় সেই রাজনীতি হয়ে ওঠে বিপুল মানুষের চিন্তা আর কল্পনা বিকাশে সহায়ক শক্তি হিসেবে। কারণ সমাজে কবির অবস্থানটাই তার চেতনাকে আবদ্ধ করে রাখে যদিও তিনি একজন অগ্রসর মানুষ।

নির্মলেন্দু গুণ বাংলাদেশের পাঠকনন্দিত কবি, তাঁর অসংখ্য কবিতা মানুষের মুখে মুখে। নেত্রকোণার বারহাট্টায় জন্ম ২১ জুন ১৯৪৫ সালে, সে হিসেবে তিনি এখন ৭৬তম বসন্ত অতিক্রম করছেন। মা বীণাপাণি দেবী ও বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ। কবি এবং চিত্রশিল্পের পাশাপাশি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন। তাঁর লেখায় মূলত প্রেম, শ্রেণী-সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে তিনি কাজ করেছেন সারা জীবন।

১৯৯১ সালে কবির এমপি হবার ইচ্ছা হয়। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন। কিন্তু তিনি দমে যাবার পাত্র নন। স্বতন্ত্র হিসেবেই নির্বাচন করলেন কুমির প্রতীক নিয়ে। কিন্তু, নির্বাচনে তিনি জয়ের মুখ দেখলেন না। ভাগ্য ভালো বাংলা সাহিত্য ও বাংলা কবিতার। যদি তিনি এমপি হয়ে যেতেন তাহলে আইন প্রণয়নের ব্যস্ততার কারণে হয়তো কবিতা লেখার হয়তো খুব একটা সময় পেতেন না।

সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে নির্মলেন্দু গুণ নেত্রকোণার বারহাট্টায় তাঁর নিজ গ্রামের বাড়িতে কাঁশবন বিদ্যানিকেতন স্থাপন করেছেন এবং নেত্রকোণা জেলা শহরে কবিতাকুঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য। শৈলজা সংগীত বিদ্যালয় নামে সংগীত শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান করেছেন। পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। সামাজিক কাজের অংশ হিসেবে। কবিতাকুঞ্জে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিদের বই সংগ্রহ করেছেন। কাব্যামোদীরা কবিতা নিয়ে গবেষণা করতে পারছেন। বর্তমানে এখানে বিভিন্ন ভাষার ১ হাজার ৫০০ কবির কবিতার বই সংগ্রহ করা হয়েছে। শুধু কবিতাকে ঘিরে এক অনন্য আয়োজন রয়েছে এখানে। কবিতা লেখার পাশাপাশি এই কাজগুলোকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেন কবি।

কবি নির্মলেন্দু গুণকে সম্পূর্ণ জানতে হলে যেতে হবে কাঁশবন, কবির গাঁয়ে। গ্রামে ঢুকতেই হাতির-সংবর্ধনা, কবির প্রতিষ্ঠিত স্কুল, প্রবেশমুখে স্যার আইজাক নিউটন ও কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্য আপনাদের অভ্যর্থনা জানাবেন, মূল বাড়ি যেন অন্য এক জগত-ঢুকতেই শহীদ মিনার, পাশে উন্মুক্ত মঞ্চ, লাইব্রেরি। চিত্রশালা অজপাড়াগাঁয় শিশুরা ছবি আঁকে ভেবে অবাক হতে পারেন এছাড়াও রয়েছে কবিগুরু ও মধুকবির ভাস্কর্য।

কেউ কাঁশবনে গিয়ে ভাবতে পারেন, হাতিরপুল বাজারে ফুটপাথের চা খাওয়ার ছবি দেখে যাঁরা পুলকিত, তাঁরা কি সবাই বিশ্বাস করবেন কবি নির্মলেন্দু গুণ এত কিছু করতে পারেন, এটাই কবির সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ।

মা, মাটি, মাতৃভূমিকে ভালোবাসেন নিজের চেয়েও বেশি। তিনি দেশপ্রেমের যে-দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সত্যিই বিরল। ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িত ছিলেন তিনি; এরপর বাদ পড়েনি স্বাধীনতার পূর্বের ও পরের কোনো বিপর্যয়, যতবার এ রাষ্ট্র বিপথগামী হয়েছে-কলম ধরেছেন তিনি, লিখেছেন একের পর এক শ্রেণীসংগ্রাম এবং স্বৈরাচার-বিরোধী কবিতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে যে-ক’জন কবি ও লেখক সোচ্চার হয়েছেন, তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য।

অথচ এই কবিকে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের জন্য অনেকের কাছে ধর্না দিতে হয়েছে, কিন্তু কেউ রাজি হননি। আসল সত্য হলো তখন আধুনিক কবিতার বইয়ের বাজার একদম কম ছিলো। কিন্তু পরে খান ব্রাদার্স নিজ থেকে প্রকাশ করতে আগ্রহী হওয়ায় তিনি খুশি হন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। উল্লেখ্য, নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা ‘নতুন কান্ডারী’।

তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় শতাধিক তার মধ্যে অন্যতম ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’, ‘কবিতা, অমীমাংসিত রমণী’, ‘দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’, ‘দূর হ দুঃশাসন’, ‘চিরকালের বাঁশি’, ‘দুঃখ করো না, বাঁচো’, ‘আনন্দ উদ্যান’, ‘পঞ্চাশ সহস বর্ষ’, ‘প্রিয় নারী হারানো কবিতা’, ইত্যাদি।

‘আপন দলের মানুষ’ শিরোনামে রয়েছে তার একটি গল্পগ্রন্থ। এ ছাড়া লিখেছেন ‘সোনার কুঠার’ নামের একটি ছড়াগ্রন্থ। ‘আমার ছেলেবেলা’, ‘আমার কণ্ঠস্বর’ ও ‘আত্মকথা-৭১’ শিরোনামে রয়েছে তিনটি আত্মজীবনী।

কবিতার জন্য নিজের ইচ্ছাধীন এক জীবন কাটান তিনি। কবিতা বা শিল্প কার জন্য, মানুষের জন্য শিল্প নাকি শিল্পের জন্য শিল্প, শিল্প আগে না জীবন আগে? শিল্পের জন্য মানুষের জীবন বিসর্জন দেওয়া লোভের প্রকাশ। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে।
কবিতা ও অমরত্বের বাসনা থেকেই লেখা তাও তাঁর সরল উক্তি থেকে আমরা পাই। নশ্বর জীবনকে একটা অবিনশ্বর রূপ দেওয়ার প্রয়াস সব সময়েই থাকে। জীবনের মূল তাড়না এটাই। মানুষ সামাজিক কর্ম, জনহিতকর যত কাজ করে, সবই তার গ্রহণযোগ্যতাকে বৃদ্ধির মানসেই করে।

পরাধীন চিত্ত নিয়ে বড় হওয়ার চেয়ে স্বাধীন চিত্ত নিয়ে ছোট থাকাটাকেই বেশি পছন্দ করেন কবি। কবি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতা ছিল তাঁর পরম আকাঙিক্ষত বিষয়। আদতে তিনি স্বাধীনতাকামী। স্বাধীনতা তাঁর আরাধ্য। তিনি জন্মের প্রয়োজনে বড় হয়েছেন, আবার মৃত্যুর প্রয়োজনে ছোট হচ্ছেন। আরো অনেক কিছু যে দেয়ার আছে আপনার, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে।

কবির অনেক জনপ্রিয় কবিতা সময়কে অতিক্রম করেছে এবং বেঁচে থাকবে অনাদিকাল মানুষের মাঝে, মানুষ আবৃত্তি করবে এবং পড়বে তাঁর কবিতা। ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন।

স্কুল জীবন বারহাট্টায়, কলেজ জীবন ময়মনসিংহের আনন্দমোহনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী বিভাগে চান্স পেয়েও লিস্ট থেকে বাদ দেয়ার কারণে ভর্তি হতে পারেন নি। পরে আবার বুয়েটে চান্স পেয়েছিলেন কিন্তু পড়া হয়ে উঠেনি। কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *