প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এখনো উপেক্ষিত

প্রজনন স্বাস্থ্য মূলত সামগ্রিক স্বাস্থ্যেরই একটি অংশ। বর্তমানে প্রজনন স্বাস্থ্য শুধু মাতৃস্বাস্থ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। একটি শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও পৌঢ়ত্ব প্রতিটি স্তরেই প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়টি জড়িত অর্থাৎ শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের সব নারী-পুরুষই প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার আওতাভুক্ত। প্রজনন স্বাস্থ্য হলো পরিপূর্ণ দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণকর একটি অবস্থা, যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে ১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা উন্নয়ন সম্মেলনে প্রজনন স্বাস্থ্যের সংজ্ঞাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা হলো- ‘প্রজনন স্বাস্থ্য শুধু প্রজননতন্ত্রের কার্যক্রম এবং প্রজনন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত রোগ বা অসুস্থতার অনুপস্থিতিকেই বোঝায় না, এটি শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণকর এক সুস্থ অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পাদনের একটি অবস্থা।’

প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকারের একটি অংশ। প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নারীর মর্যাদা ও উন্নয়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। ১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্য ও উন্নয়ন সম্মেলন’ এবং ১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত ‘চতুর্থ নারী সম্মেলনে’ নারীর ক্ষমতায়নকে প্রথমবারের মতো উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং পরিবার পরিকল্পনার অধিকারকে উন্নত প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ‘আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন’র একটি বড় সাফল্য হলো প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য অধিকারগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করা। প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার চর্চার লক্ষ্যে অর্থাৎ প্রজনন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমন : বিভিন্ন পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বেছে নেওয়া, সন্তান সংখ্যা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে নারীর অধিকার সমুন্নত রাখা, গোপনীয়তার অধিকার, প্রাপ্তসেবা সম্পর্কিত অনুলিপি পাওয়া এবং অধিকার রক্ষিত না হলে প্রতিকার পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৩-এর আলোকে স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন নীতি ও কৌশল প্রণয়নের বিষয়টির ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তথ্য জানানোর প্রয়াসে সরকার সেবাগ্রহীতার অধিকার সনদ ও সিটিজেনস চার্টার প্রণয়ন করেছেন এবং এর ওপর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তা ছাড়া স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন নীতি ও কৌশলেও তথ্য জানানোর বিষয়টি উঠে এসেছে। জনগণের স্বাস্থ্য অধিকার এবং প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘সেবাগ্রহীতার অধিকার সনদ’ প্রণয়ন করে। এ সনদে বিভিন্ন পর্যায়ের সেবাকেন্দ্রে যেসব সেবা পাওয়া যায় সে সম্পর্কে সেবাগ্রহীতাদের তথ্য জানার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ২০০৮ সালে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে জনগণের সেবাপ্রাপ্তি বিষয়ে সিটিজেনস চার্টার’ প্রণয়ন করা হয়। এই চার্টারের মাধ্যমে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে জনগণ কী ধরনের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সেবা পেতে পারে, সে বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্যবিষয়ক যেসব নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করেছে তা হলো- স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি, বাংলাদেশ জনসংখ্যা নীতি, এইচআইভি/এইডসবিষয়ক জাতীয় কর্মকৌশল, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য কর্মকৌশল, দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্র ইত্যাদি। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য যেকোনো সেবাপ্রাপ্তির মূল বাধাই হচ্ছে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব। প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব এখনো রয়েছে। প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রবাহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্য জনগণকে তাদের ‘স্বাস্থ্য অধিকার (প্রজনন)’ পুরোপুরি চর্চা করতে সাহায্য করবে। প্রজনন স্বাস্থ্য কী? প্রজনন স্বাস্থ্যের সুরক্ষা কেন জরুরি? কীভাবে প্রজনন স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হয়? প্রজনন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যায় সেবা নিতে কোথায় যেতে হবে? কী পরিমাণ খরচ হবে ইত্যাদি তথ্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। একজন দরিদ্র নারী যখন প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাবে, তখন সে নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার তাগিদ অনুভব করবে। এভাবে সচেতনতা বাড়বে। একটি নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জনগণ কী কী সেবা পেতে পারে তার বিস্তারিত তালিকা জনগণের সেবাপ্রাপ্তির পথ সুগম করবে। প্রান্তিক অবস্থানে থাকা কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সেবা পাওয়ার পথ সহজ হবে। সেবাগ্রহীতা তার অধিকার সম্পর্কে জানলে সে তার অধিকার পুরোপুরি চর্চা করতে সক্ষম হবে।

উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসমূহে অনেক সময় ওষুধ কম কেনা হয়, প্রয়োজনের সময় ওষুধ পাওয়া যায় না। জনগণের কাছে একটি নির্দিষ্ট সেন্টারের প্রতি মাস ও দিনের ওষুধ বরাদ্দের পরিমাণ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য থাকলে তাদের পক্ষে এসব সমস্যার কারণ উদ্ঘাটন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। নির্দিষ্ট সেন্টারে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের নাম, পদবি, ডিউটির সময় উল্লেখ থাকলে জনগণ তা জানতে পারবে, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে যেতে পারবে। তা ছাড়া দাপ্তরিক কাজ বাদ দিয়ে যেসব চিকিৎসক ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সময় ব্যয় করেন, তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ প্রতিবাদী হতে পারবেন। প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কিত কী কী তথ্য জানার অধিকার রয়েছে?

নারী ও কিশোরীদের নিরাপদ মাতৃত্ব এবং প্রজননতন্ত্রের সুস্থতা একটি অধিকার, বিশেষত নারী ও কিশোরীদের জন্য। সেজন্য তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য জানার অধিকার রয়েছে। সেগুলো হলো নিরাপদ মাতৃত্ব কী বা এর জন্য করণীয় সম্পর্কিত তথ্য; গর্ভকালীন বিপদগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা, যাতে তারা গর্ভকালীন বিপদ বা জটিলতাগুলো নিজেরাই শনাক্ত করতে পারেন এবং যথাসময়ে সেবাকেন্দ্রে সাহায্যের জন্য যেতে পারেন; গর্ভধারণজনিতে জটিলতা থেকে সৃষ্ট রোগ বা মাতৃত্বজনিত অসুস্থতা এবং এসব রোগ বা বিপদ থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কিত তথ্য; যৌনবাহিত রোগ ও রোগের লক্ষণ সম্পর্কিত তথ্য পেতে পারে।

ক্রমবর্ধমান জন্যসংখ্যা বর্তমানে বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। দেশের অপরিকল্পিত জনসংখ্যা রোধে পরিবার পরিকল্পনা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তা ছাড়া পারিবারিক সচ্ছলতা ও সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্যও পরিকল্পিত পরিবার গঠন অত্যাবশ্যক, যা পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে করা সম্ভব। পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে একজন নারী, পুরুষ ও সক্ষম দম্পতি তাদের প্রজনন এবং যৌন অধিকারসমূহ চর্চা করতে পারে। যেমন : অনাকাক্সিক্ষত গর্ভরোধকরণে, জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করবে তা নির্ধারণে, কাক্সিক্ষত সময়ে গর্ভধারণে, নিজের পছন্দমতো জন্মবিরতি গ্রহণে, মা-বাবার বয়স অনুয়ায়ী সন্তান এবং পরিবারে কয়টি সন্তান নিতে চায় তা নিরূপণে; পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি (স্থায়ী এবং অস্থায়ী) সম্পর্কে জানার অধিকার যেমন নারীর রয়েছে, তেমনি এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বা সুবিধা সম্পর্কে ও সঠিক তথ্য জানার অধিকার তাদের রয়েছে। কোথায় গেলে পছন্দমাফিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারবেন এ ব্যাপারে ও তথ্য জানার অধিকার রয়েছে। আমাদের দেশের বয়োসন্ধিকালীন জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের প্রজনন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগে থাকে। বিশেষ করে কিশোরীরা বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে মা হওয়ার ঝুঁকি এবং এ থেকে সৃষ্ট প্রজনন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ঝুঁকির শিকার। তা ছাড়া অল্প বয়সে মা হওয়ার ফলে বাংলাদেশের কিশোরী মা এবং নবজাতকের মৃত্যু জাতীয় পর্যায়ে মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্যুর হারের চেয়ে অনেক বেশি।

দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ অনেক সময় কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া তাদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারও ঘাটতি রয়েছে। প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে সহজলভ্য হলে। বিশেষভাবে বাল্যবিবাহ ও কিশোরী মাতৃত্ব এবং এর থেকে সৃষ্ট সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। কোথায় গেলে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যাবে তা জানার অধিকার নারীর রয়েছে। তা ছাড়া সেবাকেন্দ্রগুলোতে কী কী ধরনের চিকিৎসা পাওয়া যায়, কোনটি সেবামূল্য কেমন, কখন বা কোন সময় নির্ধারিত সেবা পাওয়া যাবে, কী কী ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে, সেগুলোর মূল্য কত, কখন করা যাবে ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য জানার পূর্ণ অধিকার নারীর রয়েছে। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডপর্যায়ে কার কাছে গেলে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যাবে, সেসব তথ্য জানার অধিকার ও এর অন্তর্ভুক্ত। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা থাকা উচিত। যেমন : গর্ভকালীন পরিচর্যা, প্রসব ও প্রসবোত্তর পরিচর্যা ইত্যাদি যেহেতু ধারাবাহিক বিষয় সেহেতু এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসার ধারাবাহিকতাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ধারাবাহিক চিকিৎসা বা ফলোআপ কী তা আমাদের জানার অধিকার রয়েছে। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আসার পর চিকিৎসক যে ওষুধ-পথ্যাদি দিলেন সেগুলো ব্যবহার করার পর রোগীর অবস্থা কেমন হলো অথবা রোগীর অন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কি না- এসব তথ্য ও চিকিৎসক ওই রোগীকে প্রদান সহায়তা ও পরামর্শ দেবে। একেই নিরাপদ ও ধারাবাহিক সেবা পাওয়ার অধিকার বলা হয়। প্রজনন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সেবাগ্রহণের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি রক্ষার প্রয়োজন। এ-সংক্রান্ত পরামর্শ বা চেকআপের সময় এই প্রাইভেসি বা গোপনীয়তা সেবাগ্রহীতার অধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু অনেক সময়ই সেই পরিবেশ তারা পান না। পাশাপাশি প্রজনন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত চিকিৎসার সব লিপিবদ্ধ তথ্য, গোপনীয়তা বজায় রাখতে চাওয়াটাও সেবাগ্রহীতার অধিকার। সেসব লিপিবদ্ধ তথ্য হস্তান্তর করার প্রয়োজন হলে অবশ্যই ওই সেবাগ্রহীতার অনুমতি নিতে হবে। এসবই ‘প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে গোপনীয়তার অধিকার’-এর অন্তর্ভুক্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *