তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়


হীরেন পণ্ডিত
বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকের কারণে ১.৬১ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং তামাকের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ কত, এ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের এক গবেষণার ফলাফল বেশ উদ্বেগজনক। গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক ব্যবহারকারীদের ফুসফুস, স্বরযন্ত্র ও মুখে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অব্যবহারকারীদের তুলনায় ১০৯ শতাংশ বেশি। তাদের স্ট্রোক, হৃদরোগ, যক্ষ্মাসহ সাতটি রোগের ঝুঁকি অব্যবহারকারীদের তুলনায় ৫৭ শতাংশ বেশি।

তামাক মহামারি বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য বিষয়ক হুমকিগুলোর মধ্যে একটি, যা সারা বিশ্বে বছরে আট মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। সাত মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মৃত্যু সরাসরি তামাক সেবনের ফলে এবং প্রায় ১.২ মিলিয়ন মৃত্যু পরোক্ষ ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসার ফলে। সব ধরনের তামাকই ক্ষতিকর এবং তামাকের সংস্পর্শের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। সিগারেট বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের সবচেয়ে সাধারণ রূপ।

ধূমপানে আসক্ত নারীদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি পুরুষের তুলনায় বেশি থাকে। বিশেষ করে অন্ত্রে ও মলাশয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি পুরুষের তুলনায় ধূমপায়ী নারীদের বেশি। এমনকি ধূমপায়ী নারীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও পুরুষের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশসহ বিশ্বে ধূমপায়ী নারীদের মৃত্যুঝুঁকিও বেড়েছে অনেক বেশি।

গবেষণা থেকে জানা যায়, উচ্চবিত্ত ঘরের নারীরা ফ্যাশন বা চাকচিক্যের মোহে পড়ে ধূমপানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাঁরা ধূমপান ছাড়াও অন্যান্য মাদক গ্রহণ করেন। মধ্যবিত্ত ঘরের নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে ধূমপানে কম আসক্ত হন। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী নারীরা অনিচ্ছাকৃতভাবেই ধূমপানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের উন্মুক্ত স্থানে ধূমপায়ী নারীর সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বস্তিসহ ঘনবসতিপূর্ণ স্বল্প আয়ের মানুষ বসবাসকারী এলাকাগুলোতেও অসংখ্য নারী প্রকাশ্যে ও গোপনে ধূমপান করছেন। বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, নামিদামি রেস্তোরাঁসহ অবকাশ যাপনকেন্দ্রগুলোতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত ও ছিন্নমূল নারীদের ধূমপানের চিত্র এখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।

এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে দেশে নারী স্বাস্থ্য ক্রমেই ধ্বংসের মুখে পড়বে, মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে নারী-পুরুষ সবাইকে সচেতন করতে হবে। তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট আইন করে তা মানতে বাধ্য করতে হবে। বাজারের বিক্রীত ইলেকট্রনিক সিগারেটসহ সব ধরনের তামাকজাতীয় পণ্য যত্রতত্র বিক্রির ব্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপ করতে হবে। আর এ বিষয়ে পরিবার থেকে রাষ্ট্র সবাইকে এর কুফল সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

ধূমপান কোনো ভালো কাজ নয়, তবু যুগ যুগ ধরে পুরুষরা ধূমপান করে আসছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নারীরা কেন ধূমপান করেন? তাঁদের ধূমপান করার পেছনের কারণ কী? এখন নারীরাও প্রকাশ্যে ধূমপান করেন। কিন্তু কেন ধূমপান করেন নারীরা এই বিষয় নিয়ে এখন পর্যন্ত অনেক দেশের নামিদামি গবেষকরা গবেষণা করেছেন। কানাডার হেলথ কানাডা স্মোকিং প্রিভেনশন সেন্টার ও আমেরিকার আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির নানা ধরনের গবেষণায় উঠে এসেছে এমন কিছু বিষয়, যার কারণে বিশ্বজুড়ে বহু নারী ধূমপান করে থাকেন। এদিকে আধুনিক তরুণীরা এখন ধোঁয়াবিহীন ব্যাটারিচালিত ইলেকট্রনিক সিগারেট তথা ই-সিগারেটের প্রতিও আসক্ত হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে বিষাক্ত তামাক সেবনের বদলে আসক্তরা বাষ্পে পরিণত হওয়া তরল নিকোটিন গ্রহণ করে। এটি ‘ভ্যাপিং’ নামেও পরিচিত। এর ফলে মস্তিষ্কে ধূমপানের মতো অনুভূতি তৈরি হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই পদ্ধতিতে নিকোটিন সেবনও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এর মধ্যে রয়েছে জীবাণুনাশক ফরমালডিহাইড, যাতে ক্যান্সার তৈরির উপাদান রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায়, বিশেষ করে তরুণদের ধূমপানে নিরুৎসাহ করতে বিদ্যমান তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫-কে সংশোধন করে বিক্রয়স্থলে তামাকজাতদ্রব্য প্রদর্শনসহ সব ধরনের বিজ্ঞাপন সুনির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা। আমাদের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ ছাড়া সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে মানুষের জীবনের অধিকার রক্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)’-এ স্বাক্ষর করেছে এবং সে অনুযায়ী একটি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-এর লক্ষ্যমাত্রা ৩-এ এফসিটিসি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে তামাক অর্থনীতির জন্যও বড় একটা বোঝা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং অন্যান্য ফসলের উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি।

তামাকের বহুবিধ ক্ষয়ক্ষতি উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে এফসিটিসির সঙ্গে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সংশোধন করার তাগিদ দিয়েছেন। এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং জনগণকে সচেতন করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *