বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে


হীরেন পণ্ডিত
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এমনকি ভারতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হলেও বাংলাদেশে প্রযুক্তির এই সর্বশেষ সংস্করণের ব্যবহারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করেন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সবাই আরো এগিয়ে আসতে হবে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচকতা সম্পর্কে সাবধান থেকে দেশের সর্বক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে তা কাজে লাগানো প্রয়োজন বলেও মনে করছেন সবাই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শঙ্কা কাটিয়ে এর সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে ‘সবার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিবাচক ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি প্রয়োজন। এ জন্য সকল পর্যায়ের অংশীজনদের সক্রিয় ভ‚মিকা প্রয়োজন।’
নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের হোম ডেলিভারি, কোভিড-১৯ ও সাধারণ স্বাস্থ্য পরামর্শের জন্য টেলিমেডিসিনসেবা, ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম, ভিডিও কনফারেন্স, অনলাইন প্রশিক্ষণ, দূর-শিক্ষণকার্যক্রম, ভিডিও স্ট্রিমিং ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাখাত ও আবাসিক ব্যবহারকারীদের জন্য পারস্পরিক সংযুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ কারণে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ এর চাহিদা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আগামী বছরগুলোতে যে কোন মহামারি প্রতিরোধে সংযোগ চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে। প্রচলিত প্রযুক্তির পরিবর্তে উচ্চগতির ফাইবার অপটিক-ভিত্তিক কানেকটিভিটি বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে টেলিমেডিসিন সেবা, দূরশিক্ষণ, অনলাইন প্রশিক্ষণ, মহামারী আক্রান্ত এলাকা নির্ধারণ, সামাজিক সুরক্ষা প্রাপ্তির তালিকা তৈরি প্রভৃতি খাতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও বিগডাটা প্রয়োগ বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়াও ই-কমার্স, আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং, ভিডিও স্ট্রিমিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বর্ধিত চাহিদা পূরণকরতে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এর ধারণ ক্ষমতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ৫-জি নেটওয়ার্ক এখন সময়ের দাবি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যে ৫-জি প্রযুক্তি চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ৫জি এর জন্য টেলিকম কর্মকর্তাদের দক্ষ ও সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তিত জীবন ব্যবস্থার মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অগ্রগামী হতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকতে বাংলাদেশের প্রযুক্তি পরিবেশে সহায়ক অবকাঠামো-কারিগরি প্রস্তুতিতে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার এবং সিস্টেমস থাকতে হবে। ২০০০ সাল পর্যন্ত আমরা মেশিন লার্নিং ডেভেলপ করেছি সিপিইউ দিয়ে তা চালানো হয়েছে। কিন্তু এখন গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট বা জিপিইউ-তে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নত জিপিইউ নিশ্চিত করা গেলে মেশিন লার্নিংয়ে বেশি সক্ষমতা আসবে।
গুগল, ফেসবুকের আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের দক্ষতার পেছনের কারণ হলো ফেস ডিটেকশনে ভালো ফেসবুক, স্প্যাম ইমেজ ডিটেকশনে ভালো গুগল। এই ডিটেকশন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এই ডিটেকশনের জন্য যোগ্য করতে প্রয়োজন হাজার হাজার ছবি, অর্থাৎ হাজার হাজার ডেটা। যেহেতু গুগল এবং ফেসবুকের ব্যবহারকারী বিশ্বজুড়ে রয়েছে, তাই তাদের ডেটার সংখ্যা বেশি। সেজন্য তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতাও বেশি।
বাংলাদেশের তরুণরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে কৌতুহলী, এই কৌতুহলী তরুণদের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দেশের অগ্রগতির জন্য ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ। কিন্তু কৃষি কাজ এখনো প্রকৃতি নির্ভর, কীটনাশক প্রদান সনাতন পদ্ধতিতে চলছে। যেখানে ফসলের রোগবালাই, মাটির অবস্থা, আবহাওয়া নির্ণয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র ২৫-৩০ হাজার। এখাতে অবশ্যই আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। তাছাড়া শিল্পখাতের সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভরযোগ্য উপায় হতে পারে।
প্রায় সবখাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং অতিমাত্রায় মেশিন-রোবট নির্ভরতা মানুষের বেকারত্বের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এই বৈশ্বিক উৎকণ্ঠাকে স্বীকার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিবাচক ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছেন মোবাইলফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের কায়িক শ্রম কমিয়ে জ্ঞানভিত্তিক শ্রমের উপায় হিসেবে দেখেন অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় গুরুত্ব দিচ্ছে। পুরো বিশ্বের ব্যবসায়িক নামকরা প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে স্বল্প পরিসরে কাজ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বেকারত্বের ভয়ে বাংলাদেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে পিছিয়ে গেলে পুরো বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়তে পারে। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষে শারীরিক শ্রম দেয়া শ্রমিকের সংখ্যা কমার সম্ভাবনা রয়েছে ঠিক তেমনি জ্ঞানভিত্তিক শ্রমের ক্ষেত্রও প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ এমন একটা প্রযুক্তি অনেকটাই আমাদের অজান্তে সবাইকে ঘিরে ফেলছে, সেটা হচ্ছে এক কথায় বললে বলা যেতে পারে ‘প্রযুক্তি’কে শেখানো হচ্ছে একদম মানুষের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে। মানুষের দরকারে। যেমন, হেলথকেয়ার সিস্টেমে রোগীদের ঠিকমতো স্বাস্থ্যসেবা দেবার জন্য, মানুষের ভুল কমানোর জন্য। পাশাপাশি কোন স্পেসিফিক ট্রিটমেন্টটা তাদের কাজে লাগছে – সেই ঔষুধ রোগীর উপর ব্যবহার না করে সিমুলেশনে ‘ড্রাগ ডিসকাভারি’তে ব্যবহার হচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
আজকে ‘কোভিড-১৯’ এর টিকা ও ঔষধ তৈরির পেছনে এই প্রযুক্তির সাপোর্ট কারো অজানা নয়। সেটা না হলে এর জন্য সময় লাগতো আরো অনেক বেশি। মহামারী নিয়ন্ত্রণে অনেক দেশই ব্যবহার করছে এই প্রযুক্তি। উন্নত দেশের সরকারগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে আরবান প্ল্যানিং, মাস ট্রানজিট সিস্টেম, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, বন্যার আর্লি ডিটেকশন, সরকারি রিসোর্সের সঠিক ডিস্ট্রিবিউশন এবং ব্যবহার, সামনের বছরগুলোতে পেনশনারদের কতো টাকা দিতে হতে পারে ক্রাইম প্রেডিকশন, শহর জুড়ে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট এর কাজ করছে। এরকম হাজারো জিনিসে ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
ওয়ার গেমিং এ এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীতে এই প্রযুক্তির ব্যবহারের একটা ধারণা এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ‘তৃতীয় অফসেট স্ট্রাটেজি’ হিসেবে। ২০১৮ সালে পেন্টাগন ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে। ব্যাপারটা এমন যে আমরা হয়তোবা আন্দাজ করতে পারছিনা কিভাবে ঘটছে – তবে আমাদের আশেপাশের সবকিছুই পাল্টে যাচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে।
আমরা চাই বা না চাই -কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়টি ঢুকে গেছে সবকিছুর ভেতরে। যেভাবে আমরা দেখেছি- হেলথকেয়ার থেকে শুরু করে সরকারি কাজ, ট্রান্সপোর্টেশন ইন্ডাস্ট্রি – শিক্ষা – যারা যা করতে চাইছেন তার সবকিছু সহজ করে দিচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এটা ঠিক যে, অনেক বড় একটা ক্ষমতা আসছে মানুষের হাতে- সেটা বুঝতে পারছে খুব কম মানুষই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শুরুতে যেখানে মেশিনকে শেখাতে হয় -সেখানেই দরকার মেশিন লার্নিং। অন্য কথায় বললে – কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে অংশে যন্ত্রকে বুদ্ধিমত্তা দেবার প্রসেসই মেশিন লার্নিং। পৃথিবীতে ’এআই’ ফর সোশ্যাল গুড’ নিয়ে একটা বিশাল মুভমেন্ট চলছে ডেটাকে মানুষের কাজে ব্যবহারে মাধ্যমে। মেশিন লার্নিং ব্যাপারটা জেনে রাখা ভালো কারণ এর ব্যবহার চলে আসছে প্রতিটা সেক্টরে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটা বর্তমান এবং ভবিষ্যত স্কিলসেট। আমাদের আশেপাশের পশুপাখি থেকে মাঝে মাঝে বেশ কিছু ‘বুদ্ধিমত্তা’র আচরণ পাই। ব্যাপারটা এমন যে -যেহেতু সেই পশুপাখিটা মানুষের স্কেলে অর্থাৎ মানুষের মতো করে কোন জিনিসকে অনুসরণ করছে, সে কারণে আমরা তাকে বুদ্ধিমান প্রাণী বলছি। জিনিসটা এরকম যে সে মানুষের মতো করে আচরণ করছে, কিন্তু সে যদি তার মত করে কোন কাজ কওে সেটা তার স্কেলে বুদ্ধিমান বলা যেতে পারে। কোন কিছুর মধ্যে যে বুদ্ধিমত্তা আছে সেটা তার কাজের আউটকাম অথবা তার ব্যবহারে সেটা ফুটে উঠে। তবে এই বুদ্ধিমত্তা যেখান থেকে বের হচ্ছে সেটার উৎপত্তিস্থল আমাদের বা পশুপাখিদের মাথায়। আমাদের মাথায় এই বুদ্ধিমত্তাগুলো কিভাবে তৈরি হচ্ছে অথবা এর কাজ করার প্রসেসগুলো আমরা যেহেতু সরাসরি দেখতে পারছি না, সে কারণে এই বুদ্ধিমত্তা কিভাবে কাজ করছে সেটার ব্যাপারে আমরা এখনো অনেক কিছুই জানি না। আমরা জানি, মাথার নিউরনের ভিতর ইলেকট্রনিক পালস্ দিয়ে ব্যাপারগুলো ঘটে তবে এর’ ইন্টারনাল’ বিষয়গুলো আমাদের কাছে এখনো অজানা।
অনেক কথাই হচ্ছে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। কিন্তু এই বুদ্ধিমত্তা কার এর সহজ উত্তর, মানুষের। যন্ত্রে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কম্পিউটার দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা। আমাদের সবার পরিচিত রোবট যেমন প্রাণী বা মানুষ আদলে বানানো যন্ত্র যা কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। মানুষ যেভাবে কাজ করে ঠিক সেই ভাবেই কাজ করতে পারে। এই যন্ত্রগুলোর মানুষের মতো উন্নত চিন্তা বা অনুভূতির সংবেদন তৈরি ও প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট কম্পিউটারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট যা প্রোগ্রাম দেওয়া হয় এর বাইরে সে যেতে পারে না। একইভাবে মানুষের মতো সে অনুমান ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্তেও আসতে পারে না। বিজ্ঞানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শাখায় রোবটকে আরও কীভাবে মানব মস্তিষ্কের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায় এসব নিয়েই গবেষণা চলছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট মানুষের পাশেই থাকবে
রোবট হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত এক ধরনের ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল যন্ত্র যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা কোন ব্যক্তির নির্দেশে কাজ করতে পারে। এটি তৈরী হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতিতে যা কম্পিউটার প্রোগ্রাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। রোবট মানুষ কিংবা বিভিন্ন বুদ্ধিমান প্রাণীর মতো কাজ করতে পারে। এটি মানুষ ও মেশিন উভয় কর্তৃক পরিচালিত কিংবা দূর নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। রোবটের আকৃতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যে রোবট দেখতে মানুষের মত তাকে বলা হয় হিউমেনওয়েড। হ্যাকিং অব হিউম্যান ব্রেইন।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জন্য ল্যাবরেটরিতে বানানো হচ্ছে কৃত্রিম সাইন্যাপস। এটি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কোষ। এর মাধ্যমে একটি নিউরোন থেকে অন্য নিউরোনে রাসায়নিক বা বৈদ্যুতিক তথ্য যায়। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির দাবি, তারা আর্টিফিশিয়াল সাইন্যাপস তৈরিতে সফল হয়েছে। এখন আরও উচ্চতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
যদি তারা সফলভাবে আর্টিফিশিয়াল সাইন্যাপস প্রতিস্থাপন করতে পারে তাহলে মানুষের মতো উন্নত চিন্তা, সংবেদন ও সেই পরিপূরক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়ে উঠবে রোবটগুলো। এমনকি এই রোবটগুলো মানব মস্তিষ্ককে হ্যাকও করতে পারবে। যা বড় ধরনের নৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় ঘটাবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। এই সোসাইটির নতুন গবেষণা ও এর সাফল্য নিয়ে এর মধ্যেই শোরগোল পড়ে গেছে সব শাখার বিজ্ঞানীদের মধ্যে। তাদের বক্তব্য, সবকিছুরই ক্রিয়া ও বিপরীত প্রক্রিয়া রয়েছে। আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কী চাই এবং এর বিনিময়ে কী হারাবো। বাংলাদেশে কোথাও কোথাও রোবটের ব্যবহার শুরু হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়। তবে কি একদিন আমাদের পোশাক কারখানাগুলোতেও সারি সারি নারী-পুরুষের জায়গায় দেখব কয়েকটি করে রোবট? রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার পরিবেশন করছে রোবট? ছোট ছোট দোকানগুলো আর নেই; কেনাকাটা চলছে বিশাল কয়েকটি বিপণিবিতানে, যেখানে বিক্রয়কর্মী মানুষ নয়, রোবট?
মানব কল্যাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক কথায় বললে সবই এখন স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দখলে। অর্থাৎ সুই-সুতো বানানোর কারখানা থেকে হেল্পলাইনের ভয়েস, সবক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবট। রোবট শব্দটির উৎপত্তি চেক শব্দ ‘রোবোটা’ থেকে, এর অর্থ ফোরসড্ লেবার বা মানুষের দাসত্ব কিংবা একঘেয়েমি খাটুনি বা পরিশ্রম করতে পারে এমন যন্ত্র। বলাই বাহুল্য, সেটি রোবট দারুণভাবেই করে চলেছে।
মঙ্গল গ্রহ থেকে মার্স রোভারের নিয়মিত তথ্য পাঠানো, সমুদ্রগভীরে গিয়ে গবেষণা, কারখানায় ১শ জনের কাজ একাই কওে দেওয়া অক্লান্ত কর্মী, ঝাড়ু-মোছা কিংবা শয়নকক্ষে সবই এখন রোবট সামলাচ্ছে নিপুণভাবে। বিনিময়ে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।
গুগলের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি ‘ডিপমাইন্ড’ যৌথভাবে কাজ করছে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সঙ্গে। তারা একটি সফটওয়্যার তৈরি করছে যেটি লক্ষণ দেখে ক্যানসার নির্ণয় ও চোখের রোগ আরও নিখুতভাবে ধরতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি হার্টেও রোগ ও আলঝেইমারের উপসর্গ ও অবস্থা বলে দেবে অন্য আরেকটি সফটওয়্যার। গেøাবাল শিপিং ও ই-কমার্স লেনদেনের মতো জটিল বিষয়গুলোও রোবট সামলাচ্ছে বিশ্বস্ততার সঙ্গে। খুব বেশিদিন দূরে নেই, যেদিন যানবাহন চালনা, শেয়ার মার্কেটের দেখভাল, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, হিসাব সামলানোর মতো জটিল-সময়সাপেক্ষ কাজগুলোও পুরোপুরি চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে।
সারা বিশ্বের কারখানাগুলো চলে যাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দখলে। একেকটি মেশিন কম সময়, খরচ ও নিপুণতার সঙ্গে শতাধিক মানুষের কাজ করছে। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তে পাওে বেকারত্ব, সেখান থেকে অভাব-হতাশা-নৈরাজ্য। ধীরে ধীরে মানুষের কাজের জায়গাগুলো নিয়ে নিচ্ছে রোবট। এর মধ্যে দক্ষ মানুষের প্রয়োজন বাগবে অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা আশার বাণীও দেখছেন এতে।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটেনে শ্রমিকদের একটা গোষ্ঠী কাপড় বোনার যন্ত্র ভাঙচুর শুরু করে। কারণ, তারা মনে ভেবেছিল, এসব যন্ত্র ব্যবহৃত হলে তাঁত শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়বে। নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি মানুষের কাজ নিয়ে নেবে কি না, এই প্রশ্ন কিন্তু বেশ পুরোনো। শ্রমের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবৃত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে ইদানীং গবেষণা হচ্ছে। এ বছর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি ও সংস্থা কিছু গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যদিও তারা কেউ বলছে না যে আগামীকাল বা আগামী বছরই রোবটরা সবার চাকরি নিয়ে নেবে, তবু বিষয়টি সারা বিশ্বে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
গব পেশার প্রায় ৫ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণভাবে রোবটের মাধ্যমে করা যাবে। ৬০ শতাংশ পেশার অন্তত ৩০ শতাংশ কাজে রোবট ব্যবহার সম্ভব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির ব্যবহার বেশি সম্ভব শিল্প, পরিবহন ও গুদামজাতকরণ, পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় ইত্যাদি খাতে । সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হবে জাপান, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। এ সম্ভাবনা কবে নাগাদ বাস্তবে পরিণত হতে পারে, সে বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না। কোনো কোনো প্রতিবেদনে আগামী তিন-চার দশকের কথা বলা হয়েছে। কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে বলা যায়, কিছু চাকরি বিলুপ্ত হবে, কিছু নতুন ধরনের চাকরি সৃষ্টি হবে। সার্বিক প্রভাব ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে তা বলা কঠিন। তবে অশিক্ষিত ও তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষিত ব্যক্তিরা এই প্রক্রিয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। উচ্চশিক্ষিত ও বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিতরা ভালো অবস্থানে থাকবেন। নতুন প্রযুক্তির ফল যেন স্বল্প কিছু লোক বা শ্রেণির মধ্যে সীমিত না থাকে তা নিশ্চিত করতে এবং নেতিবাচক ফলগুলো যথাসম্ভব কমাতে সরকারি নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান কমেনি, বরং বেড়েছে। মন্দার সময়গুলো বাদে সে দেশে কিন্তু চাকরির সংখ্যা কমেনি। একধরনের প্রযুক্তি মানুষের শ্রমের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। আবার এমন প্রযুক্তি আছে, যেগুলো শ্রমের পরিপূরক বা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সহায়ক। যেকোনো সময় দুই ধরনের প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হতে পারে। কর্মসংস্থানে তার চূড়ান্ত ফল কী হবে তা নির্ভর করবে এই দুই শক্তির কোনটি বেশি প্রভাবশালী তার ওপর।
১০-১৫ বছর আগেও আমাদের অনেকের মুঠোফোন ছিল না; এখন এই ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এর উৎপাদন, বিক্রি ও রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যেসব চাকরি জড়িত, তার কথা কি আমরা দুই দশক আগে ভাবতে পারতাম? অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ব্যবহারের তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য ও সেবা; তাদের উৎপাদনের মাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।
কোভিড-১৯ শুরুর পরবর্তী সময় থেকে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন পৃথিবীর স্বাস্থ্যযোদ্ধারা। মূলত তাদের কষ্ট লাঘব করতেই হ্যানসন রোবটিক্স নিয়ে এসেছে গ্রেসকে। করোনার প্রাদুর্ভাবে সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকি এড়াতে যারা দীর্ঘদিন ধরে বাসাবন্দি ছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে গ্রেস। তাছাড়া বুকে ফিটকৃত থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে রোগীর শরীরের তাপমাত্রা মাপা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সালের শুরুর দিকেই চীন, জাপান, হংকং, কোরিয়া ও থাইল্যান্ড এ ধরনের রোবট উৎপাদন শুরু করবে পুরোদমে। গ্রেস ও সোফিয়াকে বাসাবাড়ির পরিষেবাদানকারীর ভূমিকায় তৈরি করা হলেও এজাতীয় বুদ্ধিমান রোবটকে অফিস-আদালত, হোটেল রেস্টুরেন্ট ও শেয়ার মার্কেটে ক্লায়েন্ট কিংবা ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যেখানে লোকসানের কোনো সুযোগই থাকবে না। তাছাড়া বিমানের পাইলট হিসেবে, দূরপাল্লার গাড়ি ড্রাইভিংয়ে, ভারী ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রমিকের ভূমিকায়, বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপনে, বিপণিবিতান ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের মতো নিখুঁত কাজেও ব্যবহার করা যাবে এদের। পুলিশের স্পেশাল গোয়েন্দা ফোর্সেও তাদের অবদান হবে অতুলনীয়।
অর্থনৈতিকভাবে রোবটের ব্যবহার যদি যৌক্তিক হয় তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা কিছু ইতিবাচক ফল দিতে পারে। তবে সঙ্গে সঙ্গে কিছু চিন্তার বিষয় এবং চ্যালেঞ্জও থাকবে। সেগুলো মোকাবিলা করতে পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন হবে ।
যখন দেশের সব উদ্বৃত্ত শ্রম শেষ হবে এবং শ্রমিকের সরবরাহে ভাটা পড়বে, তখন এই প্রযুক্তি অবশ্যই কাজে আসবে। কিছু কাজ রোবটের মাধ্যমে করানো হবে, পাশাপাশি কিছু নতুন কাজের সুযোগ ও প্রয়োজন সৃষ্টি হবে। বিভিন্ন খাতে উৎপাদনক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়বে, ফলে পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা থাকবে। তার ফলে ভোক্তা উপকৃত হবেন। তাঁদের চাহিদা বাড়তে পারে; চাহিদা বাড়লে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে। তবে বলা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট মানুষের পাশেই থাকবে সব কাজে।
সাংবাদিকতায় ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
প্রথমে কয়েকটি অন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং সংবাদ সংস্থা খেলাধুলা, আবহাওয়া, শেয়ারবাজারের গতিবিধি এবং করপোরেট পারফরম্যান্সের মতো খবরাখবর তৈরির ভার কম্পিউটারের হাতে ছেড়ে দেয়। এরপর যথার্থতা ও ব্যাপকতার বিচারে মেশিন, কিছু ক্ষেত্রে ভালো কাজ করেছে। অনেক সাংবাদিক যেসব ক্ষেত্রে প্রায়ই একটি মাত্র উৎসের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করেন, সেখানে সফটওয়্যার বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য খুঁজে এনে, সেই তথ্যের ধরন ও প্রবণতা বুঝে, প্রসেসিং ব্যবহার কওে সেই প্রবণতাকে প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে মিলিয়ে বিশ্লেষণ, উপাধি ও রূপকসহ আধুনিক বাক্য গঠন করতে পেরেছে। রোবট এখন প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ একটি ফুটবল ম্যাচে গ্যালারি ভরা দর্শকের আবেগ নিয়ে প্রাণবন্ত রিপোর্ট করতে সক্ষম।
এ কারণে অনেকে মনে করেন, এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একদিন অনেকের চাকরির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তবে, এআইকে আলিঙ্গন করে, ক্রমশ জটিল, বৈশ্বিক এবং তথ্য-ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠা এই বিশ্বকে আরো ভালোভাবে কভার করার ক্ষেত্রে, এটি তাদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে। রিপোর্টিং, সৃজনশীলতা এবং পাঠক টানার ক্ষমতায় বাড়তি শক্তি জোগাতে পারে বুদ্ধিমান মেশিন। আর এই ক্ষমতা অভাবনীয় গতিতে কনটেন্ট তৈরি, সাজানো এবং বাছাইয়ে সহায়তা করতে পারে সাংবাদিকদের। এআই যেমন সহজে তথ্যেও ট্রেন্ড শনাক্ত করে, তেমনি লাখ লাখ ডেটা থেকে চিহ্নিত করতে পারে ঠিক আসল জায়গাটিকে। গণিত এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানে, সুনির্দিষ্ট কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য সসীম সংখ্যক অনুক্রমিক নির্দেশের সেটকে অ্যালগরিদম বলা হয়। সেই অ্যালগরিদম সংশ্লিষ্ট তথ্যের সঙ্গে সরকারি হিসাব মিলিয়ে দেখতে পারে, তাহলে যে-কোনো দেশের সাংবাদিকই সরকারি ক্রয়ে কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে সে সম্পর্কে অনেক সূত্র পেতে পারবেন। অ্যালগরিদম এভাবেই জন্ম দিতে পারে দুর্দান্ত একটি স্কুপ।
বুদ্ধিমান কম্পিউটার যে শুধু প্রচুর ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে, তা নয়। এটি অনেক মানুষের ভিড় থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং তার সত্যতাও যাচাই করতে পরে। মার্কিন বেশ কয়েকটি মিডিয়া আউটলেট ইতিমধ্যেই এআইয়ের মাধ্যমে ফ্যাক্ট চেক বা সত্যতা যাচাই করছে। যেমন, রয়টার্স। সামাজিক মাধ্যমে ব্রেকিং নিউজ ট্র্যাক করতে এবং টুইটের সত্যতা যাচাই করতে তারা নিউজ ট্রেসার ব্যবহার করছে। ব্রাজিলের সংসদ সদস্যরা খরচের বিপরীতে পাওনা দাবি করে কত টাকা তুলে নিচ্ছেন, তা ট্র্যাক করা হয় একটি রোবটের মাধ্যমে। কোন খরচ সন্দেহজনক এবং কেন, এমন বিষয়ও তুলে আনছে রোবট।
অ্যালগরিদম সাংবাদিকদের কাজে আসে ভিডিওর রাফ-কাট, কণ্ঠ এবং ভিড় থেকে মানুষের চেহারা শনাক্ত করার জন্য। একইভাবে পাঠকদের সঙ্গে আলাপ বা তাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্যও প্রাগাম চ্যাটবট ব্যবহার করা যায়। এই প্রক্রিয়াটি ডেটাকে প্রশ্ন করতে পারে, তাই রিপোর্টার এবং সম্পাদকদের দ্রæত জানতে হবে এই সিস্টেমগুলো কীভাবে চলে এবং এদেরকে সাংবাদিকতার মান বাড়ানোয় কীভাবে কাজে লাগানো যাবে।
সাংবাদিক ও প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলা খুব সহজ নয়। উভয় পক্ষেরই একে অপর থেকে শেখা প্রয়োজন। চলমান প্রযুক্তিগত উনয়নের কারণে সাংবাদিকদের হাতে এখন এমন অনেক উপকরণ এসেছে, যা দিয়ে তাঁরা ক্ষমতাধরদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে সক্ষম। আর বাড়তে থাকা এই ক্ষমতাকে ঠিকমতো ব্যবহার না করার মানে সুযোগের বড় ধরনের অপচয়।
সাংবাদিকতার পরিধি বাড়াতে গিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করার সময় ভেবে দেখতে হবে, আপনার নৈতিকতার মানদÐের সঙ্গে সেটি কতটা খাপ খায়। সাংবাদিকদের সতর্ক থাকতে হবে, কারণ অ্যালগরিদম মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকরও হতে পারে। কারণ তারা মানুষের তৈরি প্রাগ্রাম, আর মানুষের মধ্যে পক্ষপাত আছে। অনেক সময় লজিক্যাল প্যাটার্নও ভুল উপসংহারে পৌঁছাতে পারে। এর মানে, সাংবাদিকদেরকে সব সময় এআই থেকে আসা ফলাফল পরীক্ষা করে দেখতে হবে সন্দেহ করা, ক্রস চেক এবং এক নথির সঙ্গে আরেকটি মেলানোর মতো শতাব্দী-পুরোনো যাচাই-কৌশলের মাধ্যমে। প্রযুক্তির উন্নয়ন, ক্ষমতাকে জবাবদিহির আওতায় আনার ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা দিয়েছে সাংবাদিকদের। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, অনেকসময় অ্যালগরিদমেরও পক্ষপাত থাকে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই নতুন যুগে সাংবাদিকতার জন্য আরেকটি আবশ্যক জায়গা হলো স্বচ্ছতা। বার্তাকক্ষে এআই ব্যবহারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা, স্বচ্ছতা। এটি সাংবাদিকতার সেই মৌলিক মূল্যবোধ, যার সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিরোধ আছে, কারণ এআই সাধারণত কাজ করে পর্দার আড়াল থেকে। এরপরেই আছে বিশ্বাসযোগ্যতা। যদিও শক্তিশালী প্রযুক্তির কল্যাণে এখন পাঠকের চাহিদা নিখুঁতভাবে জানা যাচ্ছে, তারপরও বিশ্বাসযোগ্যতার স্বার্থে গণমাধ্যমকে জানাতে হবে, তারা গ্রাহকের কোন ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করছে আর কোনটি করছে না। কারণ এখনো সংবাদ মাধ্যমের ব্যবসা এবং এর বেঁচে থাকার চাবিকাঠি হলো জনস্বার্থ।
বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য যারা গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে, তাদের চেয়ে আলাদা হবার একমাত্র উপায় এটাই। তদুপরি, ভালো সাংবাদিকতার কাজই হলো চাপা পড়ে যাওয়া সেইসব কণ্ঠস্বর এবং অজানা বিষয়কে সামনে নিয়ে আসা। শেষ পর্যন্ত, এআই সাংবাদিকতার সক্ষমতা বাড়াচ্ছে এটা যেমন সত্য, তেমনি মানুষকে জানা এবং তাদের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রশ্নে এটি নতুন চ্যালেঞ্জ জন্ম দিচ্ছে। সাংবাদিকসুলভ স্পষ্টতা না থাকলে এই প্রযুক্তি দিয়ে তথ্যনির্ভর সমাজ গড়া অধরাই থেকে যাবে। এই বুদ্ধিমান প্রযুক্তি সাংবাদিকতার জন্য সমস্যা হতে পারে, যদি তার ব্যবহারে নৈতিকতা না থাকে। ডেটাকে প্রতিবেদনে রূপান্তরিত করতে ওয়ার্ডস্মিথ নামের প্রযুক্তি এবং নির্বাচনী রিপোর্টিং-এর জন্য প্রযুক্তি হেলিওগ্রাফ ব্যবহার করা যায়। ব্রেকিং নিউজ ট্র্যাকিং, ট্যাগ এবং লিংক ব্যবহার করে খবর সংগ্রহ ও সাজানো, মন্তব্যগুলো মডারেট করা এবং কণ্ঠ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুলিপি তৈরি করা। হালনাগাদ এবং ঐতিহাসিক ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রভাবিত করতে পারে এমন বিষয় শনাক্ত করা এবং দর্শকদের যুক্ত করা।
চ্যাটবট অ্যাপ্লিকেশনটি তার ব্যবহারকারীদেরকে ঘটনা, ব্যক্তি, বা স্থান সম্পর্কে প্রশ্ন পাঠানোর সুযোগ দেয় এবং সেটি প্রাসঙ্গিক কনটেন্টসহ জবাবও পাঠায় প্রশ্নকর্তাকে। অনেকেই ফেসবুক মেসেঞ্জারের জন্য বট ব্যবহার করে। আবার সংবাদ প্রদান এবং মেসেজিং প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে পাঠকদের সঙ্গে আরো কার্যকরভাবে যুক্ত হওয়ার’ সুযোগ করে দিতে একটি ওপেন সোর্স নিউজবট তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে যাচাই হয়ে যাওয়া দাবি চিহ্নিত করতে এবং ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং ও সুবিন্যস্ত ডেটা ব্যবহার করে যেসব দাবি এখনো যাচাই হয়নি সেগুলো শনাক্ত ও যাচাই করবে।
তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে কোনো পরিবর্তন, প্যাটার্ন বা অস্বাভাবিকতা অনুসন্ধান করে সফটওয়্যার। ক্রাইম প্যাটার্ন রিকগনিশন দলিলপত্রের বড় ডেটাবেস থেকে কোনো নির্দিষ্ট ধরনের দুর্নীতির তথ্য এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মধ্যকার সংযোগও বিশ্লেষণ করতে পারে।
অনেকে গুগলের প্রযুক্তি ছবি থেকে বস্তুু, এলাকা, মানুষের মুখ, এমনকি অনুভূতিকেও শনাক্ত করতে পারে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে খবর থেকে স্ক্রিপ্ট এবং ফুটেজ থেকে ছোট ছোট টুকরো কেটে ধারাবর্ণনাসহ ভিডিওর রাফ-কাট তৈরি করার জন্য উইববিটজ সফটওয়্যার এবং একটি স্বয়ংক্রিয় ভিডিও সম্পাদনা টুল তৈরি করা হচ্ছে। বলাই যায় সাংবাদিকতায় সহায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
লেখক: রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *