সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে


সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের সাবেক কর্মীর ফাঁস করা তথ্য দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের নিরাপত্তার বদলে ব্যবসায়িক স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েছে। এ ছাড়াও গ্রাহকদের প্রতি ফেসবুকের আন্তরিকতার অভাব, নীতিমালার ব্যত্যয়, প্রতিশ্রæতি আর বাস্তবিক কর্মকাÐে ব্যাপক অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। এ ছাড়া মুনাফা ধরে রাখতে সংস্থাটি শিশু ও কিশোর বয়সিদের মানসিক স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করে। এহেন পরিস্থিতিতে যথাযথ প্রমাণ পাওয়া গেলে ফেসবুকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের তথ্য কমিশনার এলিজাবেথ ডেনহ্যাম।
যদিও এর আগে অভিযোগগুলো পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন ফেসবুক প্রধান মার্ক জাকারবার্গ। ডেনহাম ‘যুক্তরাজ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে তার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা হবে ক্ষতিকর প্রভাবগুলো কী যুক্তরাজ্যের ওপরও পড়ছে, বিশেষ করে শিশুদের ওপর?’ বলা হচ্ছে ফেসবুকের মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রাম সেবা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে এবং সামাজিক বিভক্তি বাড়িয়ে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে ফেসবুকের অ্যালগরিদম।
ফেসবুকের করপোরেট নাম এখন ‘মেটা’। নাম পরিবর্তনে কি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা পাবে? কিংবা পীরগঞ্জের পূজামÐপ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুরের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দোকানপাট বাড়িঘর কি রক্ষা পাবে? মার্ক জাকারবার্গ কি জানেন- বাংলাদেশে কত কিছু হয়েছে, কত মানুষ গৃহহীন হয়েছে; সেই সাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কত নিরপরাধ মানুষ জেল খাটছে? পৃথিবীকে মার্ক জাকারবার্গ দু’টি ভাগে ভাগ করেছেন। একটি ভার্চুয়াল, আরেকটি বাস্তব। এক সময় পৃথিবী দু’ভাগে বিভক্ত ছিলো- শোষক ও শোষিত। এখন ভার্চুয়ালের অলীক আর বাস্তবের নিষ্ঠুর পৃথিবী।
ফেসবুক নিয়ে অনেক কথা উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে নানা অভিযোগ। একটি বড় অভিযোগ-ফেসবুক গণতন্ত্রবিরোধী। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নগুলো বিভ্রান্ত করে দিতে পারে; মানুষের বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানতে পারে; মানুষে-মানুষে সম্পর্ককে জটিল করে দিতে পারে। এই জটিলতা যে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে তা অনুমান করা শক্ত। ফেসবুকের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, ইচ্ছে করলেই যে কোনো নামে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। কোথায় এই অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, তা জানা কঠিন।
একটি ফেসবুক আইডি থেকে ভুল বার্তা প্রকাশ করে স্বার্থান্বেষী মহল উস্কানি দেয় প্রথমে তাতে সায় দিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্য সফল করে। এভাবে রংপুর, পাবনা, সুনামগঞ্জ, নাসিরনগর হয়ে উঠে উঠে ধ্বংসলীলার সাক্ষী। প্রতিবারই গুজব সৃষ্টিকারীরা নতুন কিছু সংযোজন করে। ফলে তিল মুহূর্তেই তাল হয়ে যায়। মানুষ সত্যকে যাচাই করার জন্য কালক্ষেপণ করে না। ফেসবুকের সত্য কখনও কখনও কারও কারও কাছে নিরেট সত্য বলেই মনে হয়।
এ কথা ঠিক, প্রযুক্তির উন্নয়ন কোনো অবস্থাতেই থামিয়ে রাখা যাবে না। গত কয়েক দশকে পৃথিবীতে এক বিশাল প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটেছে। তা ঠেকিয়ে রাখার উপায় কারও নেই। এবার কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের সময় দেখা গেল মানুষের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গবেষণার পরিমাণ কত কম, কত অল্প খরচ করা হচ্ছে। আবার এই কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছে; তাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের গ্রাস করছে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস এবং মূর্খ প্রজন্ম হিসেবে গড়ে না তোলে। আসল কথা হচ্ছে আমাদের দৃষ্টির অজান্তেই যে অলীক পৃথিবী গড়ে উঠছে যা একটা কল্যাণকর সমাজ নির্মাণের পরিপন্থি বলেই মনে হয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের ৮৬ শতাংশ তরুণ কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকে ইন্টারনেটে আরও বেশি সময় কাটাচ্ছে। এরমধ্যে ৩৫ শতাংশ তরুণ জানায়, তারা সারাক্ষণই ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এছাড়া ১৫ শতাংশ প্রধানত সন্ধ্যায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং কেবল ২ শতাংশ শুধু স্কুল চলাকালে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশের ৮ শতাংশ তরুণ সপ্তাহে অন্তত এক বা একাধিকবার অনলাইন বুলিংয়ের শিকার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মেসেজিং অ্যাপস এবং অনলাইন গেমিং ও ভিডিও গেম স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম এই তিনটি মাধ্যমে সাধারণত তরুণরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছে।
সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনলাইনে নিরাপদ রাখতে কাজ করতে হবে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন এবং তাদের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিতে হবে। এজন্য তাদের অনলাইনে নিরাপদ রাখতে আমাদের আরও দৃঢ় সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ও প্রতিশ্রæতি নিতে হবে। অনলাইনে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানার প্রয়োজনীয়তাও আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সচেতনতা, অনলাইন বুলিং সম্পর্কে প্রশিক্ষণ এবং ডিজিটাল রেজিলিয়েন্স তৈরি এসব বিষয় সম্পর্কে সব অংশীজনদের কাজ করা প্রয়োজন। এটি শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ছেড়ে দেয়া উচিত নয়, বরং অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *