হীরেন পণ্ডিত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এমনকি ভারতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হলেও বাংলাদেশে প্রযুক্তির এই সর্বশেষ সংস্করণের ব্যবহারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করেন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সবাই আরো এগিয়ে আসতে হবে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচকতা সম্পর্কে সাবধান থেকে দেশের সর্বক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে তা কাজে লাগানো প্রয়োজন বলেও মনে করছেন সবাই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শঙ্কা কাটিয়ে এর সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে ‘সবার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিবাচক ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি প্রয়োজন। এ জন্য সকল পর্যায়ের অংশীজনদের সক্রিয় ভ‚মিকা প্রয়োজন।’
নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের হোম ডেলিভারি, কোভিড-১৯ ও সাধারণ স্বাস্থ্য পরামর্শের জন্য টেলিমেডিসিনসেবা, ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম, ভিডিও কনফারেন্স, অনলাইন প্রশিক্ষণ, দূর-শিক্ষণকার্যক্রম, ভিডিও স্ট্রিমিং ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাখাত ও আবাসিক ব্যবহারকারীদের জন্য পারস্পরিক সংযুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ কারণে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ এর চাহিদা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আগামী বছরগুলোতে যে কোন মহামারি প্রতিরোধে সংযোগ চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে। প্রচলিত প্রযুক্তির পরিবর্তে উচ্চগতির ফাইবার অপটিক-ভিত্তিক কানেকটিভিটি বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে টেলিমেডিসিন সেবা, দূরশিক্ষণ, অনলাইন প্রশিক্ষণ, মহামারি আক্রান্ত এলাকা নির্ধারণ, সামাজিক সুরক্ষা প্রাপ্তির তালিকা তৈরি প্রভৃতি খাতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও বিগডাটা প্রয়োগ বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়াও ই-কমার্স, আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং, ভিডিও স্ট্রিমিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বর্ধিত চাহিদা পূরণকরতে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এর ধারণ ক্ষমতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ৫-জি নেটওয়ার্ক সীমিত আকাওে চালু হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যে ৫-জি প্রযুক্তি চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে অনেকে। ৫জি এর জন্য টেলিকম কর্মকর্তাদের দক্ষ ও সক্ষমতা তৈরি কর হচ্ছে। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তিত জীবন ব্যবস্থার মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অগ্রগামী হতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকতে বাংলাদেশের প্রযুক্তি পরিবেশে সহায়ক অবকাঠামো-কারিগরি প্রস্তুতিতে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার এবং সিস্টেমস থাকতে হবে। ২০০০ সাল পর্যন্ত আমরা মেশিন লার্নিং ডেভেলপ করেছি সিপিইউ দিয়ে তা চালানো হয়েছে। কিন্তু এখন গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট বা জিপিইউ-তে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নত জিপিইউ নিশ্চিত করা গেলে মেশিন লার্নিংয়ে বেশি সক্ষমতা আসবে।
গুগল, ফেসবুকের আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের দক্ষতার পেছনের কারণ হলো ফেস ডিটেকশনে ভালো ফেসবুক, স্প্যাম ইমেজ ডিটেকশনে ভালো গুগল। এই ডিটেকশন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এই ডিটেকশনের জন্য যোগ্য করতে প্রয়োজন হাজার হাজার ছবি, অর্থাৎ হাজার হাজার ডেটা। যেহেতু গুগল এবং ফেসবুকের ব্যবহারকারী বিশ্বজুড়ে রয়েছে, তাই তাদের ডেটার সংখ্যা বেশি। সেজন্য তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতাও বেশি।
বাংলাদেশের তরুণরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে কৌতুহলী, এই কৌতুহলী তরুণদের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দেশের অগ্রগতির জন্য ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ। কিন্তু কৃষি কাজ এখনো প্রকৃতি নির্ভর, কীটনাশক প্রদান সনাতন পদ্ধতিতে চলছে। যেখানে ফসলের রোগবালাই, মাটির অবস্থা, আবহাওয়া নির্ণয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে ১৭ কোটি মানুষের জন্য ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র ২৫-৩০ হাজার। এখাতে অবশ্যই আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। তাছাড়া শিল্পখাতের সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভরযোগ্য উপায় হতে পারে।
প্রায় সবখাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং অতিমাত্রায় মেশিন-রোবট নির্ভরতা মানুষের বেকারত্বের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এই বৈশ্বিক উৎকণ্ঠাকে স্বীকার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিবাচক ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছেন মোবাইলফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের কায়িক শ্রম কমিয়ে জ্ঞানভিত্তিক শ্রমের উপায় হিসেবে দেখেন অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় গুরুত্ব দিচ্ছে। পুরো বিশ্বের ব্যবসায়িক নামকরা প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে স্বল্প পরিসরে কাজ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বেকারত্বের ভয়ে বাংলাদেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে পিছিয়ে গেলে পুরো বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়তে পারে। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষে শারীরিক শ্রম দেয়া শ্রমিকের সংখ্যা কমার সম্ভাবনা রয়েছে ঠিক তেমনি জ্ঞানভিত্তিক শ্রমের ক্ষেত্রও প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ এমন একটা প্রযুক্তি অনেকটাই আমাদের অজান্তে সবাইকে ঘিরে ফেলছে, সেটা হচ্ছে এক কথায় বললে বলা যেতে পারে ‘প্রযুক্তি’কে শেখানো হচ্ছে একদম মানুষের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে। মানুষের দরকারে। যেমন, হেলথকেয়ার সিস্টেমে রোগীদের ঠিকমতো স্বাস্থ্যসেবা দেবার জন্য, মানুষের ভুল কমানোর জন্য। পাশাপাশি কোন স্পেসিফিক ট্রিটমেন্টটা তাদের কাজে লাগছে – সেই ঔষুধ রোগীর উপর ব্যবহার না করে সিমুলেশনে ‘ড্রাগ ডিসকাভারি’তে ব্যবহার হচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
আজকে কোভিড-১৯’ এর টিকা ও ঔষধ তৈরির পেছনে এই প্রযুক্তির সাপোর্ট কারো অজানা নয়। সেটা না হলে এর জন্য সময় লাগতো আরো অনেক বেশি। মহামারি নিয়ন্ত্রণে অনেক দেশই ব্যবহার করছে এই প্রযুক্তি। উন্নত দেশের সরকারগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে আরবান প্ল্যানিং, মাস ট্রানজিট সিস্টেম, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, বন্যার আর্লি ডিটেকশন, সরকারি রিসোর্সের সঠিক ডিস্ট্রিবিউশন এবং ব্যবহার, সামনের বছরগুলোতে পেনশনারদের কতো টাকা দিতে হতে পারে ক্রাইম প্রেডিকশন, শহর জুড়ে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট এর কাজ করছে। এরকম হাজারো জিনিসে ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
ওয়ার গেমিং এ এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীতে এই প্রযুক্তির ব্যবহারের একটা ধারণা এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ‘তৃতীয় অফসেট স্ট্রাটেজি’ হিসেবে। ২০১৮ সালে পেন্টাগন ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে। ব্যাপারটা এমন যে আমরা হয়তোবা আন্দাজ করতে পারছিনা কিভাবে ঘটছে – তবে আমাদের আশেপাশের সবকিছুই পাল্টে যাচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে।
আমরা চাই বা না চাই -কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়টি ঢুকে গেছে সবকিছুর ভেতরে। যেভাবে আমরা দেখেছি- হেলথকেয়ার থেকে শুরু করে সরকারি কাজ, ট্রান্সপোর্টেশন ইন্ডাস্ট্রি – শিক্ষা – যারা যা করতে চাইছেন তার সবকিছু সহজ করে দিচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এটা ঠিক যে, অনেক বড় একটা ক্ষমতা আসছে মানুষের হাতে- সেটা বুঝতে পারছে খুব কম মানুষই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শুরুতে যেখানে মেশিনকে শেখাতে হয় -সেখানেই দরকার মেশিন লার্নিং। অন্য কথায় বললে – কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে অংশে যন্ত্রকে বুদ্ধিমত্তা দেবার প্রসেসই মেশিন লার্নিং। পৃথিবীতে ’এআই’ ফর সোশ্যাল গুড’ নিয়ে একটা বিশাল মুভমেন্ট চলছে ডেটাকে মানুষের কাজে ব্যবহারে মাধ্যমে। মেশিন লার্নিং ব্যাপারটা জেনে রাখা ভালো কারণ এর ব্যবহার চলে আসছে প্রতিটা সেক্টরে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটা বর্তমান এবং ভবিষ্যত স্কিলসেট। আমাদের আশেপাশের পশুপাখি থেকে মাঝে মাঝে বেশ কিছু ‘বুদ্ধিমত্তা’র আচরণ পাই। ব্যাপারটা এমন যে -যেহেতু সেই পশুপাখিটা মানুষের স্কেলে অর্থাৎ মানুষের মতো করে কোন জিনিসকে অনুসরণ করছে, সে কারণে আমরা তাকে বুদ্ধিমান প্রাণী বলছি। জিনিসটা এরকম যে সে মানুষের মতো করে আচরণ করছে, কিন্তু সে যদি তার মত করে কোন কাজ কওে সেটা তার স্কেলে বুদ্ধিমান বলা যেতে পারে। কোন কিছুর মধ্যে যে বুদ্ধিমত্তা আছে সেটা তার কাজের আউটকাম অথবা তার ব্যবহারে সেটা ফুটে উঠে। তবে এই বুদ্ধিমত্তা যেখান থেকে বের হচ্ছে সেটার উৎপত্তিস্থল আমাদের বা পশুপাখিদের মাথায়। আমাদের মাথায় এই বুদ্ধিমত্তাগুলো কিভাবে তৈরি হচ্ছে অথবা এর কাজ করার প্রসেসগুলো আমরা যেহেতু সরাসরি দেখতে পারছি না, সে কারণে এই বুদ্ধিমত্তা কিভাবে কাজ করছে সেটার ব্যাপারে আমরা এখনো অনেক কিছুই জানি না। আমরা জানি, মাথার নিউরনের ভিতর ইলেকট্রনিক পালস্ দিয়ে ব্যাপারগুলো ঘটে তবে এর’ ইন্টারনাল’ বিষয়গুলো আমাদের কাছে এখনো অজানা।
অনেক কথাই হচ্ছে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। কিন্তু এই বুদ্ধিমত্তা কার এর সহজ উত্তর, মানুষের। যন্ত্রে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কম্পিউটার দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা। আমাদের সবার পরিচিত রোবট যেমন প্রাণী বা মানুষ আদলে বানানো যন্ত্র যা কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। মানুষ যেভাবে কাজ করে ঠিক সেই ভাবেই কাজ করতে পারে। এই যন্ত্রগুলোর মানুষের মতো উন্নত চিন্তা বা অনুভূতির সংবেদন তৈরি ও প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট কম্পিউটারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট যা প্রোগ্রাম দেওয়া হয় এর বাইরে সে যেতে পারে না। একইভাবে মানুষের মতো সে অনুমান ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্তেও আসতে পারে না। বিজ্ঞানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শাখায় রোবটকে আরও কীভাবে মানব মস্তিষ্কের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায় এসব নিয়েই গবেষণা চলছে।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক