উন্নয়নে দেশীয় সম্পদ ও প্রযুক্তির ব্যবহার করা জরুরি


বিশ্বকে জানার জন্য সীমাহীন কৌতূহল, অজানাকে জানার একাগ্র পথচলায় বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার। এ সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য মানবকল্যাণ। বিজ্ঞানকে যদি মানবকল্যাণে ব্যবহার করতে হয় তাহলে প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে ভাবনার কোনো সুযোগ নেই। প্রযুক্তি হলো বিজ্ঞানের প্রায়োগিক শাখা। পৃথিবী এবং তার প্রকৃতি সম্পর্কে মানবমনের চিন্তাভাবনাগুলো পরীক্ষণ, পরিদর্শন ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগের দায়িত্ব প্রযুক্তির, এটাই প্রযুক্তির কাজ। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির যৌথ প্রয়াস মানুষের জীবন-জীবিকাকে সহজ করেছে। উন্নত করেছে। সীমিত সম্পদের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করে সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সভ্যতার বিবর্তন ঘটিয়েছে। উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, যোগাযোগ ও বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থেকে নতুন নতুন ভাবনার বিস্তার ঘটিয়ে জীবনযাত্রাকে সাবলীল রাখতে প্রতিনিয়ত নতুন মাত্রা যোগ করেছে। প্রযুক্তির দ্রæত পরিবর্তনের কারণে একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির উন্নত থেকে অতি উন্নত অবস্থান। তবে নিজস্ব কৃষ্টি, ইতিহাস, সমাজ, বিশ্বায়ন, রাজনীতিতে প্রযুক্তির অবস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বের এগিয়ে যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য। মোট কথা, নিজস্ব গÐির মধ্যে থেকেই আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই দেশ এগিয়ে যাবে, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের হাতে হাত রেখে। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ খুব কম দেখানো হয়। সর্বত্রই প্রবণতা ও প্রচুর উৎসাহ দেখা যায় দেশী প্রযুক্তি ব্যবহার না করে ধার করা বিদেশী প্রযুক্তি ব্যবহারের।
বহুমাত্রিক কল্যাণ চিন্তা না থাকলে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যাবে না, প্রযুক্তিমনস্ক হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। ফলে উন্নয়নের পরশ সবাইকে স্পর্শ করে না, বৈষম্যের সৃষ্টি করে। প্রযুক্তির অঙ্গীকার ও জনগণের প্রত্যাশিত ইচ্ছার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি ত্বরান্বিত হবে। দেশের উন্নয়নের সিংহভাগ অর্থই ব্যয়িত হয় কারিগরি কর্মকাÐের মাধ্যমে। কিন্তু জনগণের কষ্টার্জিত করের অর্থ প্রযুক্তিভিত্তিক কোনো ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগে বরাদ্দ করা যুক্তিযুক্ত কিনা তা বিবেচনার দাবি রাখে। যেকোনো প্রযুক্তিভিত্তিক প্রস্তাবনা প্রকৃত দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর কিনা, তা ব্যয়বহুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রথমে যাচাই-বাছাই জরুরি। কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, যানবাহন, খাদ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশ সর্বত্র দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতাহীন বিদেশী ফর্মুলার উদ্যোগের ছড়াছড়ি। নিজেদের কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য বিবেচনা করে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়েছে এমনটা দেখা যায় না। বিশ্বের প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব উদ্যোগের ভিত রচনা করতে নিজস্ব কর্মশক্তির ওপর বিশ্বাস রেখে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনির্মাণ সাধন প্রয়োজন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের সব কর্মকাÐ সফল করতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
উন্নয়নের উদ্যোগগুলো নির্ধারিত সময়ে ও ব্যয়ে শেষ করার কোনো বাস্তব ব্যবস্থাপনা খুব একটা দেখা যায় না। স্বাধীন মানুষ নিজের কাজ বিবেচনায় অর্থ ব্যয়ে আন্তরিক থাকে। পুরো প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে জনগণ আজ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে দেশের সব উদ্যোগের এটাই স্বাভাবিক পথ, এটাই তাদের ভবিতব্য। ব্যক্তিজীবনে যা কাম্য, রাষ্ট্রীয় জীবনেও তাই চর্চা করা উচিত। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে যদি সার্বিক জনকল্যাণে নিবেদিত করতে হয়, তাহলে প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সঠিক প্রযুক্তি নির্বাচন করে আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যবহার করার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। বিশ্বে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে, তা থেকে নিজেদের জন্য কল্যাণকরগুলো খুঁজে প্রয়োগ করতে হবে। এটা করা না হলে প্রযুক্তির অপব্যবহার হতে বাধ্য, যা অভিশাপ হিসেবে মানুষের জীবনে নেমে আসতে পারে। আমাদের দেশে প্রযুক্তির অভিশাপের অনেক উদাহরণ চোখের সামনে ভাসছে। অতীতে যেমন ছিল, এখনো তা সমানভাবে দেখা যাচ্ছে। প্রযুক্তি প্রকৃতই একটা সৃজনশীল ধারণা। ধারাবাহিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রশিক্ষকের মাধ্যমেই সঠিক প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্ভব। প্রতিভার বিকাশ ও সঠিক প্রয়োগ যেকোনো উদ্যোগকে লক্ষ্যে পৌঁছতে সহযোগিতা করতে পারে। এখন সকলকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেই অগ্রযাত্রায় সকলকে ভ‚মিকা রাখতে হবে। আমাদেও অনেক ভালো উদ্যোগ আছে সেগুলোকে ব্যবহার করতে হবে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, যাঁদের হাত ধরে বাংলাদেশ এভাবে এগিয়ে চলছে তাদেও সহযোগিতা করতে হবে, ভালো কাজের জন্য সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। আমাদেও বিশাল তরুণ ও যুব সমাজ আছে তাদেও কাজে লাগাতে হবে। যাঁরা আক্ষরিক অর্থেই স্বপ্ন দেখতে জানে এবং সেই স্বপ্নপূরণের জন্য ঝুঁকি নিতে জানে তাদেও সগযোগিতা করতে হবে।
আর এই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের কারিগর যে আসলে আমাদের এই যুব ও তরুণ সমাজ তাতে সন্দেহর কোনো অবকাশই নেই তাদেও প্রতি আরো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের বাংলাদেশেই এখন ৩৯ টি হাইটেক পার্ক হচ্ছে যা হচ্ছে এক একটি সিলিকন ভ্যালি। আমাদের স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণীরাই পরিচালনা করবে আমাদের সিলিকন ভ্যালিগুলো। তাদেও সহযোগিতা করতে হবে। তাহলেই স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *