জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্য পদ লাভ করে। আর্থ-সামাজিক জরিপ, আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদানে আর্থ-রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম বাস্তবায়িত হয় তাঁরই নির্দেশে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের আর্থ-স্টেশনের উদ্বোধন করেন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদার মতো একজন বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণয়ন এবং শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহার করার লক্ষ্য বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা ছিল তাঁর অত্যন্ত সুচিন্তিত ও দূরদর্শী উদ্যোগ। শুধু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশে গৃহীত নানা উদ্যোগ ও কার্যক্রমের দিকে তাকালে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই রচিত হয় একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের ভিত্তি, যা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বিপ্লবে অংশগ্রহণের পথ দেখায়।
ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ। মূলত এটি একটি ধারণাপত্র ও কর্মকৌশল- যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে ও হবে বর্তমান সরকার কর্তৃক। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘ভিশন-২০২১’-এর মূলভিত্তি হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দেওয়া হয়। ব্যাপক ও বহুমুখী উন্নয়নে একের পর এক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন শুরু করা হয় একইসঙ্গে একাধিক মেগা প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে। নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী সরকার ইতোমধ্যে সারাদেশে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি দিয়েছে এবং স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করেছে মহাকাশে। দ্বিতীয় স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-২ এর কাজ চলছে। বর্তমানে ১৭ কোটি মানুষের হাতে ১৮ কোটি ৬০ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহৃত হচ্ছে ১৩ কোটি মানুষ ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত ব্রডব্যান্ড ও মােবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
কল সেন্টারভিত্তিক সেবাপ্রাপ্তিতে ৯৯৯, যে কোনো তথ্য জানার জন্য ৩৩৩, কৃষক বন্ধু সেবা প্রাপ্তিতে ৩৩৩১সহ টেলিমিডিসিন সেবা এবং বেøন্ডেড লার্নিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এর মধ্যে। বাংলাদেশের এই রূপান্তরের নেপথ্য কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্র তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের ১৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছে- যা বাস্তবায়িত হবে এই সময়ের মধ্যে। ২০২১ থকে ২০৪১-এর মধ্যে কিভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি হবে এর একটি অবকাঠামো, তদনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে সর্বস্তরের জনসাধারণের জন্য, যেন তারা নিজেদের অনুরূপভাবে গড়ে তুলতে পারে।
সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য ৪টি ভিত্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এগুলো হলো- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। এর পাশাপাশি হাতে নেওয়া হয়েছে ২১০০ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা কেমন হবে- সেই পরিকল্পনা। স্মার্ট বাংলাদেশে সব কাজ, সম্পাদন করা হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে হবে দক্ষ।
এর মাধ্যমে পরিচালিত হবে সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম- যার চূড়ান্ত লক্ষ্য ক্যাশলেস সোসাইটি। সরকার ইতোমধ্যে দেশে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইসিটি অবকাঠামো ও কানেক্টিভিটি, ই-গভর্নমেন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশনের ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ প্রহণ করেছে। স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-২ উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি নিয়েছে। ২০১৯ সালে সরকার ই-গভর্নমেন্ট মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন এবং ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ সরকারি সেবা অনলাইনে প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। দেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা হয়েছে। এর জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে আলাদা তহবিল।
এর পাশাপাশি আইডিয়া প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ট (বিগ), শতবর্ষের শতআশা এবং স্টার্টআপ সার্কেল সৃষ্টি করে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। বিনিয়োগের জন্য স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড নামে সরকার ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। সাইবার নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও সার্ক দেশগুলোর মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে।
সরকার ইতোমধ্যে দেশের গ্রামগুলোকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত শহর হিসেবে গড়ে তোলার নীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। যেখানে গ্রামের প্রকৃতি ও পরিবেশ সর্বোপরি চাষাবাদ-ফলমূল-সবজির বাগান-খামারের পাশাপাশি পাওয়া যাবে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা। তবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকেরও সবিশেষ দায়িত্ব ও করণীয় রয়েছে।
প্রথমত, এর জন্য প্রত্যেক নাগরিককে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে নিজেকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার উপযোগী করে। দ্বিতীয়ত, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি যার যার অবস্থান থেকে দায়বদ্ধ থাকতে হবে- ‘সকলের তরে সকলে আমরা- প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’- এই নীতিবাক্য অবলম্বন করে। তা না হলে স্মার্ট বাংলাদেশের সুফল পাওয়া যাবে না সর্বাংশে ও সর্বতোভাবে।
সরকার আগামীর বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে প্রতিটি জনশক্তি স্মার্ট হবে। সবাই প্রতিটি কাজ অনলাইনে করতে শিখবে, ইকোনমি হবে ই-ইকোনমি, যাতে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে করতে হবে। ‘আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মযোগ্যতা’ সব কিছুই ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে হবে। ই-এডুকেশন, ই-হেলথসহ সব কিছুতেই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হবে। ২০৪১ সাল নাগাদ আমরা তা করা সক্ষম হব এবং সেটা মাথায় রেখেই কাজ চলছে।
আমাদের তরুণ সম্প্রদায় যত বেশি এই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা শিখবে, তারা তত দ্রæত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নানা অনুষঙ্গ ধারণ করে তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ধরনের ৫৭টি ল্যাব প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। ৬৪টি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবিশন সেন্টার স্থাপন এবং ১০টি ডিজিটাল ভিলেজ স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। ৯২টি হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের নির্মাণ করা হচ্ছে। সারা দেশে ছয় হাজার ৬৮৬টি ডিজিটাল সেন্টার এবং ১৩ হাজারের বেশি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা দেশবাসীর। তাঁরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত করেছেন। সামনের স্মার্ট বাংলাদেশও শেখ হাসিনার সরকার করতে পারবে। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা আমাদের বলেছিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ উপহার দেবেন। আজ সত্যিই বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে, সেটি শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সম্ভব।’