পদ্মা সেতু নতুন শিল্পায়ন ও পর্যটনে সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে

 হীরেন পণ্ডিত

নতুন সম্ভাবনা ও নতুন দিগন্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে পদ্মা সেতু। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই এক বিস্ময়। পদ্মা সেতু হওয়ায় ছয় খাতে বিপ্লব ঘটবে। এগুলো হলো—সংযোগ স্থাপন, ব্যবসা-আঞ্চলিক বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, পর্যটন এবং সামাজিক খাত।

তবে এসব সফলতা এমনি এমনিই আসবে না। যেমনটি আসেনি যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে। পদ্মা সেতু থেকে সুফল পেতে পদ্মা প্লাস পলিসি তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং ব্যবসার খরচ কমাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করতে হবে।

পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এটি বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক। একজন সফল নেতাই পারেন মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে এবং তা পূরণ করতে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এই সেতু ব্যাপক পরিবর্তন আনবে।

এই সেতু আঞ্চলিক বৈষম্য কমাবে। বৈষম্য দূর হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে। সেই সুফল পাবে ওই অঞ্চলের মানুষসহ সারা দেশ। তবে এ জন্য একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা দরকার, যার মাধ্যমে পদ্মা সেতুর সুফল ঘরে তোলা যায়।

সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার তিন কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। ওই সব জেলায় পর্যটন, শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ হবে। সারা দেশ থেকে দক্ষিণের জেলাগুলোতে স্বল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পৌঁছে যাবে। একই সঙ্গে পদ্মার ওপারে উৎপাদিত পণ্য দ্রুত ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে চলে যাবে। এ ছাড়া চলাচলে মানুষের সময় বাঁচবে, সাশ্রয় হবে অর্থ। এভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ হবে।

পদ্মা বহুমুখী সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরো বিশদভাবে বলতে গেলে, এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এই সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হয়ে উঠেছে।

এ ছাড়া এই সেতু ভবিষ্যতে ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দর। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন সোনালি স্বপ্ন এবং দেশের প্রবৃদ্ধিতে এ সেতু ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।

কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা ও সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট দ্বীপ পর্যটন উপযোগী করা যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দর ঘিরে দেখা দেবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেল—দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে। সেতুটির কারণেই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে চলে আসবে। দক্ষিণ বাংলার গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এ অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা, তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তাঁরা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাঁদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু হবে শুনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে। পদ্মা সেতুর দুই পারেই জমির দাম তিন-চার গুণ বেড়ে গেছে।

নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাই-টেক পার্ক, মানবসম্পদ প্রশিক্ষণকেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট ও নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের হিড়িক পড়ে গেছে। খুলনা ও বরিশালে জাহাজ নির্মাণশিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কুয়াকাটায় পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুতগতিতে। আগামী দিনে বিকাশের এ ধারা আরো বেগবান হবে।

পদ্মা সেতু ঘিরে পদ্মার দুই পারে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১.২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতিবছর দারিদ্র্য নিরসন হবে ০.৮৪ শতাংশ। এর মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ছয় কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। একসময় দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দেখা দিত। এখন মঙ্গার কথা আর তেমন একটা শোনা যায় না। বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের এই মঙ্গা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ঠিক একইভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো এখনো শিল্পের দিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এ এলাকার বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। সবার আগে উপকার হবে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর। কারণ পদ্মা সেতুর কল্যাণে ওই সব এলাকায় ব্যাপক আকারে শিল্পায়ন হবে, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের আয় বাড়বে এবং জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন আসবে।

২০৩৫-৪০ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রে এই সেতু নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই সেতু অর্থনীতির সেতুবন্ধ ও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের পথে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের উন্নয়ন ও অহংকারের প্রতীক। আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয়, যোগ্যতা সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রত্যয়ের ফসল। বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশের পথে বাংলাদেশও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে নির্মিত হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *