সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ


হীরেন পণ্ডিত: সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমন কোনো দিন নেই, সংবাদমাধ্যমে কোনো সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের খবর থাকে না। সড়কে এ রকম প্রাণহানি মর্মান্তিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানা যাচ্ছে না কোনভাবেই। এতে প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। আহত হচ্ছে বহুসংখ্যক মানুষ। মারাত্মক আহতরা মৃত্যু থেকে বাঁচতে হাসপাতালে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং অনেকের জীবনেই নেমে আসে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব। তাদের বাকি জীবন অতিবাহিত হয় এক দুর্বিষহ যন্ত্রণায়।
এ এসব মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ প্রকাশের ভাষা আমাদের নেই। নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করার নেই। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, প্রায় অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যে কারণগুলো এখনো এগুলোর ক্ষেত্রে কোন ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেনা। চালক ক্লান্ত, অবসন্ন, বেপরোয়াভাবে গাড়ি চলছিলো, আসনের বাইরেও দাঁড়ানো যাত্রী ছিলো তা আসনসংখ্যার দ্বিগুণ এসব বিষয়কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আরও ভয়ংকর বিষয় হয়, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক যানবাহনের চলাচলের অনুমোদন থাকেনা। আবার অনেক সময় কোনো ফিটনেস সনদও থাকেনা। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সড়কে এত দুর্ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ি বহাল তবিয়তে চলছে কীভাবে, এ প্রশ্ন এখন সবার! এ ঘটনায় প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টিকে আবারও পরিষ্কারভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সড়কে প্রাণ ঝরে পড়ার এ মিছিলের শেষ কোথায়? এর থেকে কি কোনো পরিত্রাণ নেই আমাদের? পরিসংখ্যান বলছে, বিদায়ী বছরে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত ও ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হয়েছে। একই সময় রেলপথে ৬০৬টি দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত, ২০১ জন আহত হয়েছে। নৌপথে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন নিহত, ৩৫৭ জন আহত এবং ৭৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে ৭ হাজার ৬১৭টি দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৮৫৮ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৯১৪ জন আহত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা সড়কে যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল, ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহন করাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, এ নিয়ে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ ও নজরদারির অভাব রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা যদি তৎপর হতেন, তাহলে সড়কগুলোয় এসব গাড়ি চলে কীভাবে?
দেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় সড়ক-যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, সড়কে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হয়নি। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। গণমাধ্যমে যে তথ্য প্রকাশিত হয়, প্রকৃত দুর্ঘটনা তার চেয়ে চার বা পাঁচগুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে শুধু কমিটি গঠন এবং সুপারিশ করার চক্র থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। এসবের চেয়ে বেশি প্রয়োজন জনবান্ধব পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করা।
কেউ কেউ বলছেন, সড়কে যানবাহনের গতি কমাতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। তাছাড়া জনবলের বিষয়টি সামনে এসেছে, যেমন পদ্মা সেতু চালুর পর প্রায় সব সড়কেই যানবাহন চলাচল তিন থেকে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুপাতে বাড়েনি জনবলসহ অন্যান্য সাপোর্ট। ফলে পুরোনো কাঠামোর জনবল দিয়েই বাড়তি সড়ক সামলাতে হচ্ছে হাইওয়ে পুলিশকে। গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর যোগাযোগের নতুন দ্বার খুলে যাওয়ায় এসব মহাসড়কে যানবাহনের চলাচল বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ গুণ। তাছড়া সচেতনতার অভাব, পাশাপাশি মালিক-কর্তৃপক্ষের দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্ট্যান্ডে পৌঁছানোর চাপই দায়ী। তাই দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য কাজ করা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের আগস্টে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ পাস করা হয় এবং সম্প্রতি সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর বিধিমালা প্রণীত হয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করা হয়। তাছাড়া চালকের দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে। মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী। অনেক পরিবহণ মালিক চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেন না। দেশে এ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কমকিছু হয়নি। কত আলোচনা-সমালোচনা, আন্দোলন-বিক্ষোভ, সংবাদপত্রে লেখালেখি, আইন-কানুন বা নিয়মনীতি তৈরি। কিন্তু দুর্ঘটনা কি রোধ করা গেছে? যায়নি। আসলে সমস্যাটি কোথায়? নিয়মনীতি বা আইন-কানুন নেই নাকি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন নেই? কেন এত এত প্রাণ নির্মমভাবে অকালে ঝরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত- এই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই।
এত এত দুর্ঘটনার পরও কেন মানুষের সচেতনতা আসে না? কীভাবেই বা এত এত অবৈধ যানবাহন সড়কে চলাচল করে? আসলে সমস্যাটি কোথায়? কবে আমাদের হুঁশ ফিরবে? আমরা মনে করি, বিষয়টি নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নতুন করে ভাবা উচিত। তা না হলে সড়কে এই মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না। আর তা-ই যদি না করা যায় তাহলে বলতে হবে এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা নেই আর আমাদের। প্রতিটি মৃত্যুই বেদনার। আমরা সড়কে একটি মৃত্যুও চাই না।
২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সড়কে দুঘটনা ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে এবং প্রাণহানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনার ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে অথবা চাপা মেরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, এমন একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে পথচারী! ফুটপাতে, আইল্যান্ডে দাঁড়ালে, দ্রুতবেগে যমদূত এসে পিষে মেরে দেবে। টুঁ-শব্দটি করা যাবে না।
এছাড়া সরকারি আদেশ অমান্য করে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল জাতীয় এবং মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে ২০২২ সালে সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় একদিনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে গত বছরের ২৯ জুলাই। সেদিন ২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়েছেন। ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে বাস ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান ও লরি ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ, জিপকার ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এরপর রয়েছে অটোরিকশা ৬ দশমিক ২২ শতাংশ এবং মোটরসাইকেল ২৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। মোট দুর্ঘটনার ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ পথচারী চাপা দেয়া, ২১ দশমিক ৬১ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৫ দশমিক ৭৯ ভাগ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে এবং ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
সড়ক-মহাসড়কে অব্যাহত দুর্ঘটনায় বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুরোধে প্রধানমন্ত্রী ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো ছিল- চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখা ও পাঁচ ঘণ্টা পর পর চালক পরিবর্তন করা, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, চালকদের জন্য মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ এবং সিগন্যাল মেনে যানবাহন চালানো ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা।
সরকারও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সড়ক ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা রোধে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে এ অবস্থার উন্নতির জন্য। ইতোমধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’-এর অধীনে প্রণীত বিধিমালাও কার্যকর করা হয়েছে। দেশব্যাপী জাতীয় মহাসড়কগুলো পর্যায়ক্রমে সার্ভিসলেনসহ ছয় লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জাতীয় মহাসড়ক সার্ভিসলেনসহ ছয় লেনে উন্নীত করার কাজ শেষ হয়েছে। দুর্ঘটনাপ্রবণ স্পট ঝুঁকিমুক্ত করা হয়েছে। অন্যান্য স্পট ঝুঁঁকিমুক্ত করার কাজও হাতে নেওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়ক মোহনাগুলো চিহ্নিত করে প্রকৌশলগত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্থাপন করা হচ্ছে প্রয়োজনীয় সাইন-সিগন্যাল। পণ্য পরিবহন চালকদের বিশ্রামের জন্য সিরাজগঞ্জের পাঁচিলায়, কুমিল্লার নিমসারে, হবিগঞ্জের জগদীশপুরে এবং মাগুরার লক্ষ্মীকান্দরে চারটি বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যোগাযোগ খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ চলছে এবং অনেক পরিবর্তন ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের আগে বাধ্যতামূলকভাবে পেশাজীবী গাড়িচালকদের দক্ষতা ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক রিফ্রেশার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬২ হাজার ৯০০ পেশাজীবী গাড়িচালককে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নকল্পে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি থেকে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নকালে বাধ্যতামূলকভাবে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট সনদ বা প্রতিবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক করিডর বাস্তবায়ন, ৫ হাজার কিলোমিটার সড়কে নিরাপত্তা কার্যক্রম গ্রহণ, পেশাদার চালকদের জন্য প্রশিক্ষণ, ভেহিকল পরিদর্শন কার্যক্রম আধুনিকীকরণ, তিনটি হাসপাতাল (মুগদা, টাঙ্গাইল এবং বগুড়া) ট্রমা সেন্টারের আধুনিকীকরণ, পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ, ক্রাশ ডাটাবেজ সিস্টেম আধুনিকীকরণ করার লক্ষ্যে বহুমাত্রিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *