মাতৃভূমি ও স্বাধীনতাকে হেয়প্রতিপন্ন করা উচিত নয়


হীরেন পণ্ডিত: মা, মাটি, মাতৃভূমি এবং আমাদের স্বাধীনতা একে-অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ও সম্পর্কযুক্ত। একটিকে বাদ দিলে আরেকটির অস্তিত্ব একেবারেই অসম্ভব। আমরা পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে প্রথমেই স্থান পাই মায়ের কোলে। মায়ের কারণেই সুশীতল পৃথিবীর সুন্দর মুখখানি দেখতে পাই। শিশু হয়ে জন্মগ্রহণের পর এই বিশাল ও সুন্দর পৃথিবীর বুকে নিজেকে খুব অসহায় মনে করি। সুন্দর নীল আকাশের নিচে নিজেকে দুর্বল ভেবেছি ও অসহায় বোধ করেছি। তাই মায়ের আদর, যতœ ও ভালোবাসার ওপর ভর করে ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। অন্যান্য শিশুর মতো ধীরে ধীরে পৃথিবীর আলো, বাতাস, তাপ গ্রহণ করে একজন শিশু বড় হয়। আমরা সবাই সেভাবেই বড় হয়েছি। সবার মতো আমরা চারপাশের প্রকৃতিকে মায়ের মতো ভালোবাসতে শুরু করি। দেশের মাটিতেই লালিত-পালিত হয় বলে সবার কাছেই এই মাটি মায়ের মতো প্রিয় এবং মায়ের মতোই সে মাটিকে আমরা ভালোবাসি। এই বাঙালি জাতি মহান জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭১-এ স্বাধীনতাযুদ্ধে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা। জননীকে আমরা যত ভালোবাসি, মাতৃভূমি ও আমাদের মহান স্বাধীনতাকেও আমরা ততটাই ভালোবাসি।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য কিছু করা গৌরবের বিষয়। দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিবেদিত মানুষ সমাজের চোখে যেমন সম্মানিত, তেমনি সবার কাছে অত্যন্ত গৌরব ও মর্যাদার অধিকারী। দেশপ্রেম এক ধরনের পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ, যা মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্ব সচেতন করে তোলে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দেশের কল্যাণে কাজ করে তারাই প্রকৃত মানুষ। দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা মানুষকে ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করে পারস্পরিক সদাচরণ করতে শেখায়। দেশের মানুষের বিভিন্ন দলমত, সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পরস্পরের প্রতি বিরোধ, সংঘর্ষ-সহিংসতা ও প্রতিহিংসার পরিবর্তে একে-অন্যের সহযোগিতা, সহানুভূতি ও পৃষ্ঠপোষকতার ভাবধারা গড়ে তোলার জন্য পরমতসহিষ্ণুতার শিষ্টাচার গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ ও স্বদেশের প্রতি মমতা অনেক অন্যায় ও অপরাধপ্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে। তাই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে হলে অবশ্যই দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ হলে বাংলাদেশকে স্বীকার করতে হবে, মুক্তিযুদ্ধকে মানতে হবে এবং অন্তরে ধারণ করতে হবে। আপনি সরকারের সমালোচনা যত খুশি করতে পারেন। কিন্তু দেশ, মা, মাটি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অপমান বা ছোট করতে পারেন না। সরকার আর রাষ্ট্র এক বিষয় নয়। সরকারের সমালোচনা করা যায় কিন্তু রাষ্ট্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো কথা বলার বা মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই। সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা এবং এর মান-মর্যাদা রক্ষা সবার দায়িত্ব। এমন কোনো কাজ করা কারো উচিত নয় যা দেশের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যায়। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতাকে হেয় করা হয় এমন কাজ কারো করা উচিত নয়। বিভিন্ন মহল এটি করতে চাইবে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কারো ফাঁদে আপনি পা দেবেন কিনা। আমরা যেন কোনো মহলের ক্রীড়নক না হয়ে উঠি সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
অনেকদিন ধরেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক মন্দা- সব মিলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতিই নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে সেসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সরকারকে বারবার অভ্যন্তরীণ মুদ্রার মানের অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। আমদানি পণ্যের দাম পরিশোধ করতে গিয়ে রিজার্ভ কমছে। তবে নানা পদক্ষেপে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কা কেটে যাচ্ছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় বাজারে কৃত্রিমভাবে দ্রব্যের সংকট তৈরি পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে। শুধু দিনমজুর নয়, অনেক সচ্ছল মধ্যবিত্তেরও বাজারে গেলে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়ে যায় এখন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের পুষ্টিতে টান পড়েছে। বাজারের তালিকায় অনেক সামগ্রী বাদের তালিকায় থেকে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট কিছু খরচ কমানোর উপায় নেই বলে বাজারের খরচ কমাতে হয়েছে। তাতে মাছ-মাংস খাওয়ার হার কমে যাচ্ছে অনেক পরিবারের খাদ্য তালিকা থেকে। তাই বলে কি আমাদের ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে গেছে স্বাধীনতা কি এমনই একটি বিষয়! দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই চলে আসছে নানা কথা-বার্তা। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বেশকিছু তড়িৎ সিদ্ধান্তের ফলে আমরা অনেক জটিল অবস্থার দ্রুত সমাধান করতে পেরেছি।
পৃথিবীর যে কোনো স্বাধীন দেশেই সব মানুষের সব চাহিদা পূরণ করা একেবারেই সম্ভব হয় না। কিন্তু তাই বলে তো স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায় না। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়, এ রকম মানুষ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। স্বাধীনতার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকতেই পারবে না। বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি। কিন্তু ৫২ বছরে বাংলাদেশ সবাইকে অবাক করে অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের বিস্ময়। একটি সরকারের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ করা আর মনের মাধুরি মিশিয়ে সরকারের সমালোচনা করা আর বাজার দরের সঙ্গে স্বাধীনতাকে মিলিয়ে ফেলাটা কোনো সঠিক কাজ নয়। একজন মানুষ যে মাছ, মাংস, চালের স্বাধীনতা চান এটাও স্বাধীনতারই অর্জন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার একটি অংশ। একসময় এই দেশে দুর্ভিক্ষ ছিল, মঙ্গা ছিল, অভাবে মানুষ হাহাকার করত। এখন সেসব আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। একসময় মানুষ দুবেলা দুমুঠো ভাত পেলেই বেজায় খুশি ছিল। এখন সেই মানুষজন মাছ-মাংসের স্বাধীনতা চায়, এটাও একটা বড় অর্জন। তবে এই কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে, এই সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে দেশের সব মানুষকে করোনার টিকা প্রদান করেছে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতুর মতো দুটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং দেশের মানুষ এর সুবিধা পাচ্ছে। শিক্ষা, যোগাযোগ অবকাঠামো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, নারী শিক্ষা, চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা শতভাগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সামাজিক কর্মসূচির আওতায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, অসহায়, বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তালাকপ্রাপ্ত নারীদের সহায়তা, অটিজম, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান, আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, নারীর ক্ষমতায়নসহ ও বিভিন্ন সেক্টরের সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়নসহ অনেক কাজ কিন্তু এই সরকার করেছে। এগুলোও মনে রাখতে হবে।
সাংবাদিকতা, অপসাংবাদিকতা, ভুল সাংবাদিকতা, উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতা, গণমাধ্যমের দায়, গণমাধ্যমের দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে অবশ্যই কথা বলতে হবে। সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা চলুক তাতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়, তবে সেই সমালোচনা যেন রাষ্ট্র এবং তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ না করা হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। তার আগে আরো বেশি করে কথা বলতে হবে দেশপ্রেম ও দেশের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে। সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে মা, মাটি, মাতৃভূমি ও দেশমাতৃকার স্বাধীনতাকে হেয়প্রতিপন্ন না করি- সেটা সবার মনে রাখতে হবে। সেটা রাখাই অত্যন্ত জরুরি।
হীরেন পণ্ডিত : লেখক ও গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *