টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থপ্রবাহ সচল রাখাই জরুরি



হীরেন পণ্ডিত : বাজেট শুধু সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়। এটি বছরের একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক অর্জনের দলিল। একদিকে বিশ্ব রাজনৈতিক অস্থিরতার জের এবং এর কারণে সৃষ্ট সমস্যার কারণে কিছুটা সংকোচনমুখী বাজেট তৈরির চাপ, অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জনগণকে সস্তুষ্ট করার জন্য বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টিও ছিলো সংশ্লিষ্টদের চিন্তভাবনায়। তবে বাজেটে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
বাজেটে সরকারের আয় বৃদ্ধির যে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে, তা অর্জন করা গেলে এ বাজেট বাস্তবায়নের অর্থ সরবরাহ নিয়ে খুব সমস্যায় পড়তে হবে না। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণ ও সহযোগিতা ছাড়াও আসছে অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডের জন্য চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উন্নয়ন সহযোগীদের দিক থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকা সত্ত্বেও এই অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ৮৪ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। তবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতগুলোর বিকাশের কোনো বিকল্প নেই।
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। শুধু নিত্যপণ্য নয়, বেড়েছে বিদ্যুতের দাম, প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপি গ্যাসের দামও। সরকারের নানা উদ্যোগ যেন তেমন কোনো কাজে আসছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে সরকারি উদ্যোগের প্রভাবসহ চার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী। বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে আসা, দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় এবং খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রভাবে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এছাড়া বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়াবে বলে দাবি করেন অর্থমন্ত্রী। এমন বক্তব্যে আমরা কি আশাবাদী হতে পারি? এর কতটুকু বা কার্যকর করতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। উল্লেখ্য, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচককে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা সংশোধন করে ৬ শতাংশ করা হয়। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট এবং আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়ার কারণে সেই লক্ষ্যও পূরণ করা যায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ১০ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশে, যা কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। মূল্যস্ফীতি মূলত কোনো পণ্য বা দ্রব্যের দাম বাড়ার গতির হিসাব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে ৪২২টি নিত্যপণ্যের ওপর ভিত্তি করে এই হিসাব করে থাকে। করোনার কশাঘাতে চাকরিহারা, বেকার ও আয় রোজগার কমে যাওয়া জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন খরচের টাকা জোগাড় করতে এমনিতে হিমশিম খাচ্ছে, তার ওপর মূল্যস্ফীতির চাপে বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছে অনেক পরিবার। এ অবস্থায় যে কোনো উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি ও রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে- এটা স্বাভাবিক। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্যমন্ত্রী কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের এ কমিটি কাজ করছে। এ সবই ইতিবাচক উদ্যোগ। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, বাজারে এর প্রভাব খুবই কম দেখা যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘœ রাখতে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে। কেন্দ্র থেকে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষেত্র পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে আমদানিকৃত ও দেশজ উৎপাদিত- এই দুই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। এসব বিষয় ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনোযোগী হলে বাজারে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে।
বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব হয়েছে অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত হয়। রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ৩০ শতাংশ খাদ্যের জোগান দিয়ে থাকে। আর রাশিয়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের এক-দশমাংশের জোগান দেয়। ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট দেখা দেয়। এখন বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রভাব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতেই বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। যদিও উন্নত দেশগুলো নিজস্ব কৌশল প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে।
আমাদের শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি বাড়াতে হবে, যাতে শিল্পের উৎপাদন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমে গেছে। মূলধনী যন্ত্রাংশ আমদানি ৫৬ শতাংশ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি ৩১ শতাংশ কমেছে। নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হলে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই আমাদের যে কোনো মূল্যেই হোক শিল্প-কারখানার উৎপাদন ঠিক রাখতে হবে। দেশে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনের মতো অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমান সরকার যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করে চলেছে, তা অব্যাহত রাখার জন্যও দ্রুত ও সুষম শিল্পায়ন প্রয়োজন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে অর্থ উপার্জন করছেন, তা যাতে সঠিকভাবে বৈধ চ্যানেলে দেশে আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের নানা ধরনের নগদ আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের উপার্জিত অর্থ যাতে বৈধ পথে দেশে প্রেরণের উদ্যোগ নেন, তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন পর্যায়ে ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উপকারভোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে জোগাড়ের কথা অর্থমন্ত্রী ভাবছেন, তা করতে হলেও ব্যাপক হারে কর আদায় করতে হবে। এর জন্য বাজেটে ব্যক্তি কর, ভ্যাট ও শুল্কের ওপর বিশেষ নজর দিতে হয়েছে। নতুন করদাতা খুঁজতে হবে, ভ্যাট আদায়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশ নেওয়াসহ অনেক সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আয় না থাকলেও টিআইএনধারী করদাতাকে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। মোটকথা, কর আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি কঠোর হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাজেটে।
এবারের বাজেটটি ঋণনির্ভর ঘাটতি বাজেট। প্রস্তাবিত সব উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতের খরচ চালিয়ে যেতে হলে ব্যাপক হারে কর আদায়ের পাশাপাশি বিদেশি উৎস ও ব্যাংক থেকে টাকা নিতে হবে। অর্থনৈতিক শ্লথগতির মধ্যে কর আদায়ে চাপাচাপি করলে মানুষের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। ব্যবসায়ীরা আরেক দফা জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে। অন্যদিকে, ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে সুদে ঋণ নেওয়ার ফলে সরকারের ব্যয় বাড়বে, আবার বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। বেসরকারি খাত ঠিকমতো ঋণ না পেলে কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ হবে না। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমবে। আবার সরকার যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ব্যয় মেটানোর চেষ্টা করে, তখন বাজারে মুদ্রাপ্রবাহ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি ঘটবে। এটাও অর্থনীতির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং অনেকগুলো বিষয়কে আমলে নিতে হবে।
অনেকে মনে করছেন এই সংকটকালে মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক পদক্ষেপ থাকা উচিত ছিল বাজেটে। সেটা না করে রীতি মেনে বড় বাজেট দেওয়া হয়েছে। যার বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে পুরো বাজেটই গরিব মানুষের জন্য উপহার। দেশে অনেক মধ্য আয়ের মানুষ আছেন, কিন্তু তারা আয়কর দেন না। সময় এসেছে, তাদের আয়কর দিতে হবে। যারা আয় করেন, কর দেয়ার সক্ষমতা আছে- তাদের কর দিতে হবে। যখন ২০০৯ সালে সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন রাজস্ব আদায় ছিল ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এখন আমাদের রাজস্ব ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ৬৯ হাজার কোটি টাকা থেকে যদি ৩ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছানো যায়- তাহলে এখন যেটা বাড়তি বলা হচ্ছে, তা আমরা অর্জন করতে পারব।
আমাদের কর্মসংস্থান বাড়ছে এবং কর্মসংস্থানের পরিধিও বেড়ে গেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে । সরকার মেড ইন বাংলাদেশ কালচারকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে। এ দেশে যে জিনিস তৈরি হবে, তা দিয়ে আমাদের প্রয়োজন মিটবে। এর মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
সরকার সব সময় দরিদ্র মানুষের কথা চিন্তা করে বাজেট দেয়। এবারো এর ব্যতিক্রম হয়নি। দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের সরকার এবারের বাজেটেও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এ বছরও দারিদ্র্য বিমোচনে ১ কোটি পরিবারকে ১৫ টাকা দরে চাল দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য দেয়া হচ্ছে। এছাড়া কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে বরাদ্দ বাড়ানো হবে।
হীরেন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *