উদীয়মান প্রযুক্তি: প্রয়োজন রিস্কিলিং ও আপস্কিলিং


হীরেন পণ্ডিত: রিস্কিলিং হলো বর্তমানে দৈনন্দিন কাজের জন্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার জন্য দক্ষতা অর্জন। আর আপস্কিলিং হলো বর্তমানে ব্যবহার করা প্রযুক্তির চেয়ে অধিকতর উদীয়মান বা নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার জন্য যে দক্ষতা অর্জন করা হয় তাকেই বলা হয় আপস্কিলিং। যেমন-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইওটি, ব্লক চেইন, বিগডাটার মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা।

স্বাধীন বাংলাদেশে বিজ্ঞান, কারিগরি ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভরতা শুরু হয়। ইন্টারনেটের সঙ্গে ডিভাইসের যুক্ততা মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে বিশ্বে উন্নয়ন দারুণ গতি পায়। বঙ্গবন্ধুর সময়ে সোনার বাংলা বিনির্মাণে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে পরিকল্পিত উদ্যোগ ও কার্যক্রমের বাস্তবায়ন করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো দেশ পরিচালনায় এসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশে গুরুত্ব দেন।

এখন বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ডেটা সেন্টার বাংলাদেশে, শুধু তথ্যের সুরক্ষাই নয়, বছরে সাশ্রয় হচ্ছে ৩৫৩ কোটি টাকা। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে জাতীয় ডাটা সেন্টার। শুধু দেশীয় তথ্যের সুরক্ষা নয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন এই তথ্যভান্ডার ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের এ অর্জন একদিনে আসেনি। স্বাধীনতার ৫২ বছরে উপলব্ধি এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে হবে। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে গত এক দশকে রফতানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।

বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৬৫০টি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ৩০০-এর অধিক ধরনের সরকারি বেসরকারি সেবা জনগণ পাচ্ছেন। একসময় প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ৭৮ হাজার টাকা। বর্তমানে প্রতি এমবিপিএস ৬০ টাকার নিচে। দেশের ১৮ হাজার ৫০০ সরকারি অফিস একই নেটওয়ার্কের আওতায়। ৫ হাজার ৫০০ ইউনিয়নে পৌঁছেছে উচ্চগতির (ব্রডব্যান্ড) ইন্টারনেট।

দেশে মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটি ৬০ লাখের অধিক। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় ১৩ কোটি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনে যথার্থভাবেই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় আর্থ-সামাজিক ব্যবধান কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে আর্থিক সেবায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি রীতিমতো বিস্ময়কর। অনলাইন ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার, এটিএম কার্ড ব্যবহার শুধু ক্যাশলেস সোসাইটি গড়াসহ ই-গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছে তাই নয়, ই-কমার্সেরও ব্যাপক প্রসার ঘটাচ্ছে। বিশ্বের ১৯৪টি দেশের সাইবার নিরাপত্তায় গৃহীত আইনি ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সাংগঠনিক ব্যবস্থা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা সূচকে আইটিইউতে ৫৩তম স্থানে এবং জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা (এনসিএসআই) সূচকে ৩৭তম স্থানে অবস্থান করছে। দক্ষিণ এশিয়া ও সার্ক দেশের মধ্যে প্রথম।

করোনা মহামারি থেকে দেশের জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে টিকা কার্যক্রম, টিকার তথ্য সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং সনদ প্রদানের লক্ষ্যে টিকা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ‘সুরক্ষা’ ওয়েবসাইট চালু করা হয় এবং দেশের জনগণ এর সুবিধা পাচ্ছে। ২০২৫ সালে আইসিটি রফতানি ৫ বিলিয়ন ডলার ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান ৩০ লাখে উন্নীত করা এবং সরকারি সেবার শতভাগ অনলাইনে পাওয়া নিশ্চিত করা, আরও ৩০০ স্কুল অব ফিউচার ও ১ লাখ ৯ হাজার ওয়াইফাই কানেক্টিভিটি, ভিলেজ ডিজিটাল সেন্টার এবং শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করছে সরকার।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যে প্রসার ঘটেছে তাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যেই সরকার বাংলার আধুনিক রূপ জ্ঞানভিত্তিক উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত। প্রযুক্তির এই প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে, আবার নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে। শুধু পোশাক শিল্প নয়, আরও অনেক পেশার ওপর নির্ভরতা কমে আসবে, রোবট এবং যন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে। মেধাভিত্তিক পেশার প্রয়োজন বাড়বে। যেমনÑপ্রোগ্রামার, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইনটারনেট অব থিংকস (আইওটি) ইত্যাদিতে দক্ষ লোকের চাহিদা বাড়বে। আমাদের দেশে দক্ষ প্রোগ্রামারের অনেক অভাব আছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে আসবে। আমাদের দক্ষ প্রোগ্রামার তৈরি করতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে তরুণরা ছোট-বড় আইটি ফার্ম, ই-কমার্স সাইট, অ্যাপভিত্তিক পরিষেবা এবং অন্যান্য সংস্থা তৈরি করছে। এ ছাড়াও ই-কমার্স, আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং, ভিডিও স্ট্রিমিং, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের ধারণক্ষমতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। গত ১৫ বছরের ডিজিটাল বাংলাদেশের পথচলা আমাদের আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি করেছে। দেশের তরুণরা এখন কেবল স্বপ্ন দেখে না, স্বপ্ন বাস্তবায়নও করতে জানে। বাংলাদেশের অদম্য যাত্রায় অচিরেই গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বনির্ভর ও আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ।

আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে আরও দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে। যারা বিদেশে যান তাদের কারিগরি বিষয়ে পারদর্শী হতে হয়।

আর এ কারণেই কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সরকার যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তাদের সহায়তা করছে। দেশ গড়ার জন্য দক্ষ জনশক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটাই আমরা সব সময় ভাবি এবং আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কাজ করছি। সরকার এমনভাবে জনশক্তি তৈরি করছে, যাতে তারা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের যেকোনো জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারে।

আমাদের এ জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রামার, ডাটা অ্যানালিস্টসহ কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন লোকের চাহিদা বাড়ছে। আশার কথা হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এবং এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ২০১৯ সালে এটুআই প্রোগ্রাম ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত যৌথ সমীক্ষায় ছয়টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হচ্ছে সনাতনী শিক্ষা পদ্ধতির রূপান্তর, অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্ভাবনী, গবেষণা ও উন্নয়ন বিকশিত করা, সরকারি নীতিমালা সহজ করা, প্রবাসী বাংলাদেশিদের দক্ষতা কাজে লাগানো এবং উদ্ভাবনী জাতি হিসেবে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করা। এই সমীক্ষার আলোকে স্কুল পর্যায়ে উদ্ভাবনে সহযোগিতা, প্রোগ্রামের শেখানোসহ নানা উদ্যোগের বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রায় এক বছর আগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এলআইসিটি প্রকল্প ১০টি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর দক্ষ মানুষ তৈরির প্রশিক্ষণ শুরু করে। এসব উদ্যোগ আমাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঝুঁকিকে সম্ভাবনায় পরিণত করার জন্য আশাবাদী করছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে কারিগরি শিক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা উল্লেখ করছেন। কারিগরি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের জন্যই দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে। যারা বিদেশে যাবেন, তাদের কারিগরি বিষয়গুলোয় দক্ষ হয়ে যেতে হবে। আর সে জন্যই কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতে পরিবর্তন করা হয়েছে। যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, সরকার তাদের সহায়তা করছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘একটি দেশ গঠনের জন্য দক্ষ জনশক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এটা আমরা সবসময় মনে করি এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সরকার জনশক্তিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চায়, যাতে তারা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের যেকোনো জায়গায় প্রতিযোগিতা করতে পারে।

তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে তরুণরা ছোট-বড় আইটি ফার্ম, ই-কমার্স সাইট, অ্যাপভিত্তিক পরিষেবা এবং অন্যান্য সংস্থা তৈরি করছে। এ ছাড়া মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটসহ কিছু বড় অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কয়েক হাজার বছরে মানবসভ্যতা এগিয়েছে অনেক। উৎকর্ষ, অপটিমাইজেশন এবং দক্ষতা হচ্ছে এই শতকের মূলমন্ত্র। সেটার প্রয়োজনে এসে যোগ দিয়েছে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’।

মানুষের সহজাত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তার যোগসূত্র না থাকলে পরবর্তী শতকে যাওয়া দুষ্কর। ‘অ্যাপভিত্তিক নানা ধরনের সেবাও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দৈনন্দিন কাজ, উৎপাদন, বিক্রি, বিপণন এমন নানা স্তরে সময়, শ্রম ও ব্যয় কমানোর জন্য এখন অনেকেই প্রযুক্তিকে বেছে নিচ্ছেন। বড় কোম্পানিগুলো ইআরপি (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং) সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তার (এসএমই) একটি বড় অংশই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছে।

মহামারি মোকাবিলা থেকে নানা কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) নানামুখী ব্যবহার দেখছে বিশ্ব। ‘আগামী দিনে ব্যবসার ধারণা আমূল পাল্টে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর নানা প্ল্যাটফর্ম। আগামী দিনগুলোয় চিকিৎসাসেবায়, অফিস-আদালতে, শিল্প-কারখানায়, সংবাদ সংস্থা বা গণমাধ্যমে, ভাষান্তর প্রক্রিয়া, টেলিফোনসেবা, বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, হোটেল-রেস্তোরাঁ এমনকি বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র বা রোবটের ব্যাপক ব্যবহারের আভাস দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেও আমাদের রিস্কিলিং এবং আপস্কিলিং করতে হবে।

প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *