শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কাছে জনগণের প্রত্যাশা

হীরেন পণ্ডিত: মানুষের প্রত্যাশার শেষ নেই। তবে আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা অন্য যে কোনো দলের চেয়েই বেশি। জনগণ মানবিক মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এবং দেশ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কাছে প্রত্যাশা করে। আসলে প্রত্যাশা বেশি হলে হতাশার কিছু কথা থাকে। হতাশা ঘটে যখন প্রত্যাশা এবং অর্জনের মধ্যে ব্যবধান থাকে। হতাশা কাটিয়ে উঠতে সবাইকে অবশ্যই মানুষের প্রত্যাশার কাছাকাছি থাকতে হবে। ১৫ বছর ক্ষমতার মধ্যে থেকে দলের অনেক নেতাই তৃণমূল কর্মীদের কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। আবার অনেকের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা অপবাদ, অপপ্রচার। অপপ্রচারের ডামাডোলের মধ্যে আওয়ামী লীগের বেরিয়ে আসা কীভাবে বা নতুন নেতৃত্ব কী ভাবছে তা নিয়ে আলোচনা বিস্তর, এ নিয়ে কৌতূহলও কম নয়।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রায় ৪২ বছর এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি নানাবিধ সংকট ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দলকে সংগঠিত করেছেন, ক্ষমতায় এনেছেন। কেবল দলই নয়, সারাদেশ ও দেশের মানুষকে তিনি জানেন এবং সবাইকে বুঝতে চেষ্টা করেন। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের রয়েছে তার ওপর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। সভাপতি শেখ হাসিনা দলের হাল ধরে আছেন। তিনি দলে থাকবেন সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা এটাই। আমরা বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির কথা শুনি। আর্থিক অনিয়ম দূর করতে আওয়ামী লীগকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আরো মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে দাঁড়ানো, গণতান্ত্রিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখা এবং গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকার বিশেষ করে এই তিনটি ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যাশা থেকে একটু দূরে। মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী এই স্থান পূরণ করতে হবে। তবে প্রত্যাশা এবং অর্জনের মধ্যে ব্যবধান রয়ে গেছে। এটা সামাজিক এবং মানবিক মর্যাদা সম্পর্কে; এটা নির্বাচন সম্পর্কে। সরকার এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। জনগণের প্রত্যাশা সরকার পূরণ করবে এবং এই সমস্যাগুলো দূর করতে সচেষ্ট হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার টানা তিন মেয়াদে ১৫ বছর পূর্ণ করেছে। এ সময়ে সরকারের সাফল্য ও অর্জনও কম নয়। বৈশ্বিক সংকটকালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং দেশকে খুব ভালোভাবে পরিচালনা করছেন। ২০২৪ সালে ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে দেশের মানুষ অবশ্যই তাদের অর্জন-অপ্রাপ্তির তুলনা করতে বসবে, হিসাব করতে বসবে। শেখ হাসিনার ১৪ বছরের দেশ পরিচালনায় বাংলাদেশ কী পেল? এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। উদ্বোধনের অপেক্ষায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল। মহাকাশেও বাংলাদেশ তার অবস্থান ঘোষণা করেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ছিটমহল বিনিময় চুক্তির ফলে বদলে গেছে বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্র। মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতু উদ্বোধন দুটিই উন্নয়নের মাইলফলক। সফলভাবে করোনা মহামারি মোকাবিলা, শিক্ষা, যোগাযোগ অবকাঠামো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, নারী শিক্ষা, চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা শতভাগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সামাজিক কর্মসূচির আওতায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, অসহায়, বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তালাকপ্রাপ্ত ও নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তা, অটিজম, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান, আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, নারীর ক্ষমতায়নসহ ও বিভিন্ন সেক্টরের সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে আওয়ামী লীগ সরকার। একটি দেশের উন্নয়নে বিদ্যুতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিদ্যুতের উৎপাদন ২৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা ও প্রায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন, রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আনয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত করা, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেয়া, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতিদান, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও চিকিৎসা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারী নীতি প্রণয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও আইসিটি খাতে বিপ্লব সাধন বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে ও বিশ্বে পঞ্চম স্থানে আসীন করা, দেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের কাতারে শামিল করাসহ বাংলাদেশের অসংখ্য কালোত্তীর্ণ অর্জনের কারিগর সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারেরই অবদান। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গত ১৫ বছরে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের একটি নতুন ধারা তৈরি হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের তৈরি নির্বাচনী ইশতেহারের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। এখন এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। ইশতেহারে বলা হয়েছে, তরুণদের প্রত্যাশিত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ সরকারকে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা দূর করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মানসম্মত পরিষেবার ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণ শিক্ষা সম্প্রসারণের অব্যাহত ধারার বাইরে কারিগরি শিক্ষা এবং উপানুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। বিদেশে শ্রমনির্ভর মানবসম্পদ রপ্তানির পাশাপাশি দক্ষ কর্মী পাঠানোর বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। তরুণদের দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের পথ তৈরি না করলে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হবে। বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য মানসম্পন্ন ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য প্রকৌশল, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি শিক্ষার মানকে আরও গতিশীল ও সময়োপযোগী করতে হবে।
ঈর্ষণীয় অগ্রগতির কারণে বিশ্ব আজ বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাংলাদেশকে বলা হয় উন্নয়নের রোল মডেল। বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু সূচকে, এটি দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষস্থান দখল করেছে। ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৮তম বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০২২ সালে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম। স্বভাবতই এই ৪ বছরসহ টানা ৩ মেয়াদের হিসাব তুলনা করে ইতিবাচক ফল পাবে দেশের মানুষ। তবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা ভাড়া না দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানিয়েছেন দলটির তৃণমূল নেতারা। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে জেলা পর্যায়ের নেতারা এ দাবি জানান। তারা অভিযোগের সুরে বলেন, কেউ দলীয় আত্মা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন, কেউ দল বিক্রি করছেন। দলের নেতাকর্মীদের নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, আগামী নির্বাচনে দলকে আরো আধুনিক ও শক্তিশালী করতে হবে। তৃণমূল নেতাদের মুখে উঠে আসে এই কথাগুলো। তবে জনগণের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছে আওয়ামী লীগ সেটা জনগণই বলবে। তবে নিরলস প্রচেষ্টা চলুক। সবার প্রত্যাশা এগিয়ে যাক, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে উঠুক।

হীরেন পণ্ডিত : কলাম লেখক ও রিসার্চ ফেলো।
hiren.bnnrc@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *