দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে বাড়বে রেমিট্যান্স

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস রেমিট্যান্স। এই রেমিট্যান্স পাঠান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমজীবীরা। বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে আরো রয়েছেন মধ্যবিত্ত এবং কিছুসংখ্যক উচ্চবিত্ত। মধ্যবিত্তরা বিদেশে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন।
তাঁদের মধ্যে আছেন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক ও অধ্যাপক এবং অন্যান্য পেশার মানুষ। বিদেশে এই সব পেশার মানুষ সন্তোষজনক আয় করেন। তবে এ ধরনের পেশাজীবীরা দেশে যে রেমিট্যান্স পাঠান, তা পুরো রেমিট্যান্স আয়ের তুলনায় ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। শ্রমজীবীরা যে আয় করেন তা কোনোক্রমেই সন্তোষজনক নয়। অভিযোগ আছে, সঠিকভাবে দর-কষাকষি না করার ফলে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা অন্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরি পান।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী পুরুষদের পাশাপাশি প্রবাসী নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশের শ্রমবাজারে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি নারী ও পুরুষ কর্মী যুক্ত হচ্ছেন, কিন্তু এই তুলনায় কর্মসংস্থানের হার একেবারেই কম। এর ফলে আমাদের বাধ্য হয়ে একরকম শ্রম অভিবাসনের দিকে চিন্তা করতে হয়। এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কারণ তাঁরা তাঁদের আয়ের প্রায় পুরোটাই পাঠিয়ে দেন দেশে।
বাংলাদেশের নারীরাও এখন প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। সুনির্দিষ্ট চুক্তি না থাকায়, ছুটির ব্যবস্থা না থাকায় তাঁদের দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়। তাঁরা ঠিকমতো বেতন পান না, এরই মধ্যে কাজের সামান্য ত্রুটি হলে অনেক নারীকে শারীরিক নির্যাতনও করা হয়। অনেক নারীকে নানা ভয়ভীতি বা প্রলোভন দেখানো হয় অনৈতিক সম্পর্কের জন্য এবং যৌন নির্যাতন করা হয়।
প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশের মাটিতে কঠোর পরিশ্রম করেন। তাঁদের আহার-বাসস্থানের সুযোগ-সুবিধাও সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে যেসব পণ্যসামগ্রী আমদানি করা হয়, তার জন্য প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্সের অর্থ ব্যয় করা হয়। বাংলাদেশের আমদানি দ্রব্যের অর্থায়নে প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে সম্পদবৈষম্য সৃষ্টিতে এক অর্থে রেমিট্যান্সের একটি ভূমিকা আছে।
করোনাকালে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পূর্ণ করা আর এযাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান প্রবাসী শ্রমিকদের। গত অর্থবছরে প্রবাসীরা প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন দেশে। পৃথিবীর যে তিনটি দেশ রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে করোনাকালে এগিয়ে ছিল, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর রেমিট্যান্স অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। এ ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও এগিয়ে এসেছেন।
সরকার বিদেশের বন্ধ শ্রম কর্মসংস্থান চালু করা, বিদ্যমান কর্মসংস্থান সুদৃঢ় করা এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান চালু করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অভিবাসী শ্রমিকদের পরিবারের কল্যাণের জন্য ওয়েজ আর্নারস কল্যাণ বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে আরব আমিরাত ও গ্রিসে কর্মসংস্থানের চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অচলায়তনে থাকা মালয়েশিয়ার সঙ্গেও চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে সম্প্রতি। বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিদেশে যাওয়ার খরচ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আয় পৃথিবীর সব দেশের চেয়ে কম। এটি আমাদের অভিবাসীদের প্রধান অন্তরায়। অভিবাসনের ক্ষেত্রে দালালরা সক্রিয়। তাদের নেটওয়ার্ক সরকারি অফিসেও রয়েছে। এসব নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। যেকোনো মূল্যে অভিবাসীদের বিদেশ গমনের খরচ কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
অভিবাসী বা দেশের শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় আইএলও কাজ করে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন রয়েছে। আমরা চাই গোটা বিশ্ব এসব কনভেনশন গ্রহণ করবে। এতে যেকোনো কর্মী বা শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত হবে। শ্রমিকের অধিকার রক্ষার জন্য সামাজিক সুরক্ষা সৃষ্টি করা উচিত। কোনো শ্রমিকের অধিকার ক্ষুণ্ন হলে যেন সব পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে পারে। বেসরকারি খাত সব পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আইএলওর সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা। ২০১৩ সালে অভিবাসীদের নিয়ে নতুন আইন হয়েছে। ২০১৬ সালে নতুন পলিসি হয়েছে। ২০১৭ সালে একটি নতুন বিধি গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে একটি ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট অনুমোদিত হয়েছে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকার আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছে। এখন সরকারের উচিত হবে এসব আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা। অন্যথায় এসবের ফলাফল অভিবাসীরা ভোগ করতে পারবেন না। প্রতি জেলায় প্রবাসী কল্যাণের বিষয়টিকে আরো সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে, যেন অভিবাসীদের পরিবার কাঙ্ক্ষিত সেবা নিতে পারে। এসব সেবা প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া জরুরি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *