বাংলাদেশে দুর্গাপূজা উদযাপন ও সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি


হীরেন পণ্ডিত: বাংলাদেশে পঞ্চাশের দশকেও দুর্গাপূজা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক এক আনন্দঘন আয়োজন। প্রায় প্রতিটি গ্রামে পূজা অনুষ্ঠিত হত এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণ ধর্মীয় ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে সার্বিক সহযোগিতা করতেন। দুর্গাপূজা মণ্ডপের আঙ্গিনায় রামায়ণ কীর্তন, পালাগান, কবির লড়াই অনুষ্ঠিত হওয়ার দৃশ্যই ছিল গ্রামের সকল মানুষের মাঝে আনন্দঘন এক মহামিলনের কেন্দ্রবিন্দু। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে মেলাপ্রাঙ্গনে বসত আনন্দমেলা তাতে নাগরদোলা থেকে আরম্ভ করে মুরগির লড়াই সবই ছিল বিশাল আয়োজনের অংশ। বিভিন্ন রকমের নারিকেলের সন্দেশ, নাড়ু, নানা রকমের পিঠা-মিঠাই-মণ্ডা এসবই ছিল বাংলার শারদীয় উৎসবের প্রধান আকর্ষণ এবং মিলনমেলার অংশ।
সারা বিশ্বে সবার কাছে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা সবাই মিলে পূজা উদ্যাপন করি। আমরা সব ধর্মের বন্ধুরা মিলে শৈশব থেকে একসাথে পূজা দেখে আসছি এবং উদ্যাপন করছি। তবে রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের শাসনামল থেকে বাংলাদেশে এই দুর্গাপূজার প্রথম শুভ সূচনা হয় বলে জানা যায়। একসময় দ্বিতীয় কালাপাহাড়ের অভ্যুদয় ঘটে এবং বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় ধ্বংসের বিভীষিকার সূচনা করে। রাজা কংস নারায়ণ তখনকার দিনে অনেক টাকা ব্যয় করে বিশাল আয়োজনের মাঝে দুর্গোৎসবের উদ্যাপন করে তৎকালীন সারা ভারতবর্ষে ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে তোলেন। রাজা কংস নারায়ণের অনুকরণে ভাদুড়িয়ার রাজা জগৎ নারায়ণ মহাসমারোহে সুরথ রাজার বিধানে বাসন্তী পূজা করলেন। এভাবেই শুরু হল বাংলায় দুর্গাপূজার সমারোহ, শারদীয়া উৎসবের আমেজ। এ সকল আয়োজনের মাঝে বাংলার সামাজিক অঙ্গনে আসে এক নবজাগরণ। সংস্কৃতি অঙ্গনে সূচনা হয় এক বিপ্লব, যা শারদীয়া দুর্গোৎসবের মাঝে বিকশিত হয় বাংলার সকল মানুষের মাঝে এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাকে ছাড়িয়ে সকল ধর্মের লোকজনকে আকর্ষণ করে ব্যাপকভাবে বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ এবং সম্প্রীতির বন্ধন হিসেবে।
দুর্গাপূজা এখন হয়েছে শহরকেন্দ্রিক। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ খুলনাসহ বড় বড় মহানগরে দুর্গাপূজার মহাধুমধাম। অনেক পূজা অঙ্গনে চলে মন্ত্রী, দলীয় নেতাদের প্রশংসা এবং তাদের আগমন ঘিরে বিশাল আয়োজন। চারদিকে ফুলের সমারোহ এসবের মাঝে দুর্গাপূজা যেভাবে দেশের জনগণের মাঝে উৎসবের আমেজ ও সম্প্রীতির বন্ধনে বাংলার মানুষকে বিমোহিত করে, এমনটি অন্য কোনো দেশে দৃশ্যমান হয় না।
সমাজ ও জীবন দর্শন নিরন্তর পরিবর্তনশীল। সমাজের অভ্যন্তরে অবিরত ঘটে চলা দ্বন্দ্ব-সংঘাত বা পার্থিব বিষয় ভাবনা কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে সমাজ বুননে চিরকালীন সহিষ্ণু কাঠামোকে দুর্বল করে ফেলে। শতাব্দী লালিত সম্প্রীতির বন্ধনও কখনও বা ক্লেদক্লিষ্ট হয়ে যায়। সামাজিক পরিসরে ক্ষয়, অসুস্থতা বাড়িয়ে তোলে। আমাদের ভীষণ চেনা পরিসরও মাঝে মাঝে অচেনা হয়ে দেখা দেয়।
শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা করেন ত্রেতা যুগে। বসন্তকালের উৎসব দুর্গাপূজা হলেও নির্দিষ্ট সময়ের আগে অকালে অর্থাৎ বসন্তকালের পরিবর্তে শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র দুর্গাপূজার আয়োজন করেন বলে শারদীয় দুর্গাপূজাকে অকালবোধন বা অকালপূজা বলা হয়। শরৎকাল দেবতাদের পূজার যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজা বলে এই পূজার নাম অকালবোধন।
সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির দেশ বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, ঈদে মিলাদুন্নবী, জন্মাষ্টমী, শারদীয় দুর্গোৎসব, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠান কোনো বিশেষ ধর্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে স¤প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে উদ্যাপিত হয়। জাতীয় চেতনায় ও শান্তি প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই স্লোগান সামনে রেখে সব ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর মানুষ সাড়ম্বরে পালন করে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব।
সব বাঙালির কাছে এ পূজা চিরায়ত ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এক অনুপম প্রীতিময় আনন্দ উৎসব। অশুভ ও অপশক্তির পরাজয় ও শুভশক্তির জয়, সত্য ও সুন্দরের আরাধনায় সর্বজীবের মঙ্গলসাধন শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অশুভ ও আসুরিক শক্তি দমনের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার, সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, সব মানুষের সমধিকার নিশ্চিতকরণ, মানুষের মধ্যকার সব ধরনের বৈষম্য বা ভেদাভেদ ও অন্যায়, অবিচার দূরীকরণ
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশে পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জাঁকজমকের কমতি নেই, পূজার আয়োজনে রাষ্ট্রের শুধু আইনি সুরক্ষা নয়- রয়েছে বৈষয়িক পৃষ্ঠপোষকতা। বহুস্তরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তবু কি আমরা নিঃশঙ্ক, নির্ভয়, নির্ভাবনায় উৎসবে মেতে উঠতে পারি। সংখ্যাবৃদ্ধি বা উজ্জ্বলতাই সব নয়, আসল হল অন্তরের সত্তা। নিরাপত্তাবোধের ঘাটতি উৎসবকে সম্পন্ন করে না।
যে কোনো উপলক্ষ্যই হয়তো প্রাচীন এ জনপদে উৎসবের আকার ধারণ করে। উৎসব যখন মহামিলনের কেন্দ্র হয়ে যায়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিস্ফোরিত জনস্রোতে বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজে পায়। বাঙালির জাতিসত্তা হয়ে ওঠে অনন্য। হাজার বছরের জীবনচর্যা, পরম্পরা, সমাজ বিকাশের ধারা- সবকিছুই এ নৃ-গোষ্ঠীর মানসিক গড়নকে হয়তো এভাবেই প্রস্তুত করেছে। আর বাঙালি জাতি যেসব অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্ব সভায় খ্যাত; চিন্তায়, চেতনায়, জীবনশৈলীতে কৌলীন্যের দাবিদার, নিঃসন্দেহে তার পরিমাপক এ জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত প্রগতিবাদী, সহনশীল ও উদার মানবিক ঐতিহ্য- যার অনুপস্থিতি আমাদের জাতিগত সত্তাসংকটকে প্রকট করে তুলতে পারে। সনাতন ধর্মে দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে নিয়ত যে শক্তি বা তেজ বিচ্ছুরিত হয়; যা সৃষ্টি, পালন কিংবা প্রলয় সাধনে সক্ষম- তাই প্রাচীন শাস্ত্রে প্রকৃতি হিসেবে পরিচিত। এই শক্তি মূলত রূপহীন, নিরাকার। কর্মের মধ্যেই তার সত্তা। কর্মই তার পরিচয়ের মূল উপাদান। সনাতন ধর্মে যে দেবী দুর্গার পূজা করে তিনি দেব-দেবীর সম্মিলিত রূপ, তিনিই দশভূজা, বিশ্বশক্তি, মহামায়া। দেবী প্রসন্ন হলেই ভক্তের ইচ্ছা পূর্ণ হয়- এটিই দেবীভক্তের চিরায়ত বাসনা।
এটা ঠিক যে, বিশ্বব্যাপী এখন একটা অস্থিরতা, ধর্ম-জাতি তথা বিভাজন-বিদ্বেষের লেলিহান শিখা সমাজকে বিপন্ন করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ অসহিষ্ণুতার বিষাক্ত বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে। দশকের ব্যবধানে আমাদের সমাজের চেহারায় কি একটু বদল আসছে, আমাদের আচারে, বিচারে, পোশাকে, কল্পনায়, ভাবনায় আমরা কি অনৈক্যের প্রাচীর তুলতে চাইছি, পরস্পর থেকে পরস্পর কি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি, আমাদের চেতনায় কি বিভেদের সুর ক্রমশই প্রবল হচ্ছে, আমরা কি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হারাচ্ছি, অবিশ্বাস ও বিভাজনের জমাট মেঘ আমাদের আচ্ছন্ন করছে কি না- ভেবে দেখতে হবে। জীবনকে নতুন করে শুরু করার শপথ। সেখানে দ্বেষ নেই, বিভেদ নেই, কলহ নেই; আছে মাধুর্য, সৌন্দর্য, সৌহার্দ্য, সৌভ্রাতৃত্ব। এই বার্তাটি আজ ভীষণ জরুরি। শুধু কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য নয়, কোনো বিশেষ সমাজ বা গোষ্ঠীর জন্য নয়, গোটা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্যই তা ভীষণ প্রয়োজন। অসুর সর্বতো বিরাজমান। তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার আছে এই শপথে। অনাগত ভবিষ্যতের কাছে আমাদের দায় কতটা, তা প্রমাণের জন্য আমাদের হাতে হয়তো আর বেশি সময় নেই। তবে ভরসা রাখতেই হবে কালোত্তীর্ণ এ বিশ্বাসে- অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অশুভের বিরুদ্ধে শুভর বিজয় অনিবার্য। আরো উজ্জ্বল হোক বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের গ্রামে গ্রামে দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হয়নি। এখন অবশ্য সময় বদলেছে, এখন গ্রামেই ঘটা করে ব্যাপক আলোকসজ্জার মাঝে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। শরৎকাল আসার অপেক্ষা করতাম আমরা সবাই। পূজা দেখার জন্য টাকা পয়সা জমানো, যাতে করে অনেক আনন্দ নিয়ে পূজা দেখা যায়। বন্ধু-বান্ধব মিলে সবাইকে নিয়ে আমরা পূজা দেখতে যেতাম। নতুন জামা কাপড় কেনা ছিলো একটি অবধারিত বিষয়। আমরা পায়ে হেটে সব বন্ধু-বান্ধব মিলে পূজা দেখতাম। তখন নেত্রকোণা শহরে দশ-বারোটি পূজা হতো। আমরা পায়ে হেটে সবগুলো পূজা দেখে ফেলতাম। অষ্টমি পূজার দিন অনেক আনন্দ করে পূজা দেখে সিনেমা দেখাটা একটি নির্ধারিত বিষয় ছিলো। বন্ধুদের নিয়ে হৈ চৈ করে পূজা দেখা আর সিনেমা দেখা মনের মাঝে অন্য এক অনুভ‚তি কাজ করতো। এভাবে শিশু থেকে কৈশোর ও যুবক বয়সে পূজা দেখেছি নেত্রকোণায়। ১৯৮৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর আমার নেত্রকোণার পূজা দেখার পালা শেষ হয়ে যায়। নানা ব্যস্ততার কারণে কখনো আর পূজার সময় নেত্রকোণা যাওয়া হয়না। মাঝে মাঝে গ্রামে এবং নেত্রকোণায় যাওয়া হয় কিন্তু পূজার সময় তা একেবারেই হয়ে উঠেনা। এখন ঢাকা শহরের বিভিন্ন পূজা মন্ডপেই পূজা দেখা হয়। কালের বিবর্তনে আজ নিজেই স্বামী ও বাবা রূপ ধারণ করে স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে পূজা দেখা হয়।
বাঙালির দুর্গাপূজা কবে শুরু হয়েছিলো তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় তবে রাজশাহীর কংশনারায়ণ শুরু করেন বলে কথিত আছে। তবে একথা সত্যি যে দুর্গাপূজার ইতিহাস একেবারেই অর্বাচীন নয়। দুর্গাপূজা বৈদিক যজ্ঞের রূপান্তর, যুগে যুগে লৌকিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের একটি মিলনক্ষেত্র ছিলো দুর্গাপূজার প্রাঙ্গণ। অর্থাৎ, দুর্গাপূজা বিভিন্ন শতাব্দী থেকেই ছিল উৎসব। কারো কারো ধারণা, জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণ থেকেই দুর্গাপূজা হয়েছে বাঙালির জাতীয় উৎসব। বৈদিক শারদ যজ্ঞ ছিল সর্বজনীন এক ধর্মানুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানই যুগে যুগে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজা পারিবারিক, বারোয়ারি, তারপর সর্বজনীন রূপ নিয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উদ্যাপিত হচ্ছে দুর্গাপূজা। আমাদের বাংলাদেশে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং পৃথিবীর অনেক দেশের সেই শহরগুলোতে, যেখানে বাঙালি হিন্দু স¤প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। সবাই বছরের এই সময়টা নানাভাবে, নানা ভঙ্গিতে উদ্যাপন করে উৎসবের দিনগুলো। বর্ণিল মাত্রায় আনন্দ উৎসবের আন্তরিক ও বর্ণাঢ্য আনন্দে মেতে উঠি আমরা।
বর্তমান সময়ে পূজা উদ্যাপন, মÐপ তৈরিতে শৈল্পিক নানা প্রচেষ্টা দেখা যায় আগে এতাটা ছিলোনা যা দেখেছি আমাদের ছোটবেলায়। আলোকসজ্জায় প্রযুক্তি উন্নয়নের ধারা যোগ করেছে আশ্চর্য রকম বৈচিত্র্য। উদ্যাপনের অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত, নাটক, ঢাকের বাজনার প্রতিযোগিতা, ছবি আঁকা, নৃত্যকলা, তারকাদের উপস্থাপনা ও কথন আরও কত কী যুক্ত হয়েছে! বর্তমান সময়ে। প্রসাদ বিতরণের বিষযটি আগের মতো আপ্যায়নের ধারায় চর্চিত হচ্ছে পূজা কমিটিগুলোর সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী। সবাইকে নিয়ে ধর্মীয আঙ্গিকে সামাজিক উৎসব উদ্যাপন, নতুন পোশাক, উপাদেয় খাবার-দাবার, আপ্যায়নের আগ্রহ ও উপহার বিতরণসবই প্রতিবছর নতুন মাত্রা তৈরি করে চলেছে। সময়ের গতিময়তা যা আজ সর্বজন আদৃত। পূজার আয়োজনে, সাজে ঐতিহ্যবাহী রূপটাও দেখা যায়, পূজা উদ্যাপনের সঙ্গে আগের দিনে হয়তো এতটা ছিলো না, আমাদের ফেলে আসা ছোট বেলার দিনগুলোতে।
সমাজ প্রগতির নানা অনুষঙ্গের মধ্যে ধর্ম কিংবা ধর্মীয় আচার অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। ধর্মীয় আচার যখন কোনো একটি জাতির জীবনে উৎসবের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয় তখন তা ধর্মীয় চেতনার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে হয়ে ওঠে অগ্রবর্তী সমাজ কাঠামোর ভিত্তিমূলের চলমান সোপান। বাঙালির জীবনে শারদীয় দুর্গোৎসব তেমনি এক বহমান অসা¤প্রদায়িক চেতনসত্তার প্রতিরূপ; যেখানে থাকে না কোনো জাতপাতের বাছবিচার, থাকে না কোনো ভেদাভেদ, থাকে না সা¤প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বাঙালি যে অসা¤প্রদায়িক জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তা প্রতিবছরই প্রমাণিত হয় দুর্গোৎসবের মধ্য দিয়ে। এ কারণেই দুর্গোৎসব হচ্ছে স¤প্রীতির আর বাঙালির আনন্দ-উচ্ছ¡াস উদ্্যাপনের উৎসব এক মহামিলনধর্মী সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক উৎসব।
বর্তমান সরকার অসা¤প্রদায়িক চেতনা বিস্তার ও সম্প্রীতি রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে তবু থেমে নেই নানা অপতৎপরতা। অবশ্য এদেশের সংবিধানের মৌল চেতনাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর সচেতন জনগোষ্ঠী। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু আর আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির যা কিছু প্রাণিত সম্পদ এই হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ। অথচ দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় পাল্টে যায় তার রূপ।
আমরা প্রতিদিন দেখতে চাই-এক অবাক-সুন্দর সকাল ও বাংলাদেশ। মনের অন্ধকার দূর করে আলোকিত হয়ে উঠতে চাই। কিন্তু মনের ভেতরের হতাশার আগুন আমাদের পোড়াচ্ছে। অতি লোভ প্রকৃত ও সরল সুখ থেকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে দূরে। চোখ লোভাতুর হয়ে যাচ্ছে। কামনার ফাঁদে পড়ে আলোহীন হয়ে পড়ছি আমরা। ভোগের বাঁধনে নিজেকে বেঁধে রেখে আলোর পানে আর দৌঁড়াতে পারছি না, তাকাতে পারছি না। মুখে বলছি-সুন্দর সকাল চাই, সুখে থাকার জন্য দিনগুলো চাই। মনের আর মুখের ভাষা এক না হওয়ায় গলদ কিন্তু থেকেই যাচ্ছে আমাদের মনের ভেতরে।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *