আর কত নিচে নামব আমরা

হীরেন পণ্ডিত: মানুষ বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী। যখন সে আইন ও বিচার ক্ষমতাসম্পন্ন থাকে, তখন সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। আর যখন সে আইন ও বিচারক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন সে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম প্রাণী।’ এটি মনীষী অ্যারিস্টটলের কথা। আমরা মানুষ, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, অন্যান্য প্রাণী বা সবকিছু থেকে আমাদের আলাদা করা হয় বিচার-বুদ্ধি ও বিবেকের জন্য। কিন্তু আমরা কি আমাদের বিচার, বুদ্ধি, বিবেক কাজে লাগাচ্ছি বা লাগাই? আমাদের প্রতিদিন কী পরিমাণ নৈতিক স্খলন, বিবেকের স্খলন হচ্ছেÑ তা আমরা ভেবে দেখি না। আমাদের কাছে থাকা মানবীয় গুণাবলি বিসর্জন দিচ্ছি প্রতিনিয়ত, হারিয়ে যাচ্ছে নীতি-নৈতিকতা, লোপ পাচ্ছে আমাদের ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা।
মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে, প্রেম-ভালোবাসা ও দয়া-মায়া, শ্রদ্ধাবোধ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে। আমরা মানবীয় গুণাবলি হারিয়ে ক্রমেই মানুষ হিসেবে নয়, অমানুষ হয়ে হিং¯্র প্রাণীর মতো নিষ্ঠুর আচরণ করছি। এমন কেন হচ্ছে? আমরা যত শিক্ষিত হচ্ছি, আমাদের মধ্যে মানবতাবোধ যেখানে তত বৃদ্ধি পাওয়ার কথাÑ সেখানে মানবতাবোধ প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? শিক্ষিত মানুষের মধ্যে মানবীয় গুণাবলি বেশি থাকার কথা। তা এখন আর তেমন দেখা যাচ্ছে না। আজকাল প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। দৈনিক পত্রিকার পাতা ওল্টালেই দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এসব খবর পড়ে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
নিজেদের প্রাপ্তির জন্য আমরা সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে কাজ করছি। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আছি। দেশ, সমাজ, পরিবার, সন্তানকে নিয়ে ভাবছি আমরা? আর কত সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় প্রয়োজন আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য? আর কতদিন অপেক্ষা প্রয়োজন হবে নিজেদের একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য? সন্তানদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য? এসব প্রশ্ন কার কাছে রাখব? সমাজের কাছে রাখব? রাষ্ট্রের কাছে চাইব? সমাজের অধিবাসীদের কাছে চাইব? সরকারের কাছে চাইব? সবাই নিজেকে নিয়েই শুধু ব্যস্ত রয়েছি। শুধু ভাবছি নিজেকে নিয়ে। সুন্দর একটি দেশ, সমাজ বিনির্মাণের কথা কখনো ভাবি না আমরা। ছাত্রের হাতে শিক্ষক, সন্তানের হাতে অভিভাবক ও গণ্যমান্যদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার খবর এখন সবার গা সয়ে যাওয়া একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বা নিত্যনৈমিত্তিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে! আমরা কি একটি নষ্ট সমাজের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছি? আদব-কায়দা, লাজ-লজ্জা, নিয়ম-কানুনগুলো সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে? এক জংলি সমাজের দিকেই কি পা দিচ্ছি আমরা?
সরকার ব্যস্ত আছে দেশের উত্তরোত্তর কল্যাণের জন্য। আর বিরোধী দলগুলো ব্যস্ত রয়েছে গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য। তাদের ভাষায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য। তবে আমরা যারা সাধারণ জনগণ রয়েছি, তাদের কী হবে? আমাদের নিয়ে কেউ কি ব্যস্ত আছেন অথবা ভাবছেন কিংবা ভাবার সময় কি আছে? এটি মোটেই দৃশ্যমান নয়। আমরা কেমন জানি একটি বেড়াজালের মধ্যেই আছি। জাতি হিসেবে কি আমরা খুব একটা এগোতে পারছি? খুব একটা এগোচ্ছি বলে মনে হয় না। দুই-একটি ভালো অর্জন আমাদের আছে! সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায় কাদা ছোড়াছুড়িতে। তা ছাড়া সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় তো রয়েছেই। এ নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আমাদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
আমরা আমাদের অর্জন ধরে রাখতে পারছি না। শিক্ষক ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে ব্যস্ত থাকেন তার কোচিং সেন্টার নিয়ে। এই ছাত্ররা যে আমাদের ভবিষ্যতের হাল ধরবে, তাদের সেভাবে তৈরি করতে হবেÑ তা নিয়ে ভাবার সময় কি আছে? আর সন্তানের মা-বাবা ব্যস্ত রয়েছেন জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির জন্য। দিনরাত পরিশ্রম করে আনা অর্থ কোনো কাজে লাগছে কিনা, এ বিষয়ে কারও চিন্তা করার সময় নেই। সন্তান কী শিখছে, কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছেÑ এ খেয়াল রাখার মতো অবস্থায় আমরা নেই। কিন্তু কেন? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! কেন এমন হলো, তা নিয়ে সরকার ও নাগরিক সমাজকে ভাবতে হবে। সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এগুলো থেকে বের হয়ে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
আমাদের মধ্যে এমন পশু প্রবৃত্তি বাড়ছে কেন? এই যে সামাজিক অস্থিরতা চলছে, এর শেষ কোথায়? শুধু আইনি কাঠামো দিয়ে এ অবক্ষয় দূর করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক আন্দোলন এবং নাগরিক সমাজকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কেন এমন হলো? বাঙালি উদার ও আবেগপ্রবণ জাতি। পরের উপকার করলে সে ধন্য হয়। এতদিন এটিই জেনে এসেছি, দেখেও এসেছি। কিন্তু এখন বাস্তবে দেখছি এর উল্টোচিত্র। এখন সহনশীলতা ও ধৈর্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। শিক্ষার হার এত যে বাড়ছে, এতে কী লাভ হচ্ছে? শিক্ষিত হয়ে আমরা আরও বর্বরতার দিকে ধাবিত হচ্ছি কিনা, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কোনো ধরনের শিক্ষাই আমাদের মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ববোধ তৈরিতে সহায়ক হচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা ক্রমেই আদিম যুগে ফিরে যাচ্ছি। ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবা জরুরি। একবার খাদের কিনার থেকে ছিটকে নিচে পড়ে গেলে কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়ানো জাতির জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
টাকার জন্য মান-সম্মান ও আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি! অন্যদিকে সমাজ বিনির্মাণে রাষ্ট্রের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে আমাদের যে কিছু দায়িত্ব রয়েছেÑ এগুলো আমরা সঠিকভাবে পালন করছি কিনা কিংবা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি কিনা; সেটি ভেবে দেখার সময় এসেছে। সবকিছুতেই আমাদের ভেজালের ছড়াছড়ি। ওষুধ, খাবার, পরীক্ষাসহ সবকিছুতেই ভেজাল। এমন অবস্থা তো চলতে পারে না এবং চলতে দেওয়া যায় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমদের সব অর্জন ধ্বংস হতে বেশি সময় লাগবে না। একটি ওষুধ কোম্পানির মালিক যদি মনে করেন তার ওষুধে কোনো ভেজাল দেবেন না, তা হলে অন্যরা নিশ্চয় তার ওষুধে ভেজাল দিতে আসবেন না। একজন মালিককে ভাবতে হবে তার কোম্পানির ওষুধ খেয়ে লাখো মানুষ বাঁচবে। তার ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য চেষ্টা করা একেবারেই করা উচিত নয়। একজন খাবারের দোকানের মালিক যদি মনে করেন কম লাভে তার চলবে, তা হলে তাকে খাবারে ভেজাল মেশাতে হবে না।
ব্যবসায় মুনাফা করতে হবে। এটিই নিয়ম। তবে নিজের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে নয়। দেশের মানুষের কল্যাণ হয় না, শুধু নিজের লাভের জন্যই তা আমরা অনেক সময় করে থাকি। শুধু নিজের মুনাফা অর্জনের জন্য আমরা যেন একটি জাতিকে ধ্বংস করে না দিই, এদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে। ওষুধ কোম্পানির মালিক ও খাবার প্রস্তুতকারী কোম্পানির মালিকের এটি মনে রাখতে হবেÑ তার ভেজাল মেশানোর কারণে হাজারো মানুষ অসুস্থ হতে যেতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ভেজাল খাবার ও ভেজাল ওষুধ একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেÑ এদিকগুলো মনে রেখেই কাজ করতে হবে। কিন্তু আমরা কি তা করছি? আমার ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে পারলেই হলো। অন্যের ও দেশের কী হলো, তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর সময় নেই।
একজন শিক্ষকের কাছে থাকা প্রশ্ন যদি পরীক্ষার আগেই ফাঁস হয়ে যায়, তা হলে তিনিই বা কেমন শিক্ষক? তিনিই বা কী নৈতিকতা শিক্ষা দেবেন তার ছাত্রকে! আর জাতি বা তার কাছ থেকে কী আশা করতে পারে? আমি যদি আমার পবিত্র নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দিই, তা হলে তো আর কিছু বলার থাকবে না। আমি আমার দেশকে ভালোবাসিÑ এই স্লোগানে আমাদের সবাইকে এক কাতারে এসে দাঁড়াতে হবে। এ জন্য নাগরিক সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ আগে জাতি হিসেবে আমাদের সব সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় দূর করতে হবে।
নৈতিক অবক্ষয়ের দিক থেকে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। চলুনÑ আমরা আবার সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়াই, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে এক সুন্দর বাংলাদেশে পরিণত করি।
হীরেন পণ্ডিত : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *