হীরেন পণ্ডিত
শুরু হয়েছে নির্বাচনি প্রচার। বিভিন্ন দলের মনোনীত প্রার্থীরা ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছেন। ভোটারদের কাছে গিয়ে নিজ দলের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা। জনগণ হচ্ছে রাজনৈতিক দলের প্রাণ। জনগণের জন্যই রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। দলের জন্য জনগণের জন্ম হয় না। দলের অস্তিত্ব ততক্ষণ থাকে যতক্ষণ জনগণ তা চায়।
জনগণের দেখভালের জন্যই রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি। সেই দল যদি উল্টো জনগণের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে, তা হলে সেই দলের প্রয়োজনীয়তা আর থাকে না। জনগণই একদিন ওই দলকে ত্যাগ করে, বিদায় জানায়। বিএনপি যদি নিজেকে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে মনে করে থাকে, তা হলে এসব কর্মকাণ্ডে নিজেকে আর না জড়িয়ে সুষ্ঠু রাজনীতির স্রোতে ফিরে আসবে।
গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দলের যেমন নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার সুযোগ থাকে, তেমনি অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার প্রতি সম্মান জানানোও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। শুধু নিজের অধিকারের কথা বলবে, অন্যের অধিকারকে খর্ব করবে, সেটি হতে পারে না। নিজের পায়ের শক্তি নিজেকেই অর্জন এবং ধারণ করতে হবে। অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে চলার চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ান, দেশের সম্মান ও কল্যাণ নিয়ে ভাবতে হবে। এ দেশের জনগণই হতে পারে সব রাজনৈতিক দলের শক্তির উৎস।
সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া লক্ষ করা যাচ্ছে। নির্বাচনকে ঘিরে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা কাজ করছে। মানুষ শেখ হাসিনার প্রতি যে ভালোবাসা ও সমর্থন দেখাচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। দেশের মানুষের সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৭ জানুয়ারি দেশের জনগণের মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে তা সবাইকে অভিভূত করেছে।
নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত সব প্রার্থীরা। নিজ নিজ আসনে ভোটারদের কাছে টানতে দিন-রাত কাজ করছেন প্রার্থীরা। ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব তাদের। উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। অন্যদিকে ‘অসহযোগ’ আন্দোলন ঘোষণার পর তা বাস্তবায়নে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে বিএনপি। সারা দেশে গণসংযোগে ভোট বর্জনসহ পাঁচ দফা আহ্বান-সংবলিত লিফলেট বিতরণ করছে। পাশাপাশি হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচিও চলবে।
বিএনপির ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাতে জনগণ ভোট দিতে না আসে সে চেষ্টাই করছে বিএনপি কিন্তু জনগণ নির্বাচনি কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের মানুষ ভোট দিয়ে গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে চায়। দেশের মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার আছে। তাই নির্বাচন ঘিরে উৎসবের আমেজ বয়ে যাচ্ছে। ৭ জানুয়ারি কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটাররা উন্মুখ হয়ে আছেন। বিএনপির অবরোধ, হরতাল মানুষ প্রত্যাখ্যান করছে। প্রতিটি আসনেই উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভোটের আমেজ ধরে রাখার পাশাপাশি ভোটার উপস্থিতিও নিশ্চিত করতে উদ্যোগ রয়েছে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততাই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির শোভা বর্ধন করে। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা যাচাই করা ঠিক হবে না।
সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়টি নির্ভর করছে ভোটারের অংশগ্রহণের ওপর। ভোটাররা যেন নিরাপদে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেন, তারা যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন সেজন্য প্রথমেই প্রয়োজন নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা। এর সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিতেও অগ্রাধিকারে আছে।
দেশের রাজনীতিতে যখনই কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা বিদেশিদের দ্বারা হয়নি, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই তা হয়েছে। ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পরিবেশ এবং তাদের নিরাপদে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ করে তোলা সম্ভব। তবে এ ব্যাপারে আমাদের স্থায়ী সমাধানের কথাও ভাবতে হবে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজিত হয়। নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার আস্থার সংকট, উপযুক্ত কাঠামো বা ব্যবস্থাপনার অভাব নিয়ে নানা মহলের যে অভিযোগ, এর নিরসন দরকার।
জ্বালাও-পোড়াও কিংবা সহিংস রাজনৈতিক পন্থার আশ্রয় না নিয়ে বিএনপির উচিত ছিল নির্বাচন প্রক্রিয়ার ধারা অনুসরণ করে এগিয়ে আসা। কারণ নির্বাচন কমিশনের তরফে স্বচ্ছ নির্বাচনের নিশ্চয়তা যেমন বারবার দেওয়া হচ্ছে, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্বাচনে স্বচ্ছতার ব্যাপারে তার অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি বারবার ব্যক্ত করছেন। একই সঙ্গে আমাদের এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশিদের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে; যদিও এমনটি অনাকাকাঙ্খিত-অনভিপ্রেত। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের যারা নাক গলানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন তারা যেমন দেশ-জাতির জন্য কল্যাণকর কিছু করছেন না, তেমনি নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যও ভালো কিছু করছেন না। তারা নির্বাচনে অংশ নিলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে লড়াই হবে। আর গণতন্ত্রে এমন লড়াই আমরা প্রত্যাশা করি। ভোটের লড়াইয়ে একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তা উৎসবমুখর পরিবেশ গড়ে তোলে। নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে যত অভিযোগ রয়েছে তা প্রতিহত করার অনেক উপায় আছে। এখন প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগ। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ অত্যন্ত জরুরি। সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে জনগণেরই উপকারে আসে। আমাদের রাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, যা জাতির গর্ব। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এই রাজনৈতিক ইতিহাস ও আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে এ দায়িত্ব পালন করা উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকদেরই। আমাদের রাজনৈতিক অর্জনের খতিয়ান অনেক দীর্ঘ-বিস্তৃৃত। নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
কাজেই নির্বাচনি পরিবেশ উৎসবমুখর হবে এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক এমন কোনো পরিস্থিতির যেন উদ্ভব হবে না, যাতে জননিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়ে। সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে জননিরাপত্তায়। একই সঙ্গে রাজনীতির নামে অপরাজনীতির পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে দেশ-জাতির ভবিষ্যতের প্রয়োজনে। পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। গণতন্ত্রে মতভিন্নতা থাকতেই পারে এবং এটাই স্বাভাবিক কিন্তু এ মতভিন্নতা কেন্দ্র করে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব যেন না হয় যা সম্পদ, অর্থনীতিসহ জীবনযাপনের অন্যান্য অনুষঙ্গ কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়।
বিএনপি একটি বড় দল, নির্বাচনে না এসে বিএনপি বড় ভুল করেছে। আমরা সবাই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও প্রশংসনীয় নির্বাচন চাই। বিশ্ববাসীর এই চাওয়ার সঙ্গে আমরাও একমত, আমরাও তা চাই। বাংলাদেশে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। গত ১৫ বছরে এটি শেখ হাসিনার কারণে হয়েছে, আওয়ামী লীগ দলের কারণে হয়েছে। আওয়ামী লীগ যেখানে যা প্রয়োজন, সেই কাজটাই তারা করে।
আওয়ামী লীগের আগামী সময়ের একটি বড় বিষয় হবে যুব কর্মসংস্থান। মানুষের জন্য চাকরির সংস্থান করা। শিক্ষিত বেকার আছে আমাদের। এ জন্য শিক্ষিতের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপি যখন সরকার পতনের আন্দোলনে নানা কর্মসূচি পালন করছে, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের দিকে। একই সঙ্গে কিএনপি দলের কর্মকৌশলের সঙ্গে একমত না হয়ে নির্বাচনে অংশও নিচ্ছেন দলটির বেশ কয়েকজন নেতা।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই উৎসবমুখর নির্বাচনি প্রচার আপামর জনগণকে নির্বাচনমুখী করার অসাধারণ পরিবেশ তৈরি করেছে। দেশের সব নাগরিক, বিশেষ করে প্রচলিত আইনে বয়স কাঠামোয় যোগ্যতাসম্পন্ন ভোটার আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অতিশয় কৌতূহলী প্রণোদনায় উজ্জীবিত, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক মনোনয়ন যাচাই-বাছাই ও প্রতীক বরাদ্দের পর দলীয়- জোটভুক্ত-স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজস্ব প্রচারে নানামুখী ইতিবাচক কৌশল গ্রহণ করেছেন। জনগণের আস্থা অর্জনে প্রত্যেক প্রার্থী নিজ নিজ উদ্যোগে ভোটারদেও ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানাচ্ছেন। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে অর্থবহ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী-প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ প্রয়োজনীয় লোকবলের রদবদল প্রায় সম্পন্ন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের দিনে সকালে ব্যালট পেপার পৌঁছানোর যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
দেশবাসী ও দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বৈশ্বিক অংশীজন-দেশ-দাতাসংস্থার পক্ষ থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। মূলত জনগণের গভীর বিশ্বাস, অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে ধারাবাহিকতায় অধিকতর গৌরবোজ্জ্বল করার জন্য দেশি-বিদেশি সব মহলের সমর্থন প্রয়োজন। সবার কাছে এটি সুস্পষ্ট হবে বর্তমান সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের সুন্দর একটি নির্বাচন উপহার দেওয়া সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষক্ষ নির্বাচনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। গত ২৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রধানমন্ত্রী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষক্ষ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই বলে মন্তব্য করেন। ওই সভায় দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আপনাদের ভোটের অধিকার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রয়োগ করবেন। যাকে খুশি তাকে ভোট দেন, আমাদের সে বিষয়ে কোনো কথা নেই। আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব-এটাই আমাদের স্লোগান। নানা ধরনের অপপ্রচার-নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে অর্থনৈতিক সচলতাকে অতিশয় চলমান রাখার উদ্দেশ্যে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই মুখ্য। সব অশুভ অপতৎপরতাকে সংহার করে পরিচ্ছন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অধিকাংশ সদস্যের রায়ে পরবর্তী সরকার গঠন সত্যিকার অর্থে একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়।