হীরেন পণ্ডিত: স্মার্ট দেশের জন্য প্রয়োজন স্মার্ট নাগরিক। স্মার্ট নাগরিকের হওয়ার জন্য প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষা। স্মার্ট শিক্ষার জন্য প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা, স্মার্ট পরিবেশ, চেতনাদীপ্ত দেশপ্রেমী, স্মার্ট জনবলের সম্মিলিত প্রয়াস। সম্মিলিত প্রচেষ্টার অন্যতম শর্ত সংশ্লিষ্ট অংশীজনের যথাযথ অংশগ্রহণ ও কার্যকর ভূমিকা। পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সব পর্যায়ে অংশীজনকে সম্পৃক্তকরণ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবেরও অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পরিবর্তন, সংস্কার বা রূপান্তর সব ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে কর্মমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই। উচ্চ শিক্ষা শেষে কৃষি খাতে ফিরে না যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। শিক্ষাকে করতে হবে বহুমুখী। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে আমাদের শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার থাকতে হবে যথাযথ মান। শিশু, প্রতিবন্ধিতা ও জেন্ডার সংবেদনশীল শিক্ষা সুবিধা নির্মাণ ও মানোন্নয়ন এবং সবার জন্য নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করাই জরুরি। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, কারিগরি, প্রকৌশল ও বিজ্ঞানসংশ্লিষ্টতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা দরকার।
জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ তে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সার্বিকভাবে শিক্ষার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। রূপরেখাটি ২০২১ সাল থেকে দু’টি শ্রেণিতে পাইলটিং শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে পূর্ণ বাস্তবায়নের পর্যায়ে যাবে। এতে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচি ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। দশম শ্রেণির আগের সব পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছে।
এ পর্যায়ে পুরোটাই মূল্যায়ন হবে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিকভাবে শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে। বিভিন্ন বিষয়ে কিছু মূল্যায়ন শিখনকালীন কার্যক্রমের ভিত্তিতে এবং কিছু অংশের মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে হবে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পদ্ধতিতেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। এছাড়া থাকছে না নবম শ্রেণিতে বিভাগ পছন্দের সুযোগ। এর বদলে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো বিভাগে পড়তে পারবেন।
রূপরেখা অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক স্তর, অর্থাৎ নার্সারি ও প্লেতে শিশুদের জন্য এখন আর কোনো বই থাকবে না। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরাই তাদের সরাসরি শেখাবেন। এরপর প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের তিনটি বই পড়ানো হবে, কিন্তু কোনো পরীক্ষা থাকবে না। বছরব্যাপী চলা বিভিন্ন শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। চতুর্থ শ্রেণি থেকে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিখন কার্যক্রম ও পরীক্ষা দু’টোই থাকবে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই কিন্তু নিরক্ষতা দূরীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং এর ফলে এখন প্রায় শতভাগ জনগোষ্ঠী শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। সাক্ষরতার হারে আঞ্চলিক মানদণ্ড বাংলাদেশ এখন ভারতসহ অনেক দেশের থেকেই এগিয়ে। তাছাড়া অর্থনৈতিক চাহিদা অনুযায়ী কৃষি, প্রকৌশল, মেডিক্যাল ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মতো বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরাসরি আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারছে।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। পর্যায়ক্রমে আমাদের এ ব্যবস্থায় যেতেই হবে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, শুধু শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনাই নয়, বরং পারিপার্শ্বিক, আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে শিখনকে এ শিক্ষাক্রমে মূল শিখন কৌশল হিসাবে নেওয়া হয়েছে। নিজের কাজ নিজে করার যে শিক্ষা, তা কেবল পরিবার নয়, বরং প্রাক ও প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত থাকা জরুরি।
নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। বিভিন্ন ধরনের তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, অভিভাবকরা যেমন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, তেমনি শিক্ষকরাও খানিকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন। ফলে এর বিরূপ প্রভাবগুলো বাচ্চাদের ওপর পড়ছে বেশ প্রকটভাবে।
নতুন রূপরেখা নিয়ে কিছু মানুষ ঢালাও সমালোচনা করলেও অনেক শিক্ষাবিদসহ সচেতন মহল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য বিবেচনায় নিয়ে রূপরেখার ইতিবাচক বিষয়গুলো প্রশংসাযোগ্য ও সাহসী বলছেন এবং একইসঙ্গে কিছু যৌক্তিক সমালোচনাসহ মতামত তুলে ধরছেন। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রজেক্ট ও অ্যাসাইনমেন্টের সংযোজন অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতির জায়গায় এক ধরনের বৈপ্লবিক চিন্তাও বটে; কিন্তু প্রজেক্টভিত্তিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শ্রেণিশিক্ষকের পর্যবেক্ষণ আবশ্যক এবং সেটা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্তসংখ্যক মানসম্মত শিক্ষক। বাংলাদেশে এমনিতেই শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল, তাই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বর্তমান পদ্ধতি বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
দ্রুততম সময়ে নতুন শিক্ষাক্রম, নতুন পাঠ্যপুস্তক, শিখন-শিক্ষণ, মূল্যায়ন পদ্ধতি ভালোভাবে শিক্ষকদের বোঝাতে হবে। ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণের পর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আবার শহর ও গ্রামে নানা বৈষম্য আছে। কাজেই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত ও মেধাবী শিক্ষকদের নিয়োগের যেমন ব্যবস্থা করতে হবে, তেমনি তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি যৌক্তিক তদারকি ও নজরদারির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
শিক্ষার্থী ছাড়া শিক্ষক ও অভিভাবকরাও শিক্ষা ব্যবস্থার অংশীদার। তাই তাদের বাদ দিয়ে শিক্ষা খাতে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণেও তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জোরালো করা দরকার। প্রায়োগিক ক্ষেত্র সৃষ্টি না করে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে কোনো সুফল বয়ে আনা অসম্ভব। বন্ধ করতে হবে গাইড ও কোচিংয়ের রমরমা ব্যবসা। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্যবই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনাও জরুরি।
শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে কর্মজগতের সংযোগ স্থাপনে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। আমাদের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী উচ্চ শিক্ষায় এলেও অনেকের সুনির্দিষ্ট ক্যারিয়ার প্ল্যান নেই। ফলে তারা তাদের জ্ঞানকে কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছে না। বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রমও চালু করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী মাধ্যমিকে দক্ষ, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংকট রয়েছে। বিশেষত ইংরেজি, গণিত, আইসিটি, বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোয় এ সংকট অত্যন্ত প্রকট। সরকার শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।
এখন নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষায় চাপ কিছুটা কমানো হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী আগে আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাপ ছিল। এখন এটি কমানো হয়েছে এবং এ পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীর যতটুকু শেখা প্রয়োজন সেটাই শেখানো হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদের যতটুকু শেখানো হচ্ছে তার জন্য বিজ্ঞানের বিষয়সমূহে স্নাতক সম্পন্নকারী শিক্ষকই যথেষ্ট।
নতুন পদ্ধতিতে কেমিস্ট্রির শিক্ষকের পক্ষে বায়োলজি পড়ানো বা গণিতের যিনি শিক্ষক তার পক্ষে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানো সম্ভব হবে। শিক্ষাক্রমে চাপ কমানোর ফলে শিক্ষকদের ওপরও চাপ কমে আসবে এবং বিশেষায়িত শিক্ষকের সংকটও কিছুটা নিরসন হবে। শিক্ষকদের সঠিকভাবে বিষয়গুলো শেখানোর জন্য তাদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। তবে বিষয়ভিত্তিক স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষক কলেজ পর্যায়ে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কারণ কলেজ পর্যায়ে যা শেখানো হবে তার জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রয়োজন হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চালু, শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি বাধ্যতামূলক করায় আইটি খাতেও ক্রমেই বাংলাদেশ সক্ষমতা অর্জন করছে এবং এর ফলে দেশের বাইরে বিভিন্ন আইটি পণ্য যেমন সফটওয়্যার, কেবল রফতানি শুরু হয়েছে।
আগে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মুখস্থনির্ভর। কে কত ভালো মুখস্থ করছে তার ওপর নির্ভর করে ফলাফল তৈরি হতো। শিক্ষার্থীরা তখন পড়ত পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য। অল্প সময়ে ভালো ফলাফলের প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হচ্ছিলেন কোচিং এবং গাইড বই ব্যবসায়ীরা। নতুন শিক্ষাক্রমে এ সুযোগ থাকছে না। শিক্ষার্থীরা এখন হাতে-কলমে শিখবে। তবে নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এখন যেভাবে আছে এটি একেবারে শতভাগ স্থায়ী তা কিন্তু নয়।
এরই মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বেশকিছু ইনপুট এসেছে সরকার সেগুলো নিয়ে পরামর্শ গ্রহণ করছে। মূল্যায়ন পদ্ধতির একটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো সরকার দেখছে। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে আরো পরিবর্তন আসতে পারে। বিভিন্ন পর্যায়ের পরামর্শগুলো সরকার সবার সাথে আলোচনা করে সমাধান করবে। সরকার একটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটি হলো ১২ বছর বয়সে একজন শিক্ষার্থীর ন্যূনতম যে দক্ষতা ও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, ১৬ বছর বয়সে একজন শিক্ষার্থীর যে দক্ষতা ও জ্ঞান থাকা দরকার সেটি যেন ওই বয়সী সব শিক্ষার্থীর মধ্যেই নিশ্চিত হয়।
শিক্ষার নেতৃত্ব দিবেন শিক্ষাবিদরা, যারা কর্মদাতা আছেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষার কারিকুলামগুলোকে সাজাতে চায় সরকার। অর্থাৎ এখন শিক্ষার সাথে অর্থনীতির সংযোগ সাধনের চেষ্টা করছে সবাই কাজের ধরন পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা শিক্ষার জায়গাগুলো পরিবর্তন করতে পারি। কর্মসংস্থান এর চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মাঝে সফট স্কিল, হার্ড স্কিল ডেভেলপ করা যায় সরকার সেভাবেই কাজ করবে।
এক্ষেত্রে চতুর্থ থেকে শ্রেণিভেদে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ এবং পরীক্ষা হবে অবশিষ্ট অংশে। তবে বেশকিছু বিষয়ের মূল্যায়ন শতভাগ ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে করা হবে। শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের দক্ষতা, উপস্থাপন, ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট বা বাড়ির কাজসহ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। শিক্ষার্থীদের এখন নবম ও দশম শ্রেণিতে অভিন্ন সিলেবাসে পড়ানো হবে এবং অভিন্ন দশটি বিষয়ের ওপর এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে, সেটাই হবে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা।
পরে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য এ তিনটার মধ্যে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো বিভাগ বেছে নিতে পারবেন। বর্তমান প্রচলিত এইচএসসি পরীক্ষার পরিবর্তে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দু’টি আলাদা পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয় করে এইচএসসির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হবে। এক্ষেত্রে আবশ্যিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন বা পরীক্ষা হবে ৭০ শতাংশ।
নতুন রূপরেখায় ভবিষ্যতের জন্য সম্পূর্ণ নতুন কিছু দিকদর্শন উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে রূপান্তরমূলক দক্ষতার কথা বলা হয়েছে-শিক্ষার্থী বিবিধ বিষয়ের তাদের অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বিতভাবে কাজে লাগিয়ে বাস্তব জীবনের যে কোনো স্তরে এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে কাজে লাগাতে পারবে, জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা নেওয়ার জন্য অভ্যস্ত হবে। নিঃসন্দেহে এটি খুব যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।
নতুন শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ওপর নজর দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসেন না। কাজেই মেধাবীদের আনতে হলে তাদের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। হবে। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের বাড়ির কাজ করানোর বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা, ভালো কাজে উৎসাহ দেওয়া, সততা ও নৈতিকতা বজায় রাখাসহ নানা বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অভিভাকদের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে হবে। অভিভাবক, শ্রেণিশিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে এটা দূর করতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমে ‘কৃষি শিক্ষা’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থায় কৃষিকে গুরুত্ব খুবই কম দেওয়া হয়েছে মর্মে সমালোচনা রয়েছে। কৃষি শিক্ষাকে কীভাবে আরও কিছুটা সংযোজন করা যায়, সেটা ভাবা যেতে পারে। পাঠ্যপুস্তকে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বিষয় জাতীয় শিক্ষাক্রমে স্থান পেয়েছে।
‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১’ পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অর্জিত সক্ষমতাকে যোগ্যতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক ও সাহসী সিদ্ধান্ত। দেশে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠুক, যাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা একুশ শতকের উপযোগী আধুনিক, দক্ষ, শিক্ষিত ও বিকশিত মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে। যে কোনো নতুনত্বই এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে নির্দিষ্ট সময় পরপর বাস্তব ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাক্রম মূল্যায়ন ও যুগোপযোগী করা হয়।
আমাদের দেশে যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রমটি শুরু হয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রম একাধারে আন্তর্জাতিক মানের এবং আমাদের স্থানীয় সমস্যার সাথে সমন্বয় করে করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত উদ্ভাবিত নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে নিজেরা নেতৃত্বের জায়গায় টিকে থাকতে পারে। নতুন শিক্ষাক্রম এমন বিশ্বনাগরিক তৈরি করবে, যা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে ভূমিকা রাখবে এবং একইসঙ্গে একুশ শতক তথা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকবে, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক