হীরেন পণ্ডিত: বাংলাদেশকে চাপে রাখার নতুন নতুন কৌশল নিয়ে সব সময় ব্যস্ত, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় প্রভাবশালী বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র। গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে বা বলা যায়, সুযোগ না পেয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না মনে করেও ভোট নিয়ে ভিন্নমত আছে বলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আবার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ করে নিতে চাইছেন।
এবার বাংলাদেশের জনগণের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ রক্ষাসহ আরো কিছু বিষয় নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের মুখপত্র ম্যাথু মিলার ও ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত আরেক মুখপত্র বেদান্ত প্যাটেল স্বীকার করেছেন ৭ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন (তাদের ভাষায়) সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না মনে করলেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ দেশটি। এদিকে নির্বাচনের সময় ভোট নয়, সহিংসতা পর্যবেক্ষণের জন্য টিম পাঠিয়েছিলো তারা। তাদের পর্যবেক্ষণের প্রতিবেদনও নিশ্চয়ই তাদের সামনে রয়েছে। তবে এদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য পরিবেশ কাদের জন্য খারাপের দিকে গিয়েছে সে দিকে দৃষ্টি দিলে এদেশের মানুষ আরো খুশি হতেন। তবে আমাদেরকে আশাবাদী করছে সবকিছুই, এবার যদি কিছু হয়, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবার ঠিক না হয়ে কোথায় যাবে?
পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। সম্প্রতি সচিবালয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা জানান তিনি। তিনি আরো জানান ভবিষ্যতে উভয় দেশ কীভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে অরো এগিয়ে নিতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকটি আমাদের অংশীদারত্বকে সুদৃঢ় করতে এবং সহযোগিতার জন্য নতুন উপায় খুঁজতে একটি ফলপ্রসূ পদক্ষেপ।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস উল্লেখ করেন, কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ অন্যান্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাবে। আমরা বাংলাদেশের জলবায়ু লক্ষ্যগুলোকে সমর্থন করার জন্য আমাদের অংশীদারত্বকে শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। আমরা আমাদের উভয় দেশের জন্য আরো জলবায়ুসহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে একসঙ্গে কাজ করে যাব।
পরিবেশমন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত উভয়েই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়াতে সহযোগিতামূলক উদ্যোগ বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
আগামী এক বছরের মধ্যে দেশের জলাভূমিগুলোর ম্যাপিং করা হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। বিশ্ব জলাভূমি দিবস উপলক্ষে গতকাল রবিবার বন অধিদপ্তরে আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ তথ্য জানান। জলাভূমি আমাদের পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য জলাভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে নদ-নদী আছে, খাল বিল আছে সব কিছুই জলাভূমির সম্পদের মধ্যে পড়ে। একদিকে নদী নিয়ে আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ আছে, অন্যদিকে দখল ও দূষণ। সব বিষয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।
এখানে একটা সমন্বয়ের বিষয় আছে। তবে আমাদের যতটুকু দায়িত্ব আছে সেটি আসলে আমরা কতটুকু পালন করছি- এই প্রশ্নটিও চলে আসছে। আমাদের ১৩টি ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া আছে। এর মধ্যে একটি সুন্দরবন ছাড়া বাকি ১২টি শুধু ঘোষণা পর্যায়ে আছে। ঘোষণাকে আমরা কীভাবে কার্যকর করব? এটা আমাদের একটা অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ কিন্তু এই সম্পদের ব্যবহার আমরা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছি? আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের আলোচনা করি তাহলে সেখানে আমাদের এই প্রাকৃতিক সম্পদের ভূমিকা কী হবে? আমি এটাকে কতটুকু কাজে লাগাতে পারব? এ সময় দেশের সব প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার্থে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় আরো কার্যকর করার তাগিদ দেন তিনি।
দিবসের মধ্যে আটকে না থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে পরিবেশমন্ত্রী বলেন, আজ যদি বিশ্ব জলাভূমি দিবস না থাকত তাহলে আমরা এখানে এই ধরনের আলোচনার সুযোগ পেতাম না। আমরা চাই, সত্যিকার অর্থে সমাধানের জন্য আলোচনা করতে। আমি চাই, বন অধিদপ্তর আগামী এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের মধ্যে দিনব্যাপী একটা আলোচনার আয়োজন করবে। আগামী এক বছর আমরা কোন কাজটা করব সেই লক্ষ্যটা যাতে নির্ধারণ করতে পারি। সেই দলও দিতে পারেনি বড় ধরনের ব্যত্যয়ের তথ্য। এখন কি তবে নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য ভিন্ন মতের কথা বলছে তারা?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের কয়েকটি দেশের নানা রকম অযাচিত কর্মকান্ড এবং দৌড়ঝাঁপের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে বিজয়ের পর বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরা অভিনন্দন জানান শেখ হাসিনাকে। ঢাকায় থাকা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও মিশন প্রধানরাও সশরীরে গণভবনে গিয়ে অভিনন্দিত করেন আওয়ামী লীগ সভাপতিকে।
কিন্তু চুপ ছিল কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে সম্প্রতি শেখ হাসিনাকে চিঠি লেখেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। চিঠিতে বাইডেন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে পাশে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। উন্মুক্ত ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল গড়ে তুলতে যৌথভাবে কাজ করারও প্রতিশ্রুতি দেন জো বাইডেন।
এছাড়া আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি ও বৈশ্বিক বিষয়ে একত্রে কাজ করার আশা প্রকাশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু চিঠিতে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় কিংবা নতুন সরকার গঠন নিয়ে কোনো বার্তা ছিল না। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে গেল বছরখানেক ধরেই নাওয়া-খাওয়া ভুলে দৌড়ঝাঁপের মধ্যে ছিলেন পিটার হাস। কখনো রাজনৈতিক দল ও তোদের দুয়ারে ধর্না দিয়েছিলেন তিনি। আবার বিএনপি জামায়াত ও জাতীয় পার্টির নেতারা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে দফায় দফায় বসেছেন তার সঙ্গে।
সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের ধুয়া তুলে নানা সবক দেয়ার চেষ্টা করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। কিন্তু গেল বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের নামে বিএনপি জামায়াতের নজিরবিহীন তাÐবের পর নীরব হয়ে যান পিটার হাস। তবে মন্ত্রিসভার শপথের সময় বঙ্গভবনে ছিলেন তিনি।
পরদিনই তিনি দেখা করেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে। এরপর ধারাবাহিকভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে কথা বলে আসছেন পিটার হাস। সবশেষ ৪ ফেব্রæয়ারি সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন তিনি।
নির্বাচন নিয়ে কী কথা হয়েছে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের পরিবেশমন্ত্রী জানান, ‘‘পিটার হাস বলেছেন, ‘তারা মনে করেন, বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। তারপরও তারা সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।’’ এদিকে পিটার হাসও সব মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেই গণমাধ্যমে একটি কথা বলে আসছেন – নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমত আছে তাদের। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মজবুত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তারা। তবে বিশ্লেষকদের মতে, একসঙ্গে কাজ করা তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, পিটার হাস আসলে মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার অপকৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছেন কিনা তা জানার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে।
তাদের মতে, নির্বাচনের পর থেকে পিটার হাসের মন্তব্য এবং বাইডেনের চিঠির ভাষা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হলেও ৭ জানুয়ারির ভোট নিয়ে দেশে-বিদেশে এক অস্বস্তি তৈরি করতে চায় দেশটি। কারণ অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র খুব করে চেয়েছিল বাংলাদেশে তাদের পছন্দের সুশীলদের নিয়ে একটি অনির্বাচিত সরকার নিয়ে আনতে।
২০০৬-২০০৭ সালে ঢাকার সে সময়ের মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারিকে টমাস ও প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠায় সফল হলেও, এবারে ব্যর্থ হয়েছেন পিটার হাস ও বাইডেন প্রশাসন। আবার এবারে বিএনপি না এলেও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বড় কোনো সুযোগও পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে, একদিকে বাংলাদেশকে অস্বস্তিতে ফেলার পাঁয়তারা তাদের। আরেকদিকে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ভোট নিয়ে ভিন্নমত আছে বলে মন্তব্য করছে।
এই প্রেক্ষাপটে পর্যবেক্ষকরা, প্রয়োজনে সরকারের মন্ত্রীদের উচিত হবে পিটার হাস তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও নির্বাচন নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার জন্য তাঁকে একটু পরামর্শ দেয়া রাখা। বিশে^র গণতন্ত্রের একমাত্র প্রভাবশালী ধারক ও বাহক যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী বক্তব্য থাকে এক দিকে যা অনেকটাই দৃশ্যমান, কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক বিষয়টা থাকে আরেক দিকে সেটা ক্রমশ দৃশ্যমান। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রয়েছে, যারা এই নির্বাচনকে সাধুবাদ জানিয়েছে। নির্বাচনের পরপরই তারা সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বক্তব্য ছিল যে এটি সুষ্ঠু হয়নি। কিন্তু একই সঙ্গে তারা বলেছে যে- সরকারের সাথে কাজ চালিয়ে যাবে। এখন দেখার বিষয়, সরকার যেসব দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করা শুরু করবে, সেখানে আমেরিকা কতখানি প্রবেশগম্যতা পায়। মার্কিনিদের এমন আচরণের বিষয় তারা এ দেশে গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার বাস্তবায়ন করতে আসেনি। তিনি নিজ দেশের স্বার্থই দেখছেন বা দেখবেন এটা আমরা যত দ্রæত বুঝতে সক্ষম হবো ততই মঙ্গল। নির্বাচনের আগে পিটার হাস যেসব কথা বলেছিলেন, তাও নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্যই বলেছেন। এখন যা বলছেন মূলত তাদের জাতীয় স্বার্থই এখানে আসল।
‘বাংলাদেশে আজকে তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চাপ প্রয়োগ করেছে। যেমন, শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে। চাপ প্রয়োগ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তারা এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য কমাতে চায় এবং এটা কমানোর জন্য তারা এসব ইস্যু সামনে নিয়ে আসে।
তবে পিটার হাস এর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারণে নয় আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্য আমরা পরিবেশ বাচাবো, জলবায়ু পরিবর্তন থেকে দেশ বাঁচবো, দেশ বাঁচলেই আমরা বাঁচব। আমাদের অসচেতনতার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। জীবনধারণের স্থান ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই সচেতন না হলে শুধু আইন প্রয়োগে খুব বেশি সফলতা আসবে না। পরিবেশকে বিবেচনায় না রেখে একটি সুন্দর পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। পরিবেশ আর উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্ক পরস্পরবিরোধী নয়। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। পরিবেশকে রক্ষা করে দেশের উন্নয়ন না করলে তা টেকসই হবে না। এজন্য শুধু সরকার বা বিভিন্ন সংস্থাকে কাজ করলে চলবে না, সমাজের প্রত্যেক মানুষকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করত হবে। পরিবেশ বাঁচিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সম্ভব করতে হবে।
ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ নদ-নদী এখন দখল-দূষণ-বর্জ্যে মৃতপ্রায়। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই আগ্রাসী থাবায় নদী আজ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। যে কোনো নদীর পাড়ে চোখ মেলে তাকালেই দখলবাজির পরিমাণটাও স্পষ্ট হয়ে যায়। অবস্থা এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছে, অনেক নদ-নদীর অস্তিত্বই এখন হুমকির সম্মুখিন। অনেক নদীকে আর বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। দখল ও দূষণের কারণে গত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে।
২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে গিয়ে হয়েছে ৬ হাজার কিলোমিটার এর মতো। কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। নদী-জলাশয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশ সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, একেবারে শীর্ষ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের পদাধিকারীরা বলে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশও খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সংকট তাহলে কোথায়? দখল-দূষণকারীদের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃঢ়তায় ও সদিচ্ছায় অভাব রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।
বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়, কিছু দূর যাওয়ার আগেই তা আবার থেমে যায়। নদ-নদী রক্ষা করতে হবে জাতীয় স্বার্থকে সব ধরনের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে। নদী রক্ষায় নীতি ও আইন রয়েছে। এসব নীতি ও আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি পানি ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে হবে। নদীকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দিতে হবে।
দেশের স্বার্থে নদী রক্ষা করতে হবে। বাঁচাতে হবে দেশের সব নদী। সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী সংস্কার ও পরিচর্যার গুরুত্ব বিবেচনা করেই কাজ করতে হবে। নদী না বাঁচলে বাংলাদেশকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে, অর্থাৎ বাংলাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। আমাদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য সবকিছুর সঙ্গে আমাদের নদীগুলো সম্পর্কযুক্ত। হাজার বছর ধরেই এসব নদ-নদী আমাদের কৃষি, প্রকৃতি ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। নদী রক্ষা না করলে তাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা পাবে না। এ জন্য নদী রক্ষাকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে নদ-নদী বাঁচাতে খুব দ্রæত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে নদী মাতৃক বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে নদী রক্ষা তথা নদীর নাব্যতা ধরে রাখার বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়নেও প্রয়োজন নদী রক্ষা ও পানির সঠিক ব্যবহার। নদীই বাংলাদেশের প্রাণ। কাজেই দেশের প্রাণশক্তি রক্ষা করতে হলে নদী দখল বন্ধ ও নদী দূষণরোধ করতেই হবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সংরক্ষণ করে যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যায় তাকে টেকসই উন্নয়ন হিসেবে গণ্য করা হয়। সরকার এজন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এমডিজি বাস্তবায়ন করেছে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (২০১৫-২০৩০) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে নদীগুলো ঘন ঘন গতিপথ পরিবর্তন করে। ফলে বাংলাদেশে চর জেগে উঠা জমি একটি সাধারণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে এবং চাষযোগ্য জমি ক্রমশ কমছে। সারা বাংলাদেশে ৩২টি জেলায় প্রায় ১০৯টি চর উপজেলা রয়েছে। ছোট এই দেশের মধ্যে দিয়ে ছোট বড় সাতশর মতো নদী বয়ে গেছে। মানুষের পেশা, জীবনযাপন এবং সাহিত্য সংস্কৃতি সবকিছুই নদীর উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্ভরশীল। আমাদের দেশে নদীর কাছে যে জমি চাষ করা হয় তাতে ব্যবহার করা হয় নদীর পানি। উৎপাদিত ফসল শহরে নিয়ে যাওয়া হয় নদী পথে। নদী আমাদের সমাজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং জাতীয় জীবন অর্থনীতির চালিকা শক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম উপাদান হিসেবে ভ‚মিকা পালন করছে। নদীর গুরুত্ব বোঝাটা তাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রত্যাশিত বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা বাড়বে ৫০ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে হবে ৭০ শতাংশ, যেখানে হাইড্রো পাওয়ার এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদসহ মোট জ্বালানি চাহিদা বাড়বে ৬০ ভাগ। বর্ধিত কৃষি উৎপাদনের জন্য বিপুলভাবে পানি ও জ্বালানি চাহিদা উভয়ই পানি ব্যবহৃত ক্ষেত্রগুলোয় প্রতিযোগিতা বাড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির জন্য আঞ্চলিক অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম। তার জন্য ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে সমঝোতা রয়েছে তার ভিত্তিতেই আমাদের নদী ব্যবস্থাপনা জোর দিতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে হবে। নদী ও পরিবেশ রক্ষা করে আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নদী রক্ষায় ১৯৯৯ সালের পানি নীতি এবং ২০১৩ সালের ওয়াটার অ্যাক্ট বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে নদী সমস্যার সমাধান করা জরুরি। তার জন্য সবার আগে যে কোনো পরিকল্পনার সাথে ভুক্তভোগি ও ক্ষতিগ্রস্তদের সম্পৃক্ত করে কাজ করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির জন্য আঞ্চলিক অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব প্রদান খুব জরুরি। তার জন্য ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে সমঝোতা রয়েছে তার ভিত্তিতে আমাদের নদী ব্যবস্থাপনা জোর দিতে হবে। দেশের স্বার্থে, ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে আমাদের পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক