হীরেন পণ্ডিত: চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত। প্রযুক্তির এই প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে, আবার নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে। ধনী ও গরিব দেশের পার্থক্য বেড়ে যেতে পারে। কাজগুলো ভাগ হয়ে যাবে অদক্ষ-স্বল্প বেতন ও অতি দক্ষ-অধিক বেতন, এসব শ্রেণী বিভাগে দক্ষ ব্যক্তিরা কাজ পাবে, অদক্ষ ব্যক্তিরা বেকার হয়ে যেতে পারে। মানুষের শরীরে চিপস অনুপ্রবেশ করিয়ে রেখে দেয়ার প্রযুক্তি বের হয়েছে। ভবিষ্যতে শরীরে স্থাপিত চিপস স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতে পারবে। তবে চিপসের কারণে মানুষের ব্যক্তিজীবন বা গোপনীয়তা ক্ষুন্ন পারে।
এসব স্মার্ট যন্ত্র বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে পোশাক শিল্প। প্রায় ৬০ লাখ শ্রমিক কাজ করে এ খাতে। রোবট ও স্মার্ট যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে এসব শ্রমিকের ওপর নির্ভরতা কমে যাবে। অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যেতে পারে। শুধু পোশাক শিল্প নয়, আরো অনেক পেশার ওপর নির্ভরতা কমে আসবে, রোবট এবং যন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে। চালকবিহীন গাড়ি চালু হলে চালকের চাকরিও অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়াবে। উন্নত বিশ্বে চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, চালকবিহীন গাড়ি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও দক্ষ হবে। এছাড়া এরা ট্রাফিক জ্যাম ও দূষণ কমাবে। আমাদের দেশের অনেক চালক চাকরি হারাবেন। অন্যদিকে মেধাভিত্তিক পেশার প্রয়োজন বাড়বে যেমন প্রোগ্রামার, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইনটারনেট অফ থিংস (আইওটি) ইত্যাদিতে দক্ষ লোকের চাহিদা বাড়বে। আমাদের দেশে দক্ষ প্রোগ্রামারের অনেক অভাব আছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে আসবে। আমাদের দক্ষ প্রোগ্রামার তৈরি করতে হবে।
ডিজিটাইজেশনের কারণে এখন প্রচুর ডাটা তৈরি হচ্ছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি, কোথায় কতক্ষণ সময় ব্যয় করছি, তার উপাত্ত আমাদের স্মার্ট গাড়ি পাচ্ছে। আমাদের ব্যাংক হিসাব, মোবাইল ওয়ালেট, ক্রেডিট কার্ড মিলে আমাদের খরচের হিসাব দিতে পারে। আমরা কী দেখছি তা স্মার্টফোন, স্মার্ট টিভির কাছে উপাত্ত আছে। এসব উপাত্ত আগে সংরক্ষণ করা যেত না। এখন ক্লাউডে সংরক্ষণ করা সহজ ও স্বল্প ব্যয়ের। দ্রæত প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতার কারণে কম্পিউটার এসব ডাটা সহজে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
কম্পিউটারকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দেয়া হচ্ছে। পূর্ববর্তী পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ডাটা বিশ্লেষণ করে এআই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। কম্পিউটারকে প্রথমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, কম্পিউটার একটা প্যাটার্ন আন্দাজ করতে পারে। ফলে পরবর্তীতে রঙ, সাইজ, ভঙ্গিভেদে কম্পিউটার বিষয়টি চিনতে পারে। বর্তমানে কোনো লেনদেন হলে তা লেজার বা খতিয়ানে লিপিবদ্ধ থাকে। এ লেজার কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হয়। ব্লক চেইনে লেজারটি ছড়িয়ে দেয়া হয় সব অংশগ্রহণকারীর মধ্যে। ফলে কেউ জালিয়াতি আশঙ্কা কমবে। প্রতি লেনদেন একটা ব্লক তৈরি করে। সেটা আগের বøকের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে একটা চেইন তৈরি করে। ব্লক চেইনে শুধু আর্থিক লেনদেন নয়; চুক্তি, জমির দলিলসহ বিনিময়ের রেকর্ড থাকতে পারবে। বøক চেইন প্রবর্তিত হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের অনেক কাজ কমে যাবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে। অনেক মানুষ বেকার হতে পারে।
থ্রিডি প্রিন্টিং এর মাধ্যমে কোনো জটিল যন্ত্রপাতি ছাড়াই জটিল বস্তু (যেমন প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, সিরামিক, স্টিল ইত্যাদি) তৈরি করা যায়। আগে যে জিনিস তৈরি করতে একটা কারখানার প্রয়োজন হতো, তা এখন একটা প্রিন্টিং মেশিনে তৈরি করা সম্ভব হবে। এতে জিনিসপত্র তৈরি ত্বরান্বিত হবে। ‘নকশা থেকে প্রস্তুত’-এর চক্র ছোট হবে। আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের পোশাক শিল্প থ্রিডি প্রিন্টারে অনেক জিনিস নিজেরা তৈরি করতে পারবে। এতে দক্ষ জনশক্তির দরকার হবে এ বিষয়ে দক্ষ
এখন পর্যন্ত বিশ্ববাজারে আমাদের একমাত্র প্রাপ্য বিষয় হচ্ছে সস্তা শ্রম। রোবোটিকস, এআইয়ের কারণে আমাদের এ সুবিধা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে কম্পিউটার প্রোগ্রামার, ডাটা অ্যানালিস্টসহ কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন লোকের চাহিদা বাড়বে। প্রযুক্তিভিত্তিক চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সফল করতে ও অংশীদার হতে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রযুক্তি শিক্ষার প্রসার এবং ব্লক চেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার কথা আরো জোরালোভাবে ভাবতে হবে।
আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে আরও দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে। যারা বিদেশে যান তাদের কারিগরি বিষয়ে পারদর্শী হতে হয়। আর এ কারণেই কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সরকার সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তাদের সহায়তা করছে। দেশ গড়ার জন্য দক্ষ জনশক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকার জনশক্তি তৈরিতে কাজ করছে। সরকার এমনভাবে জনশক্তি তৈরি করছে যাতে তারা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে পারে।
আমাদের এজন্য কম্পিউটার প্রোগ্রামার, ডাটা অ্যানালিস্টসহ কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন লোকের চাহিদা বাড়ছে। আশার কথা হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এবং এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলক চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), ব্লকচেইন ও রোবটিকস স্ট্র্যাটেজি দ্রুত প্রণয়নের উদ্যোগ নেন এবং খসড়া প্রণয়নের পর মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। যে ১০টি প্রযুক্তি আমাদের চারপাশের প্রায় সব কিছুতেই দ্রুত পরিবর্তন আনবে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে তুলে ধরার পর প্রধানমন্ত্রী চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গুরুত্ব অনুধাবন করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন। তথ্য ও যাগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এলআইসিটি প্রকল্প ১০টি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর দক্ষ মানুষ তৈরির প্রশিক্ষণ শুরু করে। এসব উদ্যোগ আমাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঝুঁকিকে সম্ভাবনায় পরিণত করার জন্য আশাবাদী করছে। ভবিষ্যতে শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের জন্যই দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে। যাঁরা বিদেশে যাবেন, তাঁদের কারিগরি বিষয়গুলোয় দক্ষ হয়ে যেতে হবে। আর সে জন্যই কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতে পরিবর্তন করা হয়েছে। যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। একটি দেশ গঠনের জন্য দক্ষ জনশক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটা আমরা সব সময় মনে করি এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সরকার কাজ করছে। জনশক্তিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের যেকোনো জায়গায় প্রতিযোগিতা করতে পারে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মুখে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরের জন্য জাতিসংঘের ই-গভর্নেন্স ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে শীর্ষ ৫০ টি দেশে থাকার চেষ্টা করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ৫ টি উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এগুলি হল ডিজিটাল সেন্টার, পরিষেবা উদ্ভাবন তহবিল, সহানুভূতি প্রশিক্ষণ, টিসিভি এবং এসডিজি ট্র্যাকার।
তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে, তরুণরা ছোট-বড় আইটি ফার্ম, ই-কমার্স সাইট, অ্যাপ-ভিত্তিক পরিষেবা এবং অন্যান্য সংস্থা তৈরি করছে। এছাড়া মহাকাশে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটসহ কিছু বড় অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
‘অ্যাপভিত্তিক নানা ধরনের সেবাও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দৈনন্দিন কাজ, উৎপাদন, বিক্রি, বিপণন এমন নানা স্তরে সময়, শ্রম ও ব্যয় কমানোর জন্য এখন অনেকেই প্রযুক্তিকে বেছে নিচ্ছেন। বড় কম্পানিগুলো ইআরপি (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং) সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তার (এসএমই) একটি বড় অংশই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছে।
মহামারি মোকাবেলা থেকে নানা কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) নানামুখী ব্যবহার দেখছে বিশ্ব। ‘আগামী দিনে ব্যবসার ধারণা আমূল পাল্টে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর নানা প্ল্যাটফর্ম। আগামী দিনগুলোয় চিকিৎসাসেবায়, অফিস-আদালতে, শিল্প-কারখানায়, সংবাদ সংস্থা বা গণমাধ্যমে, ভাষান্তর প্রক্রিয়া, টেলিফোনসেবা, বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, হোটেল-রেস্তোরাঁ এমনকি বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র বা রোবটের ব্যাপক ব্যবহারের আভাস দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমাদের রিস্কিলিং এবং আপস্কিলিং করতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এমনকি ভারতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হলেও বাংলাদেশে প্রযুক্তির এই সর্বশেষ সংস্করণের ব্যবহারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করেন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সবাই আরো এগিয়ে আসতে হবে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচকতা সম্পর্কে সাবধান থেকে দেশের সর্বক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে তা কাজে লাগানো প্রয়োজন বলেও মনে করছেন সবাই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শঙ্কা কাটিয়ে এর সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে ‘সবার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিবাচক ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি প্রয়োজন। এ জন্য সকল পর্যায়ের অংশীজনদের সক্রিয় ভ‚মিকা প্রয়োজন।’
নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের হোম ডেলিভারি, সাধারণ স্বাস্থ্য পরামর্শের জন্য টেলিমেডিসিনসেবা, ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম, ভিডিও কনফারেন্স, অনলাইন প্রশিক্ষণ, দূর-শিক্ষণকার্যক্রম, ভিডিও স্ট্রিমিং ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাখাত ও আবাসিক ব্যবহারকারীদের জন্য পারস্পরিক সংযুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ কারণে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ এর চাহিদা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আগামী বছরগুলোতে যে কোন মহামারি প্রতিরোধে সংযোগ চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে। প্রচলিত প্রযুক্তির পরিবর্তে উচ্চগতির ফাইবার অপটিক-ভিত্তিক কানেকটিভিটি বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে টেলিমেডিসিন সেবা, দূরশিক্ষণ, অনলাইন প্রশিক্ষণ, মহামারী আক্রান্ত এলাকা নির্ধারণ, সামাজিক সুরক্ষা প্রাপ্তির তালিকা তৈরি প্রভৃতি খাতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও বিগডাটা প্রয়োগ বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়াও ই-কমার্স, আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং, ভিডিও স্ট্রিমিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বর্ধিত চাহিদা পূরণকরতে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এর ধারণ ক্ষমতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ৫-জি নেটওয়ার্ক এখন সময়ের দাবি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যে ৫-জি প্রযুক্তি চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ৫জি এর জন্য টেলিকম কর্মকর্তাদের দক্ষ ও সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তিত জীবন ব্যবস্থার মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অগ্রগামী হতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকতে বাংলাদেশের প্রযুক্তি পরিবেশে সহায়ক অবকাঠামো-কারিগরি প্রস্তুতিতে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার এবং সিস্টেমস থাকতে হবে। বাংলাদেশের তরুণরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে কৌতুহলী, এই কৌতুহলী তরুণদের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দেশের অগ্রগতির জন্য ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ। কিন্তু কৃষি কাজ এখনো প্রকৃতি নির্ভর, কীটনাশক প্রদান সনাতন পদ্ধতিতে চলছে। যেখানে ফসলের রোগবালাই, মাটির অবস্থা, আবহাওয়া নির্ণয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে ১৭ কোটি মানুষের জন্য ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র ২৫-৩০ হাজার। এখাতে অবশ্যই আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। তাছাড়া শিল্পখাতের সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভরযোগ্য উপায় হতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের কায়িক শ্রম কমিয়ে জ্ঞানভিত্তিক শ্রমের উপায় হিসেবে দেখেন অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় গুরুত্ব দিচ্ছে। পুরো বিশ্বের ব্যবসায়িক নামকরা প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে স্বল্প পরিসরে কাজ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বেকারত্বের ভয়ে বাংলাদেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে পিছিয়ে গেলে পুরো বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়তে পারে। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষে শারীরিক শ্রম দেয়া শ্রমিকের সংখ্যা কমার সম্ভাবনা রয়েছে ঠিক তেমনি জ্ঞানভিত্তিক শ্রমের ক্ষেত্রও প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উন্নত দেশের সরকারগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে আরবান প্ল্যানিং, মাস ট্রানজিট সিস্টেম, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, বন্যার আর্লি ডিটেকশন, সরকারি রিসোর্সের সঠিক ডিস্ট্রিবিউশন এবং ব্যবহার, সামনের বছরগুলোতে পেনশনারদের কতো টাকা দিতে হতে পারে ক্রাইম প্রেডিকশন, শহর জুড়ে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট এর কাজ করছে। এরকম হাজারো জিনিসে ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
মানব কল্যাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক কথায় বললে সবই এখন স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দখলে। অর্থাৎ সুই-সুতো বানানোর কারখানা থেকে হেল্পলাইনের ভয়েস, সবক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবট। মানুষের দাসত্ব কিংবা একঘেয়েমি খাটুনি বা পরিশ্রম করতে পারে এমন যন্ত্র। বলাই বাহুল্য, সেটি রোবট দারুণভাবেই করে চলেছে।
মঙ্গল গ্রহ থেকে মার্স রোভারের নিয়মিত তথ্য পাঠানো, সমুদ্রগভীরে গিয়ে গবেষণা, কারখানায় ১শ জনের কাজ একাই করে দেওয়া অক্লান্ত কর্মী, ঝাড়ু-মোছা কিংবা শয়নকক্ষে সবই এখন রোবট সামলাচ্ছে নিপুণভাবে। বিনিময়ে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।
তবে ইন্টারনেটকে সহজলভ্য করতে হবে। বর্তমানে দেশের ৫৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা নেই। পাশাপাশি গ্রামীণ পরিবারগুলোর ৫৯ শতাংশের স্মার্টফোন নেই এবং ৪৯ শতাংশের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা গ্রহণে যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ একই সঙ্গে সেবাগুলোর সহজীকরণ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতাও প্রয়োজনীয়। এ দুই ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর ঘাটতি রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রবেশগম্যতা নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায় কিন্তু সম্পূর্ণ ধারণা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ পরিবারের মধ্যকার যে বিভাজন আছে যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামনে উঠে আসে না। যেমন পরিবারের নারী ও পুরুষের মধ্যকার বিভাজন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বয়সভেদে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান।
সরকার প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালায় ‘সামাজিক সমতা ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকার’ অংশে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এখন এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করা জরুরি এবং এজন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সবার আগে তথ্যপ্রযুক্তিকে সব জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। এজন্য সরকারি উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগী করে তুলতে হবে। পাশাপাশি কম খরচে বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও নারীরা যাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে তার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক