হীরেন পণ্ডিত: গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে সবার কাজ করা উচিত। রাজনীতি থেকে হিংসা-হানাহানি অবসানের মাধ্যমে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মহান সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করছে। জাতির বীর, সাহসী সূর্যসন্তানরা লাখো প্রাণের বিনিময়ে আমাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। আমাদের দায়িত্ব এই দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করা। যে কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকা- হতে দূরে থেকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে শামিল হই। গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে, এমন যে কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতীয় সংসদই হচ্ছে গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। জাতীয় সংসদ সক্রিয় ও গতিশীল থাকলে মানুষের জীবনের উন্নয়ন ও তাদের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। সরকারকেও জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার ভেতর নিয়ে আসা যায়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও তদারকিতে জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলো খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কমিটির বৈঠকে তারা সুপারিশ দিয়ে কাজে আরও গতিশীল ও জবাবদিহিতার আওতায় প্রশাসনসহ সবকিছুকে নিয়ে আসা যায়। সংসদকে গতিশীল এবং এ ধারাকে অব্যাহত রাখা আমাদের গণতন্ত্রকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের অগ্রযাত্রা ও উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে গড়ে উঠছে অসাম্প্রদায়িক, আত্মনির্ভরশীল ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। ৫৩ বছরে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে তা প্রশংসার যোগ্য, এতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অবদান রয়েছে। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বাংলাদেশ। তখন আমাদের তেমন কিছুই ছিল না। মাথাপিছু আয়, রপ্তানি, প্রবাসী আয় সবকিছুই ছিল নামমাত্র। সেখান থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছে দেশটি। গত ১৫ বছরে দুর্দান্ত অগ্রগতি হয়েছে।
সবচেয়ে বড় অবদান রপ্তানি, রেমিটেন্স এবং কৃষি। কৃষি খাতে বৈচিত্র্য এসেছে। ফলে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। কিন্তু কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। পোশাকের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। পণ্য বৈচিত্র্য এবং নতুন বাজার প্রসারিত করা প্রয়োজন রেমিট্যান্স বেশি হলেও প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় তা কম। এটা বাড়াতে হবে। কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসী কঠিন পরিশ্রমী বীরদের ঘাম ও শ্রমে সৃষ্ট বাংলাদেশ উন্নয়নের কিংবদন্তি হয়ে বিশ্বের কাছে হয়ে উঠছে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত।
সরকারি পরিকল্পনা কমিশন, দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ১৯৭১ সালে ধ্বংসস্তূপে যে দেশটির জন্ম হয়েছিল, ৫৩ বছর পরে, সেই দেশটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) আটটি লক্ষ্যের প্রায় সবগুলোতেই ইতিবাচক অগ্রগতি হয়। এখন টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক দশক ধরে বিশ্বের শীর্ষ সংস্থা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা, গোল্ডম্যান শ্যাক্স, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, এইচএসবিসি, সিটি ব্যাংক এনএ, পিডব্লিউসির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ডায়মন্ড, ইমার্জিং টাইগারসহ বিভিন্ন নামে ডাকা হচ্ছে। এর কারণেই ধারাবাহিকভাবে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রিজার্ভ, রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়, রপ্তানি, মাথাপিছু আয়, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির অন্যান্য প্রধান সূচকে প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে চমক।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। নারী শিক্ষা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, আয়, বাণিজ্য ঘাটতি, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য হ্রাস, নিরাপদ সুপেয় পানি, আবাসন, স্কুলে ভর্তি, মাতৃ-মৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হারের মতো সমস্ত সূচকে বাংলাদেশের অর্জন সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। সেই সাফল্যের জন্য এত কিছু; অগ্রগতি, বলা যায় অর্থনীতির প্রধান তিনটি খাত, কৃষি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে অন্যসব দিকে সক্ষমতা তৈরিতে।
বাংলাদেশের কৃষকরা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও খরাসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেও দ্বিগুণ দৃঢ়তা ও শক্তি দিয়ে কৃষির অগ্রগতি বজায় রেখেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৭ শতাংশের বেশি কৃষি কাজে নিয়োজিত। উন্নত বীজ, সার, কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণ ব্যবহার করে তারা জমি ক্ষয়ের পরও কয়েকগুণ বেশি ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশের ১০ শতাংশ জমি উচ্চ ফলনশীল ফসলের আওতাধীন ছিল। এখন তা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ১০ শতাংশ জমি সেচের আওতায় ছিল, এখন তা ৮০ শতাংশ। ফলে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ ও ভুট্টা দশ গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, খোলা পানিতে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে। হাঁস-মুরগি এবং দুগ্ধ খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য। এসবই সম্ভব হয়েছে কৃষকদের কঠোর পরিশ্রমে।
রপ্তানি ও পোশাক খাত কৃষির মতো অবদান রাখছে কারণ এটি দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এই সেক্টরে প্রায় ৪ মিলিয়ন কর্মী তুলনামূলকভাবে কম মজুরিতে কাজ করছে, যা প্রতিযোগিতায় বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ফলে চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। গত ৫৩ বছরে দেশের রপ্তানি আয়ের চেহারা পাল্টে দিয়েছে পোশাক খাত। পাঁচ দশকে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৯৬ গুণ। গ্রামীণ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান, নারীর আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং অসংখ্য সহযোগী শিল্পের সম্প্রসারণের মাধ্যমে খাতটি বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এক সময় যেটি ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা ছিল তা এখন পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বে পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায়ও বাংলাদেশ শীর্ষে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের চেয়ে বড় চমক আর কী হতে পারে! মূল্য, গুণমান এবং লিড টাইমকে দক্ষতার সঙ্গে একত্রিত করে খাতটি বিশ্ববাজারকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ খাতে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ক্রমাগত বৃদ্ধি করে চলেছে।এছাড়া বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে যে খাতটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তা হলো প্রবাসী আয়। প্রবাসীরা তাদের পরিবার ও প্রিয়জনদের ছেড়ে দিন-রাত পরিশ্রম করে প্রবাসী হয়ে তাদের উপার্জনের সিংহভাগ দেশে পাঠান। এর ওপর ভিত্তি করেই আজ দেশের সমৃদ্ধি এসেছে। দেশে খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে, অন্যদিকে স্থল রপ্তানি ও রেমিটেন্স আকারে শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। এসবের সম্মিলিত ফল দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি। সারা দেশে সড়ক, মহাসড়ক ও মেগা প্রকল্প। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেলের উদ্বোধন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এনবিআরের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আগামী বছরে দেশের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবসা দাঁড়াবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসেই বৈদেশিক মুদ্রায় আয় করছে প্রায় ৭ লাখ তরুণ। এ খাতের রপ্তানি আয়ও ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দেশে প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর মোবাইল ফোন সেট তৈরি হচ্ছে। সামনে রপ্তানির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিশাল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাংলাদেশ হাব হয়ে উঠবে।
হীরেন পণ্ডিত : প্রাবন্ধিক ও গবেষক