হীরেন পণ্ডিত: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানে নিজেদের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। এই ইশতেহারে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা, গণতান্ত্রিক চর্চার প্রসার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা, আর্থিক খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলাসহ মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাফল্যের ওপর আশাবাদী হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ডিজিটাল বাংলাদেশ ছিল সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘোষণা। ঠিক একইভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণাও ইতোমধ্যে মানুষের মনে শুধু আলোড়ন সৃষ্টিই করেনি, নব আশার সঞ্চার করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের তত্ত্বাবধানে স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটির ওপর ভিত্তি করে সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ব্যাপক পরিসরে কাজ করছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ কতটা আধুনিক একটি কর্মসূচি, তা এর চার স্তম্ভের লক্ষ্য থেকেই অনুধাবন করা যায়। সম্পূর্ণ পরিকল্পনা স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমেই সাজানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছে। ন্যায্য, সত্য ও মানুষের কল্যাণের পক্ষে সোচ্চার দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ বিনির্মাণের যে ভিশন ঘোষণা করেছেন, তাতে শক্তি, সাহস, সক্ষমতা ও প্রেরণা জুগিয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশের মূল সারমর্ম হবে- দেশের প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে, উইথ স্মার্ট ইকোনমি। অর্থাৎ ইকোনমির সব কার্যক্রম আমরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে করব। স্মার্ট গভর্নমেন্ট ইতোমধ্যে আমরা অনেকটা করে ফেলেছি। সেটাও করে ফেলব। আর আমাদের পুরো সমাজটাই হবে স্মার্ট সোসাইটি।’
সেই বিবেচনায় ২০২১ থেকে ২০৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও প্রণয়ন শুরু হয়েছে, অর্থাৎ ২০২১ থেকে ৪১ কীভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নটা হবে, তার একটা কাঠামো পরিকল্পনা বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই প্রণয়ন করেছে। যা জনগণের জন্য অন্যতম আশীর্বাদ বয়ে আনবে। অন্যদিকে ২০৪১ সালেই শেষ নয়, ২১০০ সালেও এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপ যেন জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষা পায়, দেশ উন্নত হয়, দেশের মানুষ যাতে ‘সুন্দর, সুস্থ এবং স্মার্টলি’ বাঁচতে পারে, সে জন্য ডেল্টা প্ল্যান করে দেওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
ডিজিটাল বাংলাদেশের বদৌলতে সরকার দেশের সব নাগরিকের জন্য ন্যাশনাল আইডি (এনআইডি) চালু করেছে, যেহেতু এনআইডি সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর একটি ডকুমেন্ট, তাই এর গ্রহণযোগ্যতা শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, দেশের বাইরেও অনেক বেশি, এখানকার সরকারি অফিস থেকে এনআইডির কপি চেয়ে (যেকোনো প্রয়োজনেই চাওয়া হয়) এবং সেই কপি জমা দেওয়ার কারণে অনেক আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জমা দিতে হয় না অথচ এরাই আগে আমাদের দেশের কোনো কাগজপত্রই খুব সহজে বিশ্বাস করতে চাইত না, এখানেই দৃশ্যমান হয় ডিজিটাল বাংলাদেশের গুরুত্ব এবং সুবিধা।
আবার বর্তমান যুগে সবকিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর না করতে পারলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে কী মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত। দেড় যুগ আগে ডিজিটাল বাংলাদেশের সূচনা হলেও দেশের ব্যাংকিং খাত সেভাবে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠতে পারেনি কিংবা প্রযুক্তিনির্ভর হলেও রয়েছে সমন্বয়হীনতা। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ব্যাংক ভিন্ন রকম প্রযুক্তির ব্যবহার করছে ঠিকই, কিন্তু তাতে প্রকৃত ডিজিটাল ব্যাংকিং থেকে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত অনেক দূরে রয়েছে বলেই অনেকে মনে করেন।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল গ্রহণের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হলে প্রয়োজন স্মার্ট সিটিজেন। ভবিষ্যতে যাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকবে, তারাই ভালো কাজ পাবে। যাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকবে না, তারা কাজ হারাবে। উন্নত বিশ্বপ্রযুক্তি আজ যে পর্যায়ে এসেছে, আমাদের দেশে তার কাজটা শুরু হয়েছিল আজ থেকে তিন দশক আগে। তারপরও এখন দেশ যে শতভাগ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে, এমন দাবি করার সময় এখনো আসেনি। সেই বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়েই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। এখন প্রয়োজন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই উদ্যোগ সফলভাবে এগিয়ে নেওয়া।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ৫৫ হাজার ৯১৩ জন মানুষ বিদেশে কর্মরত আছেন। যাদের ৮৮ শতাংশই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া, অর্থাৎ প্রায় ৭৬ লাখ প্রবাসীর কাজের প্রশিক্ষণ নেই। আর বাকি ১২ শতাংশ প্রবাসী কারিগরি শিক্ষা, ভাষা, কম্পিউটার ও ড্রাইভিংয়ে চারটির কোনো একটির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রবাসীদের মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ডিগ্রিধারীর সংখ্যা খুবই কম।
বাংলাদেশ ক্রমাগত বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম চারটি- রপ্তানি, আমদানি, বিনিয়োগ ও সাময়িক অভিবাসন। বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি। তাই দেশে বিনিয়োগ (বিদেশি) বৃদ্ধি ও জনশক্তি রপ্তানি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার প্রধান উপায়। বিদেশি বিনিয়োগ দেশে বাড়বে তখনই, যখন দেশে থাকবে পর্যাপ্ত উপকরণ, যেমন খনি বা জমি, পুঁজি কিংবা জনশক্তি। অদক্ষ জনশক্তি বিদেশি বিনিয়োগ ততটা উৎসাহিত করে না। এ ক্ষেত্রে শুধু শ্রমনির্ভর খাতে বিনিয়োগ হবে। বাংলাদেশ কেবল একটি পণ্যই রপ্তানি করছে। অথচ যেসব দেশে শ্রমিকের দক্ষতা বেশি, সেসব দেশে বাড়ে বিদেশি বিনিয়োগ। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রেও একই চিত্র। বিদেশে শ্রমিক প্রয়োজন। তবে ক্রমাগত দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে দক্ষ শ্রমিক প্রাায় ১০ গুণ বেশি আয় করেন। আর শ্রমিকের দক্ষতানির্ভর করে শিক্ষার মানের ওপর। তাই শিক্ষার মান পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। গতানুগতিক চিন্তার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না।
আমরা জানি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে ফিউশন অব ফিজিক্যাল, ডিজিটাল এবং বায়োলজিক্যাল স্ফেয়ার। এখানে ফিজিক্যাল হচ্ছে হিউমেন, বায়োলজিক্যাল হচ্ছে প্রকৃতি এবং ডিজিটাল হচ্ছে টেকনোলজি। এই তিনটিকে আলাদা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কী হচ্ছে? সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে? এর ফলে ইন্টেলেকচুয়ালাইজেশন হচ্ছে, হিউমেন মেশিন ইন্টারফেস হচ্ছে এবং রিয়েলটি এবং ভার্চুয়ালিটি এক হয়ে যাচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, ইন্টারনেট অব থিংস, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, থ্রিডি প্রিন্টিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও অন্যান্য প্রযুক্তি মিলেই এ বিপ্লব। এ বিপ্লবের ব্যাপকতা, প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতা ও এ সংশ্লিষ্ট জটিল ব্যবস্থা বিশ্বের সরকারগুলোর সক্ষমতাকে বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীনও করেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের ৫টি উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। সেগুলো হলো ডিজিটাল সেন্টার, সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড, অ্যাম্পেথি ট্রেনিং, টিসিভি (টাইম, কস্ট ও ভিজিট) ও এসডিজি ট্রেকার। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তরুণরা গড়ে তুলছে ছোট-বড় আইটি ফার্ম, ই-কমার্স সাইট, অ্যাপভিত্তিক সেবাসহ নানা প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানিতে এখনো যেমন অদক্ষ ক্যাটাগরিতে রয়েছে, তেমনি দেশে দক্ষ জনবলের অভাবে বিদেশ থেকে লোক আনতে হচ্ছে। এ জন্য জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কারিগরি শিক্ষার মডেল আমাদের অনুসরণ করতে হবে। জার্মানিতে কারিগরি শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ। দেশে এ শিক্ষার হার অন্তত ৬০ শতাংশে উন্নীত করার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের উন্নতির মূলে রয়েছে কারিগরি শিক্ষা। আমাদের সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক