হীরেন পণ্ডিত
বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্টসমূহ (এসডিজি) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর জন্য সরকার যুবকদের বিভিন্ন চাকরির সুযোগ তৈরি করছে। এছাড়াও সুনির্দিষ্ট চাকরি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কর্মসংস্থান এবং আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য এগিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এটি করাই এখন জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য। দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মহীন যুব সমাজকে জনশক্তিতে রূপান্তর ও তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুবদের বিভিন্ন পেশায় প্রশিক্ষণ অর্জন এবং তাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার পথ নির্দেশকসমূহ হচ্ছে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ চলছে। আজকের শিক্ষার্থীরাই একদিন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি এই চারটি মূল ভিত্তির ওপর গড়ে উঠবে ২০৪১ সাল একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যার চার ভাগের একভাগ তরুণ, যা প্রায় ৫ কোটির কাছাকাছি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা, দেশের রূপান্তর ও উন্নয়নে তরুণ এবং যুব সমাজকে সম্পৃক্ত রেখেই উন্নয়নের বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
আগে বাংলাদেশ কেমন ছিল বর্তমানে কেমন আছে। যারা বর্তমানে জন্মগ্রহণ করছে, তাদের কাছে আধুনিক এই সমাজে অতীতের কথাগুলো গল্প মনে হতে পারে এটিই স্বাভাবিক। কারণ আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন বিস্ময়কর রাষ্ট্র। উন্নয়ন অগ্রগতিতে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে বাংলাদেশ। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। সব সূচকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে অদম্য বাংলাদেশ হিসেবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে তরুণ সমাজকে শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞানে এবং প্রযুক্তি বিজ্ঞানে অত্যন্ত দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে এবং স্মার্ট জনগোষ্ঠী, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি ও ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। ইন্টারনেটে ও স্মার্ট ফোনের সহজলভ্যতার কারণে সরকারি সব সেবা দ্রæত ও ঘরে বসে পাচ্ছে। একসময় যে কাজ করতে প্রচুর অর্থ, শ্রম ও সময় লাগত তা বর্তমানে এক ক্লিকে ঘরে বসে করা যাচ্ছে।
তরুণসমাজ, তারূণ্য একটি প্রাণশক্তি, যা অফুরন্ত সম্ভাবনা ও বর্ণিল স্বপ্ন দ্বারা পরিপূর্ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন। তরুণদের ভাবনাগুলো হবে বাংলাদেশের ভাবনা, বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার ভাবনা, তরুণসমাজের আপাদমস্তক চিন্তাভাবনা হবে বাংলাদেশকে নিয়ে। সব অস্তিত্বে থাকবে বাংলাদেশ। তরুণদের কাজগুলো হবে বাংলাদেশের কাজ। সব স্বপ্ন দেখতে হবে বাংলাদেশকে নিয়ে।
নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য নতুন করে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। বিবিএসের সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে এবং তাদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার প্রায় ৪২ শতাংশ। সেই কর্মসংস্থানের মান কিন্তু তেমন উজ্জ্বল নয়। ২০১৭-২২ সালের মধ্যে নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে কৃষিতে স্বনিয়োজনের মাধ্যমে। আর শিল্প খাতে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা কমেছে। কৃষিতে বিপুলসংখ্যক নারী যোগ দিলেও সেখানে পরিবারপ্রতি কৃষিজমি বা উৎপাদনশীল অন্য সম্পদ বাড়েনি। ফলে জনপ্রতি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে । বেতন ও মজুরিতে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা কমেছে। শিল্পে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বৃহৎ শিল্পমালিকদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে স্বল্পমেয়াদে যে দক্ষতার চাহিদা রয়েছে তেমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যৌথ উদ্যোগে। নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়টিতে পৃথকভাবে গুরুত্বের সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে নতুন কৌশল ও কার্যক্রম নিতে হবে।
সার্বিকভাবে শ্রমঘন আধুনিক খাত বিকাশের নীতি-কৌশল গ্রহণ এবং শিক্ষার মান উন্নয়ন ব্যতীত উন্নতমানের কর্মসংস্থান বাড়ানোর পথ নেই। পুঁজিঘন বিশাল কার্যক্রম গ্রহণ করে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দ্রæততর করার ক্ষেত্রে সাফল্য কিছুটা আসতে পারে। কিন্তু তাতে শ্রম আয়ের ওপর নির্ভরশীল স্বল্প দক্ষ জনগণের মানসম্মত কর্মসংস্থানে উত্তরণের স্বপ্নপূরণ হবে না। সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি চলতে থাকবে অব্যাহতভাবে। একসময় এ দেশের বাজেটের সামষ্টিক অংশে প্রাক্কলন দেয়া হতো যে পরবর্তী এক বছরে কতসংখ্যক কর্মসংস্থান হতে পারে।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসংক্রান্ত যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে সেগুলোর ফলে নতুন কত কর্মসংস্থান হতে পারে তার হিসাব করা দরকার। কর্মক্ষম, যোগ্য তরুণ ও যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত করা হবে। জেলা ও উপজেলায় ৩১ লক্ষ যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে এবং তাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সহায়তা প্রদান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। ২০৩০ সাল নাগাদ অতিরিক্ত ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। স্বল্পশিক্ষিত তরুণ ও যুবসমাজের জন্য যথোপযুক্ত কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আত্মকর্মসংস্থানে উদ্যোগীদের সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা এবং ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।
কী ধরনের উন্নয়ন কৌশল মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে পারে সে জন্য দরকার কর্মসংস্থান বৃদ্ধি কেন বর্তমান বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে ভাবার সময় এসছে। দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের সাফল্যের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমেছে নানা কারণে। সেই সঙ্গে বেড়েছে আয় ও সম্পদবৈষম্য। আয়বৈষম্যের পেছনে বহু কারণ ও প্রক্রিয়া কাজ করছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মজুরি ও বেতন থেকে প্রকৃত আয় হ্রাস পাচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যানের একাধিক উৎস থেকে দেখা যায় যে গত ১০ বছরে মজুরি ও বেতন থেকে প্রকৃত আয় এমনকি অনেক পেশায় আয় কমেছে। বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ থেকে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি, বেড়েছে কৃষিতে এবং সেখানে নিয়োজিত ব্যক্তিপ্রতি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে।
শিল্প ও আধুনিক সেবা খাত প্রসারের জন্য উপযোগী সামষ্টিক নীতি গ্রহণ জরুরি। এসব পরিবর্তনের ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুফল পেতে অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে। মধ্য মেয়াদে মানসম্পন্ন কাজের সুযোগ বাড়বে তাতে। সাম্প্রতিক কালে শিল্পে কর্মসংস্থান না বাড়ার কারণের মধ্যে রয়েছে বৃহৎ উদ্যোক্তাদের পুঁজি ঘনত্ব বৃদ্ধি এবং এসএমই উদ্যোগ প্রসারের শ্লথ ধারা। যেখানে শ্রম সুলভ, তা সত্তে¡ও পুঁজিঘনত্ব বাড়ে, সেটা ঘটে কৃত্রিমভাবে পুঁজি সুলভ করার নীতির কারণে। এই প্রবণতা না পাল্টালে ভালো মানের চাকরির সংস্থান দুরাশা।
সাধারণ স্নাতক শিক্ষিতদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব হার বিরাজ করছে, তার একটি বড় কারণ হচ্ছে যে তারা যে ধরনের শিক্ষা অর্জন করেছে আর যে ধরনের যোগ্যতার জন্য চাকরি বাজারে চাহিদা আছে তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সাধারণ বিষয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ তরুণদের মধ্যে বেতনের যে প্রত্যাশা থাকে, সেটা তাদের কাছ থেকে যে কাজ পাওয়া যাবে তার তুলনায় অনেক বেশি। অন্যদিকে কিছু কিছু দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের অভাব রয়েছে বলে জানা যায়।
কর্মসংস্থানের মূল লক্ষ্য হবে সদ্য শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে যে তরুণ জনগোষ্ঠী তাদের উপযোগী কাজের সুযোগ তৈরি করা। যারা কলেজে ঢোকার আগেই দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ে তারা না চায় কৃষি মজুরির কাজ করতে, না আছে তাদের পুঁজি বা অন্য দক্ষতা। তাদের সহায়তা দেয়া দরকার যেন চাকরি অনুসন্ধান পথ সুগম হয়। কীভাবে আবেদন করতে হয় বা নতুন উদ্যোগ স্থাপনে কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হয় সে বিষয়ে স্কুল শিক্ষা থেকে জ্ঞান অর্জিত হয় না। এগুলোর জন্য জেলা পর্যায়ে কিছু প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে সহায়ক ভূমিকা রাখার। এনজিও বা ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে এসব ক্ষেত্রে।
বেকার যুবকদের সর্বশেষ হার ১০.৬ শতাংশ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ৩.০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। নিরক্ষর ও স্বল্প-শিক্ষিত তরুণ ও যুব-সমাজের জন্য যথোপযুক্ত কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি ধীরে ধীরে দেশের সকল উপজেলায় সম্প্রসারণ করা হবে। তৃণমূল পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে আরও জোরদার করার লক্ষ্যে প্রতি উপজেলায় যুব প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের বাইরে থাকা ১৭.৮ শতাংশ যুবদের অনুপাত আগামী ৫ বছরে ৭ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে দেশে-বিদেশে বিকাশমান কর্মসংস্থানের সুযোগগুলো কাজে লাগানোর জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে পলিটেকনিক ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলো ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
দেশে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি মানুষ শ্রম শক্তিতে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। শিল্প খাতের বিকাশ এবং নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে এদের প্রত্যেকের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। কর্ম সংস্থানের জন্য সবচেয়ে বেশি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা। এ খাতের বাধাসমূহ দূর, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও বিদেশি মানবসম্পদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এই খাতকে আরও শক্তিশালী, সুসংগঠিত ও গতিশীল করে তোলা হচ্ছে।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট