হীরেন পণ্ডিত: সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ জানিয়েছে, ৪ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৭ দিনে সারাদেশে ২৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩২০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৪৬২ জন আহত হয়েছেন। ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ দিনে ২৩৯ জনের মৃত্যু হয়। গত ঈদে যেখানে দিনে ১৬ জন করে মারা গেছেন। এবার সেখানে দিনে ১৯ জন করে মারা গেছেন বলে জানিয়েছে বিআরটিএ।
৪ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিলের তথ্য তুলে ধরে বিআরটিএ জানিয়েছে, এবার সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ঢাকা বিভাগে, ৭৩ জন। তার পর চট্টগ্রামে ৪৭ জন ও রাজশাহী বিভাগে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এবার সবচেয়ে কম মৃত্যু হয়েছে সিলেট বিভাগে, ১৭ জন। কমের দিক থেকে তার পর থাকা রংপুর বিভাগে ২০ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া খুলনা বিভাগে ৩১ জন এবং বরিশাল বিভাগে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়। সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে মোটরসাইকেল ১১৭টি, যার হার প্রায় ২৯ শতাংশ। তার পর ৭৭টি বাস বা মিনিবাস, ৫৩টি কাভার্ডভ্যান, ২৯টি অটোরিকশা, ১৯টি পিকআপ, ১৮টি জিপ বা মোটরকার, ১৬টি ইজিবাইক, ১৬টি ব্যাটারিচালিত রিকশা, ১১টি মাইক্রোবাস, ৮টি ভ্যান এবং অন্যান্য ৩৯টি যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, এবারের ঈদযাত্রায় বিগত ঈদের চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ৩১.২৫ শতাংশ, নিহত ২৪.০৮ শতাংশ, আহত ১৪৭.৪৩ শতাংশ বেড়েছে। এতে বিদায়ী ঈদযাত্রায় ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ও ১৩৯৮ জন আহত হয়েছেন। এ দুর্ঘটনার পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাবে শুধু মানুষের মৃত্যু ডেকে আনছে তা কিন্তু নয়, একই সঙ্গে মানুষের শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। এসব দুর্ঘটনা যেভাবেই হোক না কেন, তার ফল সব সময় ভয়াবহ হয়ে থাকে। মানবসম্পদের ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে এই সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো পরিবারকে বিপন্ন করে দেয়। দুর্ঘটনাকবলিত একটি পরিবার দীর্ঘদিন ধরে অমানবিক কষ্ট ভোগ করে। এই ক্ষতি অপূরণীয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব হয় না। আর যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এরূপ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে, তা হলে তার প্রভাব হয় আরও দীর্ঘমেয়াদি।
সড়কের নিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। টেকসই উন্নয়নের জন্য নিরাপদ সড়কের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। সড়ক দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি ও দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্ট নানাবিধ সমস্যা দেশের অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার পদক্ষেপ নিলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি। এসডিজির অভীষ্ট ৩:৬-এ বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেকে কমিয়ে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। এসডিজির অভীষ্ট ১১:২-এ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যানবাহন সম্প্রসারণ করে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও সুলভ পরিবহন ব্যবস্থায় সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের লক্ষ্য অর্জনে এখন সবাইকে কাজ করতে হবে।
সড়ককে নিরাপদ করতে ডিভাইডার স্থাপন, বাঁক সরলীকরণ, সড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ, মহাসড়কে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণ ও গতি নিয়ন্ত্রক বসানোসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়ন, দক্ষ চালক তৈরি এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন করে এর ভিত্তিতেই কাজ চলছে। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ তথা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিক, শ্রমিক, যাত্রী, পথচারী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে হবে।
সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বর্তমান সরকার। আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং টেকসই ও নিরাপদ মহাসড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করাই সরকারের লক্ষ্য। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে স্বয়ংক্রিয় মোটরযান ফিটনেস সেন্টার চালু করা হয়েছে। ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রবর্তনের মাধ্যমে বিআরটিএ’র প্রায় সব সেবাই ডিজিটালাইজড করার প্রচেষ্টা চলছে, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ৬ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশ রোড সেইফটি প্রজেক্ট’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানোর পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়ক ও সেতুর নাজুক অবস্থাও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী। গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেওয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা আর বাড়তি মুনাফার লোভে পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, তাকে বেসামাল হয়ে গাড়ি চালাতে হয়; যা প্রকারান্তরে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লক্কড়ঝক্কড়, অচল যানবাহনে রঙ লাগিয়ে যেনতেন মেরামত করে রাস্তায় চলাচল করে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণের সময়।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী দূর-দূরান্তে গমনাগমন করে। সড়ক-মহাসড়কে চলে বাস-ট্রাকের চালকের অমনোযোগী লড়াই। অতি আনন্দে গাড়ি চালানোর সময় তারা ব্যবহার করেন সেলফোন, যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন, অদক্ষ চালক ও হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো, বিরামহীন যানবাহন চালানো, মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল এবং ব্যস্ত সড়কে ওভারটেকিং, ওভারলোডিং সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো ছিল চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখা ও ৫ ঘণ্টা পরপর চালক পরিবর্তন করা, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, চালকদের জন্য মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ এবং সিগন্যাল মেনে যানবাহন চালানোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি; চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টকরণ; বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং এগুলোর জন্য আলাদা সার্ভিস রোড তৈরি; পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ; রেল ও নৌপথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়কপথের ওপর চাপ কমানো; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
সড়ক নিরাপত্তা বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেফ সিস্টেমস অ্যাপ্রোচ যেমন নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী, নিরাপদ গতিসীমা ও দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির সমন্বয়ে একটি পৃথক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করার বিষয়ে সরকারের যে উদ্যোগ রয়েছে সেগুলো আমাদের সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করবে এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এক গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী ভূমিকা পালন করবে।
সড়ককে নিরাপদ করা এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে নতুন করে আলাদাভাবে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের দাবি দীর্ঘদিনের। তবে আশার কথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে নিরাপদ সড়ক আইন প্রণয়নের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সড়ককে নিরাপদ করার জন্য একটি পৃথক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি সবার প্রশংসা অর্জন করেছে। বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে। সড়ককে নিরাপদ ও এর ব্যবহারকারীদের জীবনের নিশ্চয়তার লক্ষ্যে নতুন করে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন সবার জন্য কল্যাণকর হবে এটি বলা যায় এবং সড়ককে নিরাপদ করার এই আইনটি হোক একটি নতুন মাইলফলক।
হীরেন পণ্ডিত : প্রাবন্ধিক ও গবেষক