হীরেন পণ্ডিত
প্রলোভন, প্রতারণা ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোনো শিশু, নারী বা পুরুষকে
ক্ষতিকর কাজে নিয়োগ বা বিক্রির উদ্দেশ্যে দেশের মধ্যে বা বিদেশে স্থানান্তর
করাকে মানবপাচার বলে আমরা জানি। সমাজের কিছু অর্থলোভী স্বার্থান্বেষী
মানুষ সৃষ্টি করছে এই মানবেতর অবস্থা, মানবপাচারের মতো এ ধরনের জঘন্য কাজে
নিজেদের সম্পৃক্ত করে। এদের রুখতে হবে, এতে প্রয়োজন আমাদের সম্মিলিত
প্রচেষ্টা। পাচারের অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীর সংখ্যা হাতে গোনা। বেশির
ভাগ ক্ষেত্রেই পাচারের অপরাধী ধরা পড়ে না, আর ধরা পড়লেও কঠিন শাস্তি এড়ানোর
জন্য নানাভাবে আপসের চেষ্টা চালায়। ফলে বেশির ভাগ আসামিই শাস্তি এড়াতে
সক্ষম হয়ে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কঠোর শাস্তির বিধান পাচারের ঘটনা রোধের
ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না। ভুঁইফোড় এজেন্সির
মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির নামে মানবপাচারের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।
মানবপাচার প্রতিরোধে তাই শক্ত আইন দরকার।
আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। বাংলাদেশ যেখানে উন্নয়নের ম্যাজিক হিসেবে
দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সেখানে দেশের কোনো নাগরিক যদি অবৈধভাবে বিদেশে কাজ
করতে গিয়ে জিম্মি হয় কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হয়, তা কারো পছন্দ
হবে না। মানবপাচার আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। আমাদের দেশে প্রায়
প্রতিদিনই মানবপাচারের ওপর কোনো না কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়। আর প্রায় প্রতি
সপ্তাহেই মানবপাচারের ভয়াবহতা ও পাচারকারীদের কর্মকাণ্ডের ওপর বিভিন্ন
প্রতিবেদন ছাপা হয়। আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলোতে এই মানবপাচারের ভয়াবহতা
সম্পর্কে কমবেশি আন্দাজ করা যায়। এত পদক্ষেপ, এত আলোচনা; তার পরও এই
সমস্যার কোনো কূলকিনারা করা যাচ্ছে না। মানবপাচারের ঘটনা এখন
নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়
যে গত চার দশকে পাচার হওয়া মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। এ সংখ্যা খুবই
উদ্বেগজনক আমাদের জন্য। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,
প্রতিবছর ৫০ হাজারের বেশি মানুষ সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাচার হয়। ঝুঁকিপূর্ণ
সমুদ্রপথ পাড়ি দেওয়ার সময় ট্রলার ডুবে প্রাণহানি হয় অসংখ্য মানুষের। এমন
ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
সঠিক পথে চলাও কিন্তু নিরাপদ নয় এ পথের যাত্রীদের জন্য। সঠিক পথে চলতে
গেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার ভয় থেকেই যায়।
সমুদ্রপথে যারা বিদেশে পাড়ি জমাতে পা বাড়ায়, তারা মূলত মৃত্যুকে তুচ্ছ করেই
সামনে এগোয়। পাচার হওয়া এ ভাগ্যাহতদের মানবেতর জীবন প্রায় উঠে আসে
পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায়। অনেক ক্ষেত্রে পাচার হওয়াদের
স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। যে পরিবারের লোকটি পাচার হয়েছে, তারা তো
এমনিতেই দরিদ্র। তার ওপর আবার চাওয়া হচ্ছে মুক্তিপণ। এ যে কত নির্মম ও
যাতনার—ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না।
পুরুষের পাশাপাশি পাচার হচ্ছে নারী ও শিশুরাও। বলতে গেলে নারী ও
শিশুপাচার পুরুষপাচারের চেয়ে বেশি ভয়ংকর। পাচার হওয়া নারী ও শিশুর বেশির
ভাগকেই যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের
কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের নারীদের পাচার করা হয়। তাদের কাউকে বিক্রি করা হয়
পতিতালয়ে, আবার কাউকে বিক্রি করা হয় ব্যক্তি মালিকানায়। যেভাবেই হোক নারী ও
শিশুপাচার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ পাচারের শিকার হয় দুই কারণে।
একটি হলো দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। আরেকটি কারণ হলো অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। আমাদের
দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ যথেষ্ট অসচেতন; বিশেষ করে পাচারের
ব্যাপারে। পাশাপাশি দরিদ্র ও বেকারও। তাই মানবপাচার রোধে যেকোনো কার্যকর
পদক্ষেপ নেওয়ার আগে এ সমস্যাগুলোর সমাধান করা জরুরি। এতে শুধু মানবপাচারই
নয়, অন্যান্য বড় সমস্যাও দূর হবে বলে আমরা মনে করি। মানবপাচার রোধে সরকার ও
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরো তৎপর হবে, সচেতন হবে সাধারণ মানুষ, তৈরি
হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।
তবে এখন পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উন্নতি হচ্ছে। এখন সরকারের নিজস্ব
উদ্যোগে কম টাকায় মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক দেশে লোক পাঠানো হচ্ছে। অনেক রাষ্ট্র
বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সেসব প্রস্তাব
সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। তাদের কী অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজে
ব্যবহার করা হবে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব খতিয়ে দেখার পর প্রবাসী কল্যাণ
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে চুক্তি করা হবে বলে পত্রিকায়
প্রকাশিত খবরে জানা যায়।
বাংলাদেশের একজন নারী বা পুরুষ কিংবা শিশু বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার
হবে—এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। এ ধরনের খবর আমাদেরই কষ্ট দেয়। এসব বন্ধে
আমাদের কাজ করতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। সাগরপথে হাজার হাজার মানুষ
যাচ্ছে। থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার জঙ্গলে অনেকের গণকবর মিলেছে। আমরা চাই না
এগুলো থাকুক।
অবৈধভাবে কারোরই বিদেশে যাওয়া উচিত নয়। অনেক সময় সরকারিভাবে
মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর জন্য নারী পাওয়া যায় না। আর অনেকেই অবৈধভাবে চলে
যাচ্ছে। অবৈধভাবে যাতায়াতের কারণে মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে লোক যেতে পারে না।
২০১৭ সালে সাত লাখ ৫৭ হাজার লোক চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছে। আমরা মনে করছি, এ
বছর এই সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়াবে। তবে অবৈধভাবে যারা লোক পাঠায়, সেই
মানবপাচারকারীরা দেশ ও জাতির শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।
মানবপাচারের মতো ঘটনা থেকে আমাদের বের হতে হবে। এ জন্য সবাইকে কাজ করতে
হবে। তবে গ্রামগঞ্জের মানুষকেও সচেতন করতে হবে। সাত-আট লাখ টাকা খরচ করে
বিদেশে না গিয়ে দেশেই এখন অনেক কাজ করা যায়। যেসব এজেন্সি মানবপাচার করে
অর্থ আত্মসাৎ করছে, ওই এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের
আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া বর্তমান মানবপাচার আইনে
সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং যেকোনো মূল্যে মানবপাচার বন্ধ
করতে হবে।