ইন্টারনেট অফ থিংস কোথায় ব্যবহার করা যায়

হীরেন পণ্ডিত
বাংলাদেশে ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি), ধারণার বস্তুনিষ্ঠ প্রচলন শুরু হয়েছে কিন্তু খুব বেশিদিন হয় নি। ২০১৬ সাল থেকে পরিচিত হতে থাকে শব্দটি আমাদের মাঝে। তবে এই ধারণার উদ্ভব বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের মাঝে ঘটেছে সেই অষ্টাদশ শতকেই। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে অষ্টাদশ শতকের পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন এমন কোন যন্ত্র আবিস্কারের যা মেশিন ল্যঙ্গুয়েজের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে সক্ষম। তারই ফলশ্রুতিতে অষ্টাদশ দশকে সর্বপ্রথম টেলিগ্রাফ আবিষ্কৃত হয়। আর টেলিগ্রাফের উন্নত সংস্করণ হিসেবে পরবর্তীতে সামনে আসে “ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি”, তারপরেই প্রথম রেডিও ভয়েস ট্রান্সমিশন শুরু হয়। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। এগুলো সবই নিয়ে যাচ্ছিলো আইওটি’র তবে আগে অবশ্যই প্রয়োজন ছিলো একটি ওপেন সোর্স এর যা আমাদের দিয়েছে ইন্টারনেট । ইতিহাসের পাতা থেকে বিজ্ঞানীদের এই মতবাদ ও স্বপ্নগুলোর কথা জানা যায়।
ইন্টারনেটকে আইওটি এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম ইন্টারনেট ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি এর অংশ হিসেবে কাজ শুরু করে এবং পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট দ্যা অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি নেটওয়ার্ক এর অংশে সংযুক্ত হয়। ১৯৮০ সালে বাণিজ্যিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ এরপানেট এর ব্যবহার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক জনসমর্থন জানান। এরপরেই ১৯৩৩ সালে চলে এলো জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং স্যাটেলাইটস, যা প্রতিরক্ষা বিভাগের সাথে সম্মিলিত হয়ে এমন একটি সিস্টেম প্রণয়ন করে যা ২৪ টি স্যাটেলাইট কে একযোগে স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়ে বেসরকারি মালিকানাধীন স্যাটেলাইটগুলোকেও, কক্ষপথে চালু করা হয়। স্যাটেলাইট এবং ল্যান্ডলাইনগুলি গুলোই আইওটি’র জন্য প্রথম মুক্ত যোগাযোগের সুযোগ প্রদান করে।
ইন্টারনেট অব থিংস এর শুরু
১৯৯৯ সালে ব্রিটিশ টেকনোলজি পাইওনিয়ার কেভিন অ্যাশটন সর্বপ্রথম ইন্টারনেট অব থিংস শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৯৬২ সালে সার্বিয়ান- আমেরিকান উদ্ভাবক নিকোলা টেসলা IOT-Internet of Things এর ধারণা দেন। ১৯৮২ সালে ইন্টারনেট অব থিংস এর সর্বপ্রথম প্রায়োগিক ব্যাবহার দেখা যায় কার্নেগী-মেলান স্কুল অফ কম্পিউটার সায়েন্সের একটি কোক ভেন্ডর মেশিনে। ১৯৮৯ সালে নেদারল্যান্ডসে প্রথম স্মার্ট হোম “হাউস অফ ফিউচার” নির্মাণ করেন ক্রাইট টিটুলা। ১৯৯০ সালে প্রথম আইওটি ডিভাইস যুক্ত টোস্টার নির্মাণ করেন জন রোমকে ও সাইমন হ্যাকেট। ২০০০ সালে স্মার্ট রেফ্রিজারেটর নির্মাণ করে এলজি।
তবে আইওটি ডিভাইসের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে ২০১১ সালে আপিভি৬ ইন্টারনেট প্রটোকল ভার্সন এর উদ্ভাবনের মাধ্যমে।
কিভাবে কাজ করে ইন্টারনেট অব থিংস
ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) হচ্ছে ইলেকট্রনিক্স, সফটওয়্যার, সেন্সর, নেটওয়ার্ক সংযোগের সাথে সংযুক্ত ফিজিক্যাল ডিভাইস যা পরিবহন, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, অ্যাকচুয়েটর এবং অন্যান্য ডিজিটাল আইটেমের নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত এবং তথ্য বিনিময় করতে সক্ষম। প্রতিটি যন্ত্রই তার এমবেডেড কম্পিউটিং সিস্টেমের মাধ্যমে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায় এবং ইন্টারনেট ইনফ্রাস্ট্রাকচারকে ব্যবহার করে তার ম্যানুফ্যাকচারিং অর্গানাইজেশনকে এরর রিপোর্ট পাঠাতে পারে। প্রথমে আইওটি’র ধারণাকে উর্বর মস্তিস্কের কল্পনা বলে মনে হলেও বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এখন তা ধীরে ধীরে বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে।
আইওটি’র যুগকে অনেকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উত্থান বলেও ধারণা করছেন। সাধারণত যেসব খাতে ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) বহুল ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছেঃ-
শিক্ষায় আইওটির ব্যবহার
ইন্টারনেট অব থিংসের মাধ্যমে অনেকভাবেই ক্লাসের শিক্ষার পারফরম্যান্স উন্নত করা যায়। তার আগে দেখে নেয়া যায় যে এটি প্রয়োগের জন্য কি কি প্রয়োজন। ডাটা প্রসেস করার জন্য বেশ কয়েক ধরনের ডিভাইস প্রয়োজন। ক্লাসের ছবি এবং শব্দ রেকর্ড করা, নড়াচড়া চিহ্নিত করা এবং এই ডাটাগুলোকে তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ করে ফলাফল দেখানোর প্রয়োজন হয়। শিক্ষার্থীদের নড়াচড়াকে বিশ্লেষণ করার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন ক্যামেরা। বিভিন্ন ছবির মাঝে ক্ষুদ্র ফ্রেমের পার্থক্য থাকবে যার ফলে তা বিশ্লেষণ করে বোঝা যাবে যে কখন শিক্ষার্থীরা বেশি নড়াচড়া করছে। সাউন্ড সেন্সরের মাধ্যমে ক্লাসের সাউন্ড লেভেলের তারতম্য বিশ্লেষণ করা যায়। সকল তথ্য যথাসময়ে শিক্ষকের কাছে পৌছাতে পারলে তবেই শিক্ষক সেই তথ্যের পূর্ণ সুবিধা নিতে পারবেন। আসল কাজ হলো শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপমুক্ত রাখা। স্কুল এমন একটি জায়গা যেখানে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে। সারাক্ষণ নজরদারির মধ্যে রয়েছে – এই ব্যাপার কারো মাথায় ঢুকে গেলে তার পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ করা সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার্থীদেরকে এই বিশ্লেষণের ব্যাপারে না জানানোই ভাল।
বিল্ডিং ও হোম অটোমেশনঃ
আপনি এমন একটি স্মার্ট হোমের কথা চিন্তা করুন যা আবহাওয়ার সাথে সাথে ঘরের পরিবেশ পাল্টাচ্ছে। অথবা আপনি ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই চালু হয়ে গেল ঘরের লাইট। ভাবছেন কিভাবে? হতে পারে তা আপনার স্মার্ট ফোনের সাথে সংযুক্ত সিগন্যাল থেকে অথবা আপনার ফিঙ্গারটিপ কী লক থেকে। আজকের যুগে এ জাতীয় কোন কিছু কিন্তু কষ্ট কল্পনা নয়।
ইনফ্রাস্টাকচার ম্যানেজমেন্টঃ
মনে করুন আপনি সেতু পার হবেন কিন্তু দিতে হবে না কোন টোল। অথবা সেতুর কোন জয়েন্টে দুর্বলতা দেখা দিচ্ছে। সাথে সাথেই ইঞ্জিনিয়ারের কাছে চলে গেল সিগন্যাল, আর যারা মেরামত করবে তারা পৌঁছে গেলো মেরামতিতে। খালি একবার ভাবুন নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনাজনিত ঝুঁকি কি পরিমাণ হ্রাস পাবে। আর সেটাই সম্ভব আইওটি দিয়ে।
ম্যানুফ্যাকচারিংঃ
আপনার প্রতিষ্ঠানে কি রকম পণ্য উৎপাদন হচ্ছে, উৎপাদন ঘাটতি ঠিক কতটুকু? কিভাবে আপনি উৎপাদিত পণ্য নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাবেন। ঠিক কোথায় পণ্য যাচ্ছে, পরিবহনের অবস্থান কোথায়? ক্লায়েন্ট কোন জায়গা থেকে পণ্য ডেলিভারি নিবে। এই প্রতিটি তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পৌঁছাবে আপনার মুঠোফোনেও আপনার কম্পিউটারে এবং তা শুধু আপনি দেখতে নয় জানতেও পারবেন। সেটাও সম্ভব আইওটি দিয়ে।
কৃষিক্ষেত্রে:
আপনি ব্যবহার করবেন স্মার্ট ফোনে কৃষি মোবাইল অ্যাপস এবং ক্লাউড প্ল্যাটফর্মের সাথে সংযুক্ত ওয়্যারলেস সেন্সরালে পরিবেশগত অবস্থার পরিবর্তন, যেমন – তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, বাতাসের গতি, কীটপতঙ্গ উপসর্গ, আবাদি জমির শুষ্কতা বা পুষ্টির সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আপনাকে সহায়তা করবে।
এনার্জি ম্যানেজমেন্ট:
ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত সেন্সর এবং অ্যাকচুয়েশন সিস্টেমের একত্রীকরণ দ্বারা আপনি প্রতিদিন ঠিক কতটুকু শক্তি খরচ করছেন তা জানা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে আইওটি ডিভাইসগুলি সব ধরনের শক্তি প্রস্তুতকারক যন্ত্রের (স্যুইচ, পাওয়ার আউটলেট, বাল্ব, টেলিভিশন ইত্যাদি) মধ্যে সম্মিলিত হবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং শক্তির ব্যবহারের কার্যকরী ভারসাম্য বজায় রাখবে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক ও বিল আদায়কারী সংস্থা ইউটিলিটি সরবরাহ কোম্পানী, যেমনঃ ওয়াসা, ডেসা, ডেসকো, আরইবি সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হবে। এই ডিভাইসগুলি ক্লাউড-ভিত্তিক ইন্টারফেসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের সহায়তা করবে যেন তারা দূরবর্তী অবস্থানে থেকেও ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক ডিভাইসগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে বা পরিচালনা করতে পারে। এবং নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী যেন তা বন্ধ বা খোলা থাকে। যেমনঃ- দূরবর্তী অবস্থান থেকে চুলায় পানি গরম করা, ওভেন নিয়ন্ত্রণ করা, পানির কল বন্ধ করা ইত্যাদি ।
পরিবেশ পর্যবেক্ষণঃ
আইওটি ডিভাইস এর মাধ্যমে পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করার অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা সম্ভব। সাধারণত বায়ু বা পানির গুণমান, বায়ুমন্ডলীয় বা মৃত্তিকার অবস্থার পর্যবেক্ষণ করে কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষিত এলাকার অবস্থান ইত্যাদি নির্ণয়ে আইওটি ডিভাইস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত থেকে আইওটি ডিভাইস, অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশন যেগুলো ভূমিকম্প বা সুনামির পূর্বাভাস জানাতে সক্ষম তাদের থেকে তথ্য গ্রহণ করে ব্যবহারকারীকে সাবধান করতে পারে।
মেডিকেল ও হেলথ কেয়ারঃ
আপনি ব্যবহার করছেন স্মার্ট রিষ্ট ব্যান্ড। যা বলে দিচ্ছে আপনার পালস রেট, হার্টবিট, স্ট্রেস লেভেল, কত সময় হাঁটলেন, মাপছে আপনার ওজন। এসবই কিন্তু আইওটি ডিভাইস এর অবদান। আইওটি ডিভাইস দূরবর্তী অবস্থান থেকে স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং জরুরী নোটিশ সিস্টেম সক্রিয় করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে আইওটি গবেষণাঃ
বাংলাদেশে ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে আইওটি ল্যাবের বর্তমানে চলমান প্রজেক্টগুলো হলো- পানির অপচয় রোধে স্বয়ংক্রিয় ওয়াটার মিটার স্কিমিং সিস্টেম, জলযান সুরক্ষা ব্যবস্থা, ইন্টারনেট অব থিংস মেডিসিন সিস্টেম, গাড়ি ও মোটর বাইকের অ্যান্টি থেফ্ট সিস্টেম, স্মার্টসিটি ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম, যানবহন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, নদী দূষণ নির্ণয়, গার্মেন্টস বা ফ্যাক্টরিতে আগুনলাগা রোধ করা, স্মার্ট গ্যাস ডিটেকশন সিস্টেম, স্মার্ট ল্যাম্পপোস্ট সিস্টেম ও স্মার্ট গার্বেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদিতে আইওটি ব্যবহারের প্রচেষ্টা চলছে।
আইওটি ডিভাইস কতটুকু নিরাপদঃ
আইওটি ডিভাইস ব্যাবহারের নিরাপত্তা নিয়ে আজ পর্যন্ত অনেক গবেষক শঙ্কিত। আর শঙ্কার কারণ ও ঘটেছে। সাইবার অপরাধীরা বিবভন্ন অ্যাপস কে হ্যাক করে নানা সমস্যা করছে। তাই এখনও নিরাপত্তার ব্যাপার নিয়ে ভাবার অনেক সুযোগ রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *