কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট মানুষের পাশেই থাকবে

হীরেন পণ্ডিত :: অনেক কথাই হচ্ছে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। কিন্তু এই বুদ্ধিমত্তা কার এর সহজ উত্তর, মানুষের। যন্ত্রে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কম্পিউটার দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা। আমাদের সবার পরিচিত রোবট যেমন প্রাণী বা মানুষ আদলে বানানো যন্ত্র যা কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। মানুষ যেভাবে কাজ করে ঠিক সেই ভাবেই কাজ করতে পারে। এই যন্ত্রগুলোর মানুষের মতো উন্নত চিন্তা বা অনুভূতির সংবেদন তৈরি ও প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট কম্পিউটারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট যা প্রোগ্রাম দেওয়া হয় এর বাইরে সে যেতে পারে না। একইভাবে মানুষের মতো সে অনুমান ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্তেও আসতে পারে না। বিজ্ঞানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শাখায় রোবটকে আরও কীভাবে মানব মস্তিষ্কের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায় এসব নিয়েই গবেষণা চলছে।

রোবট হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত এক ধরনের ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল যন্ত্র যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা কোন ব্যক্তির নির্দেশে কাজ করতে পারে। এটি তৈরী হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতিতে যা কম্পিউটা প্রোগ্রাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। রোবট মানুষ কিংবা বিভিন্ন বুদ্ধিমান প্রাণীর মতো কাজ করতে পারে। এটি মানুষ ও মেশিন উভয় কর্তৃক পরিচালিত কিংবা দূর নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। রোবটের আকৃতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যে রোবট দেখতে মানুষের মত তাকে বলা হয় হিউমেনওয়েড। হ্যাকিং অব হিউম্যান ব্রেইন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জন্য ল্যাবরেটরিতে বানানো হচ্ছে কৃত্রিম সাইন্যাপস। এটি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কোষ। এর মাধ্যমে একটি নিউরোন থেকে অন্য নিউরোনে রাসায়নিক বা বৈদ্যুতিক তথ্য যায়। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির দাবি, তারা আর্টিফিশিয়াল সাইন্যাপস তৈরিতে সফল হয়েছে। এখন আরও উচ্চতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

যদি তারা সফলভাবে আর্টিফিশিয়াল সাইন্যাপস প্রতিস্থাপন করতে পারে তাহলে মানুষের মতো উন্নত চিন্তা, সংবেদন ও সেই পরিপূরক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়ে উঠবে রোবটগুলো। এমনকি এই রোবটগুলো মানব মস্তিষ্ককে হ্যাকও করতে পারবে। যা বড় ধরনের নৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় ঘটাবে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। এই সোসাইটির নতুন গবেষণা ও এর সাফল্য নিয়ে এর মধ্যেই শোরগোল পড়ে গেছে সব শাখার বিজ্ঞানীদের মধ্যে। তাদের বক্তব্য, সবকিছুরই ক্রিয়া ও বিপরীত প্রক্রিয়া রয়েছে। আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কী চাই এবং এর বিনিময়ে কী হারাবো। বাংলাদেশে কোথাও কোথাও রোবটের ব্যবহার শুরু হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়। তবে কি একদিন আমাদের পোশাক কারখানাগুলোতেও সারি সারি নারী-পুরুষের জায়গায় দেখব কয়েকটি করে রোবট? রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার পরিবেশন করছে রোবট? ছোট ছোট দোকানগুলো আর নেই; কেনাকাটা চলছে বিশাল কয়েকটি বিপণিবিতানে, যেখানে বিক্রয়কর্মী মানুষ নয়, রোবট?

মানব কল্যাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক কথায় বললে সবই এখন স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দখলে। অর্থাৎ সুই-সুতো বানানোর কারখানা থেকে হেল্পলাইনের ভয়েস, সবক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবট। রোবট শব্দটির উৎপত্তি চেক শব্দ ‘রোবোটা’ থেকে, এর অর্থ ফোরসড্ লেবার বা মানুষের দাসত্ব কিংবা একঘেয়েমি খাটুনি বা পরিশ্রম করতে পারে এমন যন্ত্র। বলাই বাহুল্য, সেটি সে দারুণভাবেই করে চলেছে।

মঙ্গল গ্রহ থেকে মার্স রোভারের নিয়মিত তথ্য পাঠানো, সমুদ্রগভীরে গিয়ে গবেষণা, কারখানায় ১শ জনের কাজ একাই করে দেওয়া অক্লান্ত কর্মী, ঝাড়ু-মোছা কিংবা শয়নকক্ষে সবই সে সামলাচ্ছে নিপুণভাবে। বিনিময়ে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।

গুগলের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি ‘ডিপমাইন্ড’ যৌথভাবে কাজ করছে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সঙ্গে। তারা একটি সফটওয়্যার তৈরি করছে যেটি লক্ষণ দেখে ক্যানসার নির্ণয় ও চোখের রোগ আরও নিখুতভাবে ধরতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি হার্টের রোগ ও আলঝেইমারের উপসর্গ ও অবস্থা বলে দেবে অন্য আরেকটি সফটওয়্যার।

গ্লোবাল শিপিং ও ই-কমার্স লেনদেনের মতো জটিল বিষয়গুলোও সে সামলাচ্ছে বিশ্বস্ততার সঙ্গে। খুব বেশিদিন দূরে নেই, যেদিন যানবাহন চালনা, শেয়র মার্কেটের দেখভাল, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, হিসাব সামলানোর মতো জটিল-সময়সাপেক্ষ কাজগুলোও পুরোপুরি চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে।

সারা বিশ্বের কারখানাগুলো চলে যাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দখলে। একেকটি মেশিন কম সময়, খরচ ও নিপুণতার সঙ্গে শতাধিক মানুষের কাজ করছে। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তে পারে বেকারত্ব, সেখান থেকে অভাব-হতাশা-নৈরাজ্য। ধীরে ধীরে মানুষের কাজের জায়গাগুলো নিয়ে নিচ্ছে রোবট। এর মধ্যে ঘোর বিপদ দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটেনে শ্রমিকদের একটা গোষ্ঠী কাপড় বোনার যন্ত্র ভাঙচুর শুরু করে। কারণ, তারা মনে ভেবেছিল, এসব যন্ত্র ব্যবহৃত হলে তাঁত শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়বে। নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি মানুষের কাজ নিয়ে নেবে কি না, এই প্রশ্ন কিন্তু বেশ পুরোনো | শ্রমের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবৃত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে ইদানীং গবেষণা হচ্ছে। এ বছর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি ও সংস্থা কিছু গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যদিও তারা কেউ বলছে না যে আগামীকাল বা আগামী বছরই রোবটরা সবার চাকরি নিয়ে নেবে, তবু বিষয়টি সারা বিশ্বে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

সব পেশার প্রায় ৫ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণভাবে রোবটের মাধ্যমে করা যাবে। ৬০ শতাংশ পেশার অন্তত ৩০ শতাংশ কাজে রোবট ব্যবহার সম্ভব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির ব্যবহার বেশি সম্ভব শিল্প, পরিবহন ও গুদামজাতকরণ, পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় ইত্যাদি খাতে | সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হবে জাপান, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। এ সম্ভাবনা কবে নাগাদ বাস্তবে পরিণত হতে পারে, সে বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না। কোনো কোনো প্রতিবেদনে আগামী তিন-চার দশকের কথা বলা হয়েছে । কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে বলা যায়, কিছু চাকরি বিলুপ্ত হবে, কিছু নতুন ধরনের চাকরি সৃষ্টি হবে। সার্বিক প্রভাব ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে তা বলা কঠিন। তবে অশিক্ষিত ও তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষিত ব্যক্তিরা এই প্রক্রিয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। উচ্চশিক্ষিত ও বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিতরা ভালো অবস্থানে থাকবেন| নতুন প্রযুক্তির ফল যেন স্বল্প কিছু লোক বা শ্রেণির মধ্যে সীমিত না থাকে তা নিশ্চিত করতে এবং নেতিবাচক ফলগুলো যথাসম্ভব কমাতে সরকারি নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান কমেনি, বরং বেড়েছে। মন্দার সময়গুলো বাদে সে দেশে কিন্তু চাকরির সংখ্যা কমেনি। একধরনের প্রযুক্তি মানুষের শ্রমের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। আবার এমন প্রযুক্তি আছে, যেগুলো শ্রমের পরিপূরক বা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সহায়ক। যেকোনো সময় দুই ধরনের প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হতে পারে | কর্মসংস্থানে তার চূড়ান্ত ফল কী হবে তা নির্ভর করবে এই দুই শক্তির কোনটি বেশি প্রভাবশালী তার ওপর।

১০-১৫ বছর আগেও আমাদের অনেকের মুঠোফোন ছিল না; এখন এই ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এর উৎপাদন, বিক্রি ও রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যেসব চাকরি জড়িত, তার কথা কি আমরা দুই দশক আগে ভাবতে পারতাম? অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ব্যবহারের তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য ও সেবা; তাদের উৎপাদনের মাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।

অর্থনৈতিকভাবে রোবটের ব্যবহার যদি যৌক্তিক হয় তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা কিছু ইতিবাচক ফল দিতে পারে | তবে সঙ্গে সঙ্গে কিছু চিন্তার বিষয় এবং চ্যালেঞ্জও থাকবে। সেগুলো মোকাবিলা করতে পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন হবে |

যখন দেশের সব উদ্বৃত্ত শ্রম শেষ হবে এবং শ্রমিকের সরবরাহে ভাটা পড়বে, তখন এই প্রযুক্তি অবশ্যই কাজে আসবে | কিছু কাজ রোবটের মাধ্যমে করানো হবে, পাশাপাশি কিছু নতুন কাজের সুযোগ ও প্রয়োজন সৃষ্টি হবে। বিভিন্ন খাতে উৎপাদনক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়বে, ফলে পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা থাকবে। তার ফলে ভোক্তা উপকৃত হবেন। তাঁদের চাহিদা বাড়তে পারে; চাহিদা বাড়লে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে। তবে ভরা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট মানুষের পাশেই থাকবে সব কাজে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *