হীরেন পণ্ডিত
এক গবেষণায় বলা হয়েছে প্রযুক্তিগতভাবে সামনের ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন দেশের কর্মক্ষেত্রে অনেক কাজে সহায়তা করবে রোবট। ভবিষ্যতে অফিসের ক্লার্ক, ব্যাংক টেলার, নিরাপত্তাকর্মী, সুপার মার্কেটের দোকানদার, ট্রেন অপারেটর, বিভিন্ন খাবারের ডেলিভারি বয়, ক্লিনারসহ আরো অনেক সাধারণ কাজ রোবটদের দিয়েই করানো হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। বিভিন্ন আইটি বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিবেদনে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে এই বিষয়টি জানানো হয়েছে যে সবকিছুই রোবট দিয়ে করা যাবে না। কিছু পেশা, যেমন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, সমালোচক, আইনজীবী, শিক্ষক, আলোকচিত্রশিল্পী, টিভি সম্প্রচারকারী, লেখক তাঁদের বিকল্প কখনোই রোবট হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে মজার বিষয় সাংবাদিকতার কিছু কাজও রোবটকে দিয়ে হতে পারে, তবে সব কাজ নয়। প্রযুক্তির যে অগ্রগতি হয়েছে আজকাল সেখানে যে রোবট মানুষের বেশ কিছু জায়গা দখল করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে স্বয়ংক্রিয়তা আর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রকৌশল চিকিৎসা খাতেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন সাংবাদিকতাতেও স্থান করে নিচ্ছে। সাংবাদিকতা এমন একটি ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে, যেখানে রোবটদের ব্যবহার করা হবে সাংবাদিকতার পরিমাণগত বিষয়গুলো উৎপাদনে।
রোবট সাংবাদিকতা করবে বিষয়টা শুনতে যতই কাল্পনিক লাগুক না কেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এটি সামনের দিনে আমাদের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠবে। আমরা জানি, বার্তা সংস্থা এসোসিয়েট প্রেসের (এপি) ওয়ার্ডস্মিথ সফটওয়্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে কলেজভিত্তিক খেলাধুলার প্রতিবেদনগুলো নিজেই তৈরি করে। সফটওয়্যারটি তৈরি করেছে নর্থ ক্যারোলাইনার অটোমেটেড ইনসাইটস নামে একটি কোম্পানি। এই সফটওয়্যার তৈরিতে এপিও বিনিয়োগ করেছে।
বিশেষ অ্যালগরিদম বা কম্পিউটারের ভাষার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদন তৈরি করে ওয়ার্ডস্মিথ সফটওয়্যার। একই সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিভিন্ন করপোরেট সংস্থার ত্রৈমাসিক আয়ের খতিয়ানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা শুরু করে দিয়েছে এপি। ফলে প্রতি তিন মাসে এরা চার হাজার হাজার করপোরেট আয়ের রিপোর্ট নিয়ে প্রতিবেদন রচনায় সক্ষম হবে, যা একজন মানুষের তুলনায় ১০ গুণ বেশি।
শুধু এপি নয়, পশ্চিমা অনেক সংবাদ সংস্থা রোবট সাংবাদিকতা নিয়ে বেশ জোরেশোরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছে। সংবাদ প্রতিবেদন ও মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনায় তথ্য স্থানান্তরের জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
পূর্বনির্দেশনা অনুযায়ী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট বিশাল তথ্যভাণ্ডার থেকে তথ্য বিশ্লেষণ করে আগে থেকেই প্রোগ্রাম করে রাখা কাজ নিজেরা বুঝে নিতে পারবে। কাজেই এটা খুব সহজে বলাই যায়, নিয়মিত সরকারি ঘোষণা, সব পরিসংখ্যান, প্রেস বিজ্ঞপ্তি-সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটের হাতে চলে যাবে। অন্যদিকে মানুষের হাতে থাকবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, গভীর বিশ্লেষণ আর মানবিক আবেগ সমৃদ্ধ খবর ও কাহিনী।
বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার না করার পেছনে যে যুক্তিটি কাজ করছে তা হলো একজন মানুষ প্রতিবেদক যেভাবে সম্পূর্ণরূপে কাঠামোগত ও নতুন অর্থনৈতিক মোড়গুলো বুঝতে পারবে, সেভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট পারবে না।
বিশ্বের বিভিন্ন খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন জায়গায় মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। তবে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্য রকম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিবেদককে বরং বিভিন্ন জটিল হিসাব, পরিসংখ্যান ইত্যাদি ঝামেলা থেকে মুক্তি দেবে। তবে সাংবাদিকদের জন্য এআই রোবট নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যখন এআই প্রযুক্তিটি আরো উন্নত হয়ে নাক গলাতে শুরু করবে সম্পাদকীয়, তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও মানুষের আগ্রহমূলক সংবাদগুলোতে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, মানুষ একসময় গুপ্তচরবৃত্তি ও প্রযুক্তির সহয়তায় এমন যন্ত্র তৈরি করেছিল, যা দিয়ে অনেক গোপন বার্তা উদ্ধার করা গিয়েছিল, এতে মানুষের কষ্ট কমেছিল। কাজেই ভবিষ্যতেও যন্ত্র, অর্থাৎ রোবট মানুষের কাঁধ থেকে কাজের বোঝা লাঘব করবে।
যতই রোবটের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি হোক, মানুষের প্রেরণা ও আবেগ তাতে পাওয়া যাবে না। যদিও আজকের দিনে বলা হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেও ছাপিয়ে যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবশ্য এরই মধ্যে খেলা শিখে যাচ্ছে এবং খেলায় জয়ও পাচ্ছে।
পরিশেষে আমরা একটা বিষয়ে একমত হতে পারি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাংবাদিকদের বিভিন্ন অনুসন্ধানী কাজে বৃহৎ তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি প্রাসঙ্গিক দিক তুলে ধরতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি প্রযুক্তি সংবাদ কক্ষের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। সাংবাদিকতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে কি না, আমরা তা জানতে পারব অদূর ভবিষ্যতেই।
রোবট নিয়ে মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধির রোবট যদি মানুষের কাজের ক্ষেত্রগুলো দখল করে, তবে অনেকেই বেকার হয়ে পড়বে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোবট নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। মানুষের পাশাপাশি কাজ করবে রোবট। মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এতে মানুষ আরও সৃজনশীল কাজের সময় পাবে। রোবট নিয়ে মানুষের ভয় দূর করার জন্য কাজ করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। তারা এমন আকর্ষণীয়ভাবে রোবট তৈরি করছে, যাতে রোবট সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে যায়।
রোবট ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আজ হোক কাল হোক মানুষের সঙ্গে সহ-অবস্থান করবে রোবট, মানুষের কাজে সহায়তা করবে রোবট। মানুষসদৃশ রোবট হলে তাকে গ্রহণ করা সহজ হয়। মানুষ তার সক্ষমতা তার নড়াচড়ার ধরন আন্দাজ করতে পারে। এটা স্বস্তিদায়ক। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। রোবট যদি মানুষের কাছে পরিচিত আকারের হয়, তবে তার প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়।