জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার

হীরেন পণ্ডিত:: আমরা যেকোন তথ্য জানতে চাইলেই হাতের কাছে রয়েছে গুগল। বর্তমানে গুগল এতটাই জনপ্রিয় যে গুগল শব্দটি ডিকশনারিতেও জায়গা করে নিয়েছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে অনেক সময় উত্তর পাওয়া যায়, গুগল করো, কিন্তু গুগল কীভাবে তথ্য খুঁজে বের করার কাজটি করে থাকে সেটি কি আমরা জানি। অন্তর্জাল ব্যবহার করে কিন্তু গুগলের নাম শুনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন, তবে তথ্য অন্বেষণে কিন্তু গুগল ছাড়াও বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিন রয়েছে এগুলো নিজ নিজ স্বকীয়তার জন্য জনপ্রিয় এবং সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে প্রসিদ্ধ। যদিও জনপ্রিয়তার দিক থেকে বর্তমানে গুগলের আশেপাশেও নেই অন্য কোন সার্চ ইঞ্জিন।

গুগল ইনকরপোরেটেড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট ও সফটওয়্যার সেবাদানকারী একটি বহুজাতিক কোম্পানি। বিশেষভাবে তাদের গুগল সার্চ ইঞ্জিন, অনলাইন বিজ্ঞাপন সেবা ও ক্লাউড কম্পিউটিং সেবার জন্য এটি বিখ্যাত। গুগলের আয়ের মূল উৎস বিজ্ঞাপন, যা এডওয়ার্ডস প্রোগ্রামের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। গুগলের প্রধান কার্যালয় ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেইন ভিউ শহরে। গুগলের মূল কাজ হলো বিশ্বের সব তথ্য সন্নিবেশিত করে সবার জন্য সহজলভ্য করে দেওয়া। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন পিএইচডি ছাত্র ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন গুগলের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর গুগল প্রথম ইনকরপোরেট গুগল শুধু সার্চ ইঞ্জিনই নয়, অনলাইন আরও নানা ধরনের সেবা, যেমন: জিমেইল-ই-মেইল সেবা, গুগল ডকস-অফিস সেবা, ইউটিউব -ভিডিও সেবা, গুগল ড্রাইভ-স্টোরেজ সেবা, গুগল প্লে স্টোর অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপস সেবা, গুগল ক্যালেন্ডার, গুগল ম্যাপস, গুগল ট্রান্সলেটর, ব্লগার, গুগল প্লাস-সামাজিক নেটওয়ার্কিং সেবা প্রভৃতি ছাড়া আরও অনেক সেবা প্রদান করে থাকে। গুগলের পণ্য ইন্টারনেট ছাড়াও ডেস্কটপেও ব্যবহার হয়। যেমন: গুগল ক্রোম-ওয়েব ব্রাউজার, পিকাসা-ছবি সংগঠিত এবং সম্পাদন করার সফটওয়্যার এবং গুগল হ্যাংআউট-ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজিং অ্যাপ্লিকেশন প্রভৃতি। গুগল মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের জন্য অ্যান্ড্রয়েড এবং গুগল ক্রোম অপারেটিং সিস্টেমের জন্য ব্রাউজার অপারেটিং সিস্টেম, যা শুধু বিশেষ ল্যাপটপ ক্রোমবুকে পাওয়া যায়। গুগলের ইলেকট্রনিকস পণ্যের মধ্যে রয়েছে গুগল গ্লাস, গুগল পিক্সেল ২ মোবাইল ফোন, গুগল পিক্সেল বুক, গুগল হোম-স্পিকার, গুগল ওয়াই-ফাই প্রভৃতি।

গুগলকে আমরা মূলত একটি সার্চ ইঞ্জিন হিসেবেই জানি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যনতুন পণ্য ও সেবা তৈরি করে গুগল প্রতিনিয়ত নিজেদের আকার ও উপযোগিতা মানুষের কাছে বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন কোম্পানি কিনে ও ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব এবং বিজ্ঞাপন জগতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার মধ্য দিয়ে নিজকে বহুমুখী হিসেবে সমৃদ্ধ করেছে। ফলে তথ্য খোঁজার পাশাপাশি বর্তমানে ই-মেইল, সামাজিক নেটওয়ার্কিং, ভিডিও শেয়ারিং, অফিস প্রোডাকটিভিটি, ইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরি, বিজ্ঞাপন প্রভৃতি বিষয়ে গুগলের সেবা রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহার করে, কিন্তু গুগল সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৯১ দশমিক ৬৩ শতাংশ মানুষ গুগল ব্যবহার করে। গুগলের মূল আয়ের উৎস হলো বিজ্ঞাপন, যা থেকে গুগলের প্রায় ৯৯ শতাংশ আয় আসে। গুগল জানায় তাদের বার্ষিক দশমিক ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এর বেশি।

সারা দুনিয়া জুড়ে কোটি কোটি মানুষ ব্যবহার করছেন এই গুগল, এবং অনেকের কাছেই এটি তাদের ইন্টারনেট কার্যক্রমে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। গুগুল হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভিজিটেড ওয়েবসাইট, অর্থাৎ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই এই ওয়েবসাইটটিতে অন্তত একবার ঘুরে গেছেন। আপনি যা চাচ্ছেন গুগল কিন্তু তাই এনে দিচ্ছে। যা চাচ্ছেন তার কাছকাছি আরো অনেক কিছুই আপনার সামনে হাজির করছে। তা সম্ভব হচ্ছে গুগলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে। গুগলের হেডকোয়ার্টার পরিচিত ‘গুগলপ্লেক্স’ নামে এবং এটি অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে। গুগলপ্লেক্সে টি-রেক্স জাতীয় ডাইনোসরের একটি বিশাল মূর্তি আছে – যার ওপর প্রায়ই অসংখ্য প্লাস্টিকের তৈরি গোলাপি ফ্ল্যামিঙ্গো বসে থাকতে দেখা যায়। গুজব রয়েছে যে এটা হচ্ছে কর্মচারীদের প্রতি এক সতর্কবার্তা যেন তারা কখনো গুগলকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে না দেন। গুগলের হেডকোয়ার্টারটি বিশাল এবং এর ভেতরে অনেক সবুজ জায়গা আছে। এখানে ঘাস কাটার জন্য লন-মোয়ার মেশিন ব্যবহার করা হয় না। এ জন্য গুগল বাইরে থেকে ছাগল ভাড়া করে নিয়ে আসে। গুগল হচ্ছে প্রথম বড় প্রযুক্তি কোম্পানি যারা তাদের কর্মচারীদের বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করে। তা ছাড়া কর্মচারীদেরকে তাদের পোষা কুকুর অফিসে নিয়ে আসতে দেয়া হয়। ২০০১ সালে চালু করা হয় গুগল ইমেজ সার্চ -যার অনুপ্রেরণা ছিল ২০০০ সালের গ্র্যামি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে জেনিফার লোপেজের পরা সবুজ পোশাক। এটি গুগলের সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চে পরিণত হয়েছিল। গুগলের নিজস্ব ইমেইল সেবা জিমেইলের কথা ঘোষণা করা হয় ২০০৪ সালে ১লা এপ্রিল বা এপ্রিল ফুলস ডে-তে। অনেকেই ভেবেছিলেন যে এটা আসলে একটা রসিকতা। গুগলকে একটি ক্রিয়াপদ হিসেবে ‘গুগল করা’ অর্থে প্রথম অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ২০০৬ সালে। মিরিয়াম-ওয়েবস্টার অভিধান লিখেছিল, গুগল করা মানে হচ্ছে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব থেকে কোন তথ্য অনুসন্ধান করার জন্য গুগল সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করা। এ্যাপোলো ১১তে চড়ে চাঁদে মানুষ পাঠাতে যতটুকু কম্পিউটিং ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়েছিল – এখন মাত্র একটি গুগল সার্চে প্রায় সেই পরিমাণ কম্পিউটিং ক্ষমতা কাজে লাগানো হয়। গুগল এখন শুধু একটি সার্চ ইঞ্জিন নয় এটিতে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্ট্রিমিং-ভিত্তিক গেম খেলার ব্যবস্থা, এমনকি ড্রাইভারবিহীন গাড়িও থাকবে।

জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগল বেশকিছু পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তাদের সেবায়। ব্যবহারকারীদের উন্নত সার্চ রেজাল্ট প্রদানের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেছে বলে জানিয়েছে গুগল। প্রতিষ্ঠানটি ‘সার্চ অন’ ইভেন্টে গুগল সার্চকে উন্নত করার বিষয়ে নিজেদের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে। সেই পরিকল্পনার প্রধান অংশ হল, বানান পরীক্ষার স্পেল চেক-এর নতুন একটি টুল। গুগল বলছে, বানান পরীক্ষার নতুন টুল প্রয়োগের পর কেউ ভুল বানান লিখে সার্চ করলেও সঠিক ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা এখনকার চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে। অনেক ব্যবহারকারী কোনো কিছু সার্চ করতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই বানান ভুল করেন। কিন্তু গুগল স্পেল চেকিংয়ের নতুন একটি টুল চালু করার পর ব্যবহারকারী বানান ভুল করলেও সঠিক ফল-ই পাবেন। এ সম্পর্কে গুগলের সার্চ বিভাগ জানিয়েছে, প্রতিদিন গুগল সার্চে যে জিজ্ঞাসা থাকে, তার মধ্যে ১৫ শতাংশ গুগল আগে কখনও দেখেনি। ফলে সার্চ রেজাল্ট নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।

যখন গুগল ছিল না তখনকার জীবনের কথা কি আপনি মনে করতে পারেন, তখন আপনি কি করতেন, যখন হঠাৎ করে অথবা তড়িঘড়ি করে কোন বিষয়ে তথ্য প্রয়োজন হতো, এখন যা কিছুই খোঁজেন না কেন- সব কিছুর জন্যই হয়তো আপনি এখন গুগলে সার্চ করেন। গুগল প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৪০ হাজার অনুসন্ধানের উত্তর খুঁজতে পারে। প্রতিদিন যার মানে সাড়ে তিন বিলিয়ন অনুসন্ধান ফোর্বসের হিসাব। অনলাইন জায়ান্ট গুগল সার্চ ইঞ্জিনের গণ্ডি পেরিয়ে নিয়ে এসেছে নানা ধরনের সেবা। এসব সেবা জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে ব্যবহারকারীদের মাঝে। আবার অনেক সেবাই সাড়া ফেলতে পারেনি প্রযুক্তি বিশ্বে। যার ফলে এসব সেবার বন্ধ করে দেয় গুগল। এমনকি আলোড়ন সৃষ্টি করা অনেক সেবাই সময়ের সাথে সাথে বন্ধ করে দেয় গুগল। নতুন পণ্য সেবা নিয়ে আসা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে সব সময়ই কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। গ্রাহকের কাছে পণ্যসেবা গুলোর জনপ্রিয় অর্জনে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে। তারপরও প্রতিষ্ঠান গুলোকে গুণতে হয় লোকসান। তবে অ্যাপলকে হটিয়ে চলতি বছর ব্র্যান্ডজি-র তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে ইন্টারনেট কোম্পানি গুগল৷ গত কিছুদিনে গুগল গ্লাসের মতো উদ্ভাবন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় বিনিয়োগ এবং গাড়িতে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারের জন্য অটোমোবাইল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি মিলিয়ে গুগলের ব্র্যান্ড ভ্যালু প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে ১৫৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গুগল সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আরো নতুন কত কিছু করবে তা দেখার অপেক্ষায় পুরো বিশ্ব তাকিয়ে গুগলের দিকে।

লেখক: রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *