ইন্টারনেট ভিত্তিক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাজস্বের বাইরে নয়

হীরেন পণ্ডিত: সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া নতুন একটি আইন পাস করেছে। যার মাধ্যমে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো সংবাদমাধ্যমকে তাদের কনটেন্টের জন্য মূল্য দিতে বাধ্য থাকবে। ফেইসবুক ও গুগলের মতো প্রযুক্তি জায়ান্ট থেকে সংবাদের জন্য অর্থ আদায়ে এটিই পাস হওয়া প্রথম আইন। যার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সারা বিশ্ব।

সিএনএন বলছে, দেশটির সংসদে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ৪ মার্চ ২০২১-এ আইন পাস হয়। অস্ট্রেলিয়ার ট্রেজারার জোশ ফ্রাইডেনবার্গ এক বিবৃতিতে খবরটি প্রকাশ করেন। এ আইন সংবাদমাধ্যমগুলোকে পরিবেশিত কনটেন্টের জন্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশটির নতুন আইন নিয়ে বিতর্ক চলছিল। এ আইনের প্রাথমিক সংস্করণের বিরোধিতাও করে ফেইসবুক ও গুগল। যেখানে আলাদা বা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে মিডিয়া আউটলেটগুলোকে দর-কষাকষির অনুমোদন দেয়া হয়। এতে তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারলে সালিশেরও সুযোগ রয়েছে।

‘নিউজ মিডিয়া অ্যান্ড ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মস ম্যান্ডেটোরি বারগেনিং কোড ২০২১’ নামের আইনটিই পৃথিবীর প্রথম আইন, যা সাংবাদিকতার বিজনেস মডেলের রূপান্তর ও বিকাশের প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ফেসবুক শেষ পর্যন্ত এই আইন মেনে নিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো কী হারে পয়সা দেবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেবে না; সংবাদমাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিজেদের মধ্যে দর-কষাকষি করে রাজস্ব ভাগাভাগির হার নির্ধারণ করবে, সে অনুযায়ী চুক্তি করবে।

এর প্রতিবাদে গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার নিউজ পেজগুলো বন্ধ করে দেয় ফেইসবুক। কিন্তু আইনে পরিবর্তনের পর পেজগুলো খুলে দেওয়া হয়। যোগ করা হয় নতুন বিধান। যেখানে বলা হয়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটি বাণিজ্যিক চুক্তির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদ শিল্পের স্থায়িত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে কি-না বিবেচনায় রাখতে হবে। ফেইসবুকের মতে, এ সংশোধনী তাদের পছন্দমতো প্রকাশকদের সমর্থন দিতে অনুমতি দেবে। এরপরই অস্ট্রেলিয়ার বড় নিউজ কোম্পানি সেভেন ওয়েস্ট মিডিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি প্রকাশ করে ফেসবুক।

অপরদিকে সেভেন ও রুপার্ট মারডকের নিউজকর্পসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারের ঘোষণা দিয়ে নতুন আইনটি এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে বলে জানায় গুগল। প্রাথমিক বিরোধিতার পর আইন মেনে নেয়াকে ফেইসবুক ও গুগলের আপস বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার দেখাদেখি আরও দেশ এই পথ ধরতে পারে।

এ দিকে দেশটির সরকার জানিয়েছে, এক বছর পর প্রাপ্ত ফলাফল থেকে আইনটি পর্যালোচনা করবে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট থেকে পাওয়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর রাজস্বের ওপর তার একক নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দিয়ে রাজস্ব ভাগাভাগির ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের দর-কষাকষির আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

ফেসবুক, গুগলসহ ইন্টারনেটভিত্তিক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয় কার্যালয় না থাকায় দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের ট্যাক্স, ভ্যাট ও অন্যান্য রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। এমনকি রাষ্ট্রবিরোধী ও স্পর্শকাতর নানা বিষয়ে কনটেন্ট সরাতে বললেও তারা কানে তুলছে না। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পাশাপাশি আমাদের দেশের উচ্চ আদালতও এই বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ব্যবস্থা নেয়ার পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু আইনি কাঠামো ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকায় এসব নির্দেশনা কার্যকর করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাকে। এ রকম প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো কঠোর অবস্থানে যাওয়ারও দাবি উঠেছে।

নিউজ কনটেন্টের জন্য ফেসবুককে মূল্য পরিশোধে বাধ্য করার জন্য এবার অস্ট্রেলিয়ার পথে হাঁটছে কানাডাও। কানাডা সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ফেসবুক নিউজ কনটেন্টের জন্য মূল্য পরিশোধের ব্যাপারে তারাও আইন করতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ফেসবুক যদি নিউজ প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়, তার পরও কানাডা সরকার পিছু হটবে না। আইনটি আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই অনুমোদন পাবে। তথ্যপাচার ঠেকানো এবং দেশীয় মাধ্যমের প্রসারে ফেসবুক, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে চীন।

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার পরও ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ফ্রান্স ফেসবুকসহ ইন্টারনেট জায়ান্টগুলোর ওপর ডিজিটাল সেবা কর আরোপ করে আইন পাস করে। ওই আইন অনুযায়ী ফেসবুক, গুগল, অ্যাপলসহ বৈশ্বিক ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিক্রির ওপর ভিত্তি করে ৩ শতাংশ কর দিতে হয়। এই কোম্পানিগুলোর ওপর ২০২২ সাল নাগাদ ডিজিটাল কর আরোপের পরিকল্পনা কানাডারও রয়েছে। ফেসবুকসহ ইন্টারনেট জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা যে দেশে ব্যবসা করে সেখানে যথাযথভাবে কর পরিশোধ করে না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ব্যবহারকারীদের অধিকার নিশ্চিত করতে ‘তথ্য প্রযুক্তি বিধি-২০২১’ প্রণয়ন করেছে ভারত সরকার। ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে অবশ্যই তাদের দেশের সংবিধান ও নীতি মেনে চলতে হবে। অপব্যবহার ও অবমাননার ক্ষেত্রে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউবের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।

নতুন নীতিমালায় যা রয়েছে- নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে সামাজিক মাধ্যমগুলো ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপ্রীতিকর ছবি ও ভিডিও সরাতে বাধ্য থাকবে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে অভিযোগ জানানোর জন্য এ বিষয়ক কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। ওই কর্মকর্তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহারকারীর কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করবেন এবং ১৫ দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান করবেন। ভারত সরকার ব্যবহারকারীর সংখ্যার ভিত্তিতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। এক. তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক মাধ্যম। দুই. সামাজিক মাধ্যম। তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক মাধ্যম অর্থাৎ ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউবের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতিরিক্ত কিছু নিয়ম মানতে হবে। ফেসবুক ও অন্যান্য বড় সামাজিক মাধ্যমগুলোকে একজন প্রধান সম্মতি কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে, যিনি আইন ও বিধি নিশ্চিতের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ থাকবেন। তাকে অবশ্যই ভারতের বাসিন্দা হতে হবে।

বড় সামাজিক মাধ্যমগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য একজন যোগাযোগ কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। যোগাযোগ কর্মকর্তাকে অবশ্যই সেদেশের বাসিন্দা হতে হবে। তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক মাধ্যমগুলোকে প্রতিমাসে একটি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। প্রতিবেদনে ব্যবহারকারীর কাছ থেকে প্রাপ্ত অভিযোগ এবং অভিযোগের সমাধান ও অপ্রীতিকর ছবি, ভিডিও সরানোর প্রমাণ থাকতে হবে। যদি কোনো মাধ্যম নীতি অমান্য করে সেক্ষেত্রে ভারত সরকারের নিরাপদ আশ্রয়ের বিধান তার জন্য প্রযোজ্য হবে না।

বাংলাদেশ এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে কর ফাঁকির বিষয়টি এখন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে। স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি কঠোরভাবে দেখছে। শুধু কর ফাঁকিই নয়, দেশে ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ইত্যাদি নিয়ে এসব মাধ্যমে জঘন্য ধরনের প্রচারণা করা হয়, যা থেকে বাদ যান না সেনাবাহিনী, পুলিশ, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও। আমাদের জন্য মহাবিপজ্জনক কনটেন্ট সরাতে অনুরোধ করলেও ওরা সেগুলো সরায় না। দুনিয়ার কোথাও এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, যেটি দিয়ে এই সমস্যার মোকাবিলা করা যায়। ফলে তাদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া বিকল্প নেই। আমরা অন্য দেশ থেকে কিছু অভিজ্ঞতাও নিচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যন্ত্রণার চোটে বিভিন্ন দেশ আইন করেছে এবং করছে।

আমাদের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে কিছু ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এটি করা হয়েছে সাধারণ অপরাধের জন্য, যেখানে শাস্তির পরিমাণ কম। এ ধরনের ছোটখাটো শাস্তি দিয়ে এ জাতীয় বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়মের মধ্যে আনা যাবে না। এ বিষয়ে একজন আইন উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আইনিকাঠামো শক্তিশালী হওয়া দরকার, যাতে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবকে জরিমানা করা যায়।

এ বিষয়ে আমাদের রাজস্ব বোর্ডেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বিজ্ঞাপন থেকে টাকা আয় করছে। টাকাকে তারা ডলারে রূপান্তর করছে কী করে, তা জানা যায় না, তারা এ দেশ থেকে যে পরিমাণ আয় করছে, সেটার করও দিচ্ছে না। তাদের সাইট বন্ধ করা যায়। তবে পুরো প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করাটাই আসল সমাধান নয়, যেটা বন্ধ করা দরকার তার জন্য সেই প্রযুক্তির খোঁজ করছে বাংলাদেশ।

এদিকে অনলাইন বিজ্ঞাপনের নামে বছরে ৫০০ কোটি টাকার বেশি নিয়ে যাচ্ছে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া। দেশে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়াও বিলের ওপর ৪ শতাংশ কর কাটা হয়। কিন্তু বিদেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্বীকৃত কোনো অফিস কিংবা লেনদেনের বৈধ মাধ্যম না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কর আদায় কিংবা হুন্ডি প্রতিরোধ কঠিন হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য তাদের অনুমোদন নিতে হয় না। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো এজেন্ট বিজ্ঞাপনের ব্যয় পরিশোধের জন্য টাকা পাঠাতে চাইলে এই অনুমোদন লাগে। কেস টু কেস ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ এই অনুমোদন দিয়ে থাকে। রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টিতে এনবিআর কাজ করছে। তারা বৈধ উপায়ে টাকা নিচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশিত চ্যানেলে তাদের টাকা নিতে হবে। ফেসবুক গণমাধ্যম নয়, এটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমরা অস্ট্রেলিয়ার মতো চিন্তা করতে পারিনি। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা করে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের হিসাব রাখা যত সহজ, অনলাইন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের হিসাব রাখা কঠিন। সব বিজ্ঞাপন সবাই দেখতে পাবে না। এ জন্য তাদের বাংলাদেশে অফিস চালু করতে বাধ্য করা যেতে পারে।

এদিকে সার্চ ইঞ্জিন গুগল, ইয়াহু, ই-কমার্সের আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবসহ ইন্টারনেটভিত্তিক সব প্ল্যাটফর্ম থেকে কর, ভ্যাটসহ সব ধরনের রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই সব কোম্পানির অনুকূলে এ পর্যন্ত পরিশোধিত অর্থ থেকে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এই রাজস্ব আদায় করতে বলা হয়।

লেখক: রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *