হীরেন পণ্ডিত
বর্তমান সরকারের আমলে মায়ের অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নের এক মাইলফলক। বাংলাদেশে নারী মুক্তির ইতিহাস দীর্ঘদিনের, স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। সুদৃঢ় প্রশাসনিক ও আইনী কাঠামো, সচেতন নাগরিক সমাজের কারণে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে যা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং নারী-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ শুরু থেকেই নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সনদে (সিডও) স্বাক্ষর করেছে। সব ধরনের শিক্ষায় নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাসহ উচ্চ শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করা ছিলো অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। জেন্ডার সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ও লক্ষ্যমাত্রাগুলোতে (টার্গেটগুলোতে)অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিলো।
কারণ হিসেবে বলা হয়েছে জন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য অনেকটাই কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন জেন্ডার সমতা তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

জাতীয় জীবনে নারীর যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার জাতিসংঘ সিডও সনদসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক নীতি ও সনদে স্বাক্ষর করেছে। এতকিছুর পরেও কেন পিছিয়ে থাকবে নারী? জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের প্রেক্ষিতে লিঙ্গ সমতার অগ্রগতি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্থায়িত্বের সমস্যাগুলো আমাদের পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ওপর গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে, তা অব্যাহত থাকবে। নারী আন্দোলনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নারী সমাজের যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হলেও লিঙ্গ সমতার বিষয়টি এখনও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র দৃশ্যমান। অথচ দেশ কিংবা সমাজের উন্নয়ন নির্ভর করে জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক অবদান ও অংশগ্রহণের ওপর।
অর্থাৎ সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছাড়া কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে সত্য; কিন্তু তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার অনেক নিচে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, নারী নির্যাতন ও বঞ্চনাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। দেশের নারী সমাজ এখনও নানা ধরনের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন-বঞ্চনার শিকার।
শিল্পক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের বঞ্চনা একটি আলোচিত বিষয়। যৌতুকপ্রথা, বাল্যবিবাহ, ধর্মীয় কুসংস্কার, পারিবারিক জীবনে পুরষতান্ত্রিক মনোভাবের আধিপত্য, প্রথা, পুরোনো ধ্যানধারণা আমলের মনোকাঠামো ইত্যাদি নারী অগ্রগতির পথে বড় বাধা। এসব অতিক্রম করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে দেশে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু আবহমানকালের প্রথাগত সামাজিক চিত্রটি একেবারে মুছে ফেলা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য এর চেয়ে বড় ইতিবাচক শর্ত আর কী হতে পারে? বাংলাদেশের সংবিধানসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় নারীর রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
নারীর প্রতি নানারকম বৈষম্য, তার অধিকারের অস্বীকৃতি কিন্তু এরকম কিছু খুব বাস্তব ও বৈষয়িক কারণেই এসেছে- যা যুগে যুগে নারী জাতিকে কঠিন অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। অনেক নারী মেধাবী এবং রীতিমতো লড়াই করেই সমাজে নিজের অবস্থান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে সমাজের সব নারীর জন্যই এমন সুযোগ কেন আসে না? এসব প্রশ্নের উত্তর সরলীকরণ কঠিন। বলা যায় সমাজে বিদ্যমান নারীর প্রতি নানা ধরনের বৈষম্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি এর পেছনে কাজ করে। নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে সমাজ, মানুষের বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি যেন অদৃশ্য এক কাচের দেয়ালকে প্রতীয়মান করে।
নারী বরাবরের মতোই থেকেছে অধিকারবঞ্চিত, ক্ষেত্রবিশেষে অধিকতর। এর কারণ হলো, আমাদের মননে যা ক্রিয়াশীল তা হলো নারীকে বাঁচিয়ে রাখা, অধিকার দেয়া নয়। এ সমাজে নারীরা শারীরিকভাবে যতটা না নির্যাতিত তার চেয়ে ঢের বেশি হয় মানসিক নির্যাতনের শিকার।
পদে পদে তাকে অপমান সইতে হয়। লজ্জার কথা হলো, এ সমাজ এখনও নারীকে মানুষ হিসেবে যে সম্মান দেয়া প্রয়োজন তা করে না বা নারীর মানবাধিকারকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয় না। তবে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের ফলে নারী উন্নয়ন আজ সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচারবিভাগ, প্রশাসন, কূটনীতি, সশস্ত্রবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শান্তিরক্ষা মিশনসহ সবক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর সম অধিকারের বিষয়টি সংবিধানে নিশ্চিত করেছেন। নারী তার মেধা ও শ্রম দিয়ে যুগে যুগে সভ্যতার সব অগ্রগতি এবং উন্নয়নে করেছে সম-অংশীদারত্ব। আর তাই সারা বিশ্বে বদলে যাচ্ছে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। এখন নারীর কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বীকৃতি। লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল।
জেন্ডার রেসপন্সিভ বাজেটের মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্য হ্রাস ও সুযোগের সমতা সৃষ্টি। জেন্ডার বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতা, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, স্বাস্থ্য ও টিকাদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। নারীর আর্থসামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন দৃশ্যমান হয়। এজন্য দরকার নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করা।
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৪ বছরের অর্জন আছে অনেক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ২০২১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী ও শিশুদের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এখন লক্ষ্য ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন ও ২০৪১ সালে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ অর্জন। গত ১৪ বছরে নারী ও শিশুর উন্নয়নে প্রণীত নীতিমালা, আইন ও বিধিমালাগুলোর জন্য সরকার গত ১৪ বছরে নারী ও শিশুর উন্নয়নে বেশকিছু আইন-নীতি ও বিধিমালা তৈরি করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১; জাতীয় শিশু নীতি ২০১১; শিশুর প্রারম্ভিক যতœ ও বিকাশের সমন্বিত নীতি ২০১৩; মনোসামাজিক কাউন্সেলিং নীতিমালা ২০১৬ (খসড়া); জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নকল্পে কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-২০১৫; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০; ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৩; বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭।
দুস্থ নারীদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তামূলক ভিজিডি কার্যক্রম। দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার (স্তন্যদানকারী মা) সহায়তা, শিক্ষিত বেকার মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থার মাধ্যমে দেশের সবকটি জেলার শিক্ষিত বেকার নারীদের কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে ‘জয়িতা’: দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বিপণন এবং বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে জয়িতার মাধ্যমে একটি নারী উদ্যোক্তা বান্ধব আলাদা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে সারা দেশব্যাপী গড়ে তোলার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা, পুলিশি ও আইনি সহায়তা, মানসিক ও সামাজিক কাউন্সেলিং, আশ্রয়সেবা এবং ডিএনএ পরীক্ষার সুবিধা ওসিসি হতে প্রদান করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার, ১০৯ নম্বরে ফোন করে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু, তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট সকলে প্রয়োজনীয় তথ্য, পরামর্শসহ দেশে বিরাজমান সেবা এবং সহায়তা সম্পর্কে জানতে পারে। কিশোর-কিশোরী ক্লাব, কর্মরত নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের আবাসনের জন্য হোস্টেল নির্মাণ, শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ প্রদান। পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য চা বাগান, সিটি কর্পোরেশনের বস্তি, কেন্দ্রীয় কারাগার, যৌনপল্লীসহ প্রান্তিক শিশুদের জন্য পুরস্কার বিতরণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।
জয় মোবাইল অ্যাপস প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড নির্যাতনের শিকার কিংবা নির্যাতনের আশংকা রয়েছে এ রকম নারী ও শিশুদের তাৎক্ষণিকভাবে সহয়তা প্রদান করার জন্য এই অ্যাপ ব্যবহার করা হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর তথ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন ফরমে বাবার পাশাপাশি মা অথবা ‘আইনগত অভিভাবকের’ও স্বীকৃতি দিয়েছে হাইকোর্ট। এর ফলে দীর্ঘ অপেক্ষার পর সমাজে নারী পেলো প্রাপ্য স্বীকৃতি৷ হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে অভিভাবকের ঘরে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবক- এই তিন বিকল্পের যেকোনো একটি উল্লেখ করেই শিক্ষার্থীরা এখন থেকে ফরম পূরণ করতে পারবে।
তবে নারী অধিকারকর্মী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিশিষ্টজনেরা মনে করেন উচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্ত নারীর অধিকার অর্জনের প্রথম ধাপ, এখনও অনেকদূর যেতে হবে৷ এখনও অভিন্ন পারিবারিক আইন, সম্পত্তির অধিকারসহ অনেকগুলো পদক্ষেপ বাকি রয়েছে, যেগুলো আদায়ের জন্য এখনও আন্দোলন করে যাচ্ছেন নারী অধিকারকর্মীরা।
লিঙ্গ বৈষম্যমূলক প্রথা দূরীকরণের ক্ষেত্রে এই রায়টি যুগান্তকারী। প্রত্যেক ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশের অধিকার এবং শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিতে এই রায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। লিঙ্গভিত্তিক সকল বৈষম্য দূরীকরণের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি পূরণে এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন নিশ্চিতকরণে আজকের এই রায়ের যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই আইন ঠিক আছে, কিন্তু বাস্তবায়নে গিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।
রাজশাহী বোর্ডের অধীন এসএসসির ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণে বাবার নাম দিতে না পারায় এক শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন হয়নি। তখন শিক্ষার্থীর অভিভাবক হিসেবে বাবা এবং মায়ের নাম লেখা বাধ্যতামূলক ছিল। বৈষম্যমূলক এই বিধান চ্যালেঞ্জ করে রিটটি করা হয়। অভিভাবক হিসেবে এখনো শিক্ষা ক্ষেত্রের প্রতিটি স্তরে বাবা এবং মায়ের নাম লিখতে হয়। রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম উল্লেখ কওে রেজিস্ট্রেশনসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে সব ফরম পূরণ করা যাবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সব শিক্ষা বোর্ডের প্রতি এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবক হিসেবে যেকোনো একটি পরিচয় উল্লেখ করে ফরম পূরণ করা যাবে।
রাষ্ট্রপক্ষ এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেনি বরং মায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে। যখন রিটটি করা হয়, তখন শিক্ষা ক্ষেত্রে অভিভাবকের ঘরে তথ্য হিসেবে বাবার নাম লেখা বাধ্যতামূলক ছিল। এরপর মায়ের নাম উল্লেখ করতে হতো। আগে শিক্ষা ফরমে শুধু পিতার নাম থাকলেও ২০০০ সালে সেখানে মায়ের নাম লেখাও বাধ্যতামূলক করে সরকার। কিন্তু হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে এখন থেকে শুধুমাত্র মায়ের পরিচয়েও যেকোনো সন্তান শিক্ষার অধিকার পাবেন।
আসলে মা হচ্ছেন একজন পূর্ণাঙ্গ নারী, যিনি গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম তথা সন্তানকে বড় করে তোলার ক্ষেত্রে জগতের সবচাইতে উপযুক্ত ব্যক্তি। আন্ডারস্ট্যান্ডিং মাদারস জেনেটিকস নামের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মায়ের সঙ্গ, ছোঁয়া, আবেগ শিশুর আইকিউ উন্নত করে। একজন শিশুর বুদ্ধিমত্তা নির্ভর করে তার মায়ের জিনের ওপর। গবেষণায় দেখা যায়, শিশুর ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট (আইকিউ) কতটা উন্নত হবে তা নির্ভর করে কন্ডিশনিং জিনের ওপর। এই জিন শিশু তার মায়ের কাছ থেকে পায়। তাই মায়ের একক অভিভাবকত্বের দাবীটিও দীর্ঘদিনের।
সুনির্দিষ্ট আইনগত কোনো বিধান না থাকা সত্তে¡ও এতকাল ধরে পিতা মাতার পরিচয় বিহীন শিশুরা শিক্ষা লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। এ যুগান্তকারী রায়ের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সকল শিশুর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন হবে। স্বাধীনতার ৫১ বছর পর আদালতের একটি রায়ের মাধ্যমে মায়েরা, বিশেষ করে একক মায়েরা (সিঙ্গেল মাদার) নিজ পরিচয়ে সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে পারবেন। এ রায় ভুক্তভোগী মায়েদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক হলো, তা শুধু তারাই অনুভব করতে পারবেন। তাদের জন্য সামাজিক এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাটা খুব কষ্টকর ছিল। এই গ্লানি ও অসম্মানের মধ্যে দিয়ে যাঁদের যেতে হয়নি, তাঁরা বুঝতেই পারবেন না এই একটুখানি পাওয়া তাদের জন্য কতটা বেশি পাওয়া।
পিতৃপরিচয়হীন সন্তান, যৌনকর্মীদের সন্তান যাদের বাবার পরিচয় নেই তারা শুধু মায়ের নাম দিয়েই ফরম পূরণ করতে পারবেন। হাইকোর্ট রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, সংবিধান সবাইকে সমান অধিকার দিয়েছে, শুধু বাবার নাম না থাকলে একজন শিশু ফরম ফিলাপ করতে পারবে না, পাসপোর্ট পাবে না এটা ঠিক না। এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে সমতার কারণে বাবা অথবা মায়ের পরিচয় থাকলেই যেকোনো ফরম পূরণ বা রেজিস্ট্রেশন পূরণ করার অধিকার পাবে।
এই রায়ের ফলে এসএসসি, এইচসি পরীক্ষার ফরম পূরণ, পাসপোর্টের ফরম পূরণে বাবা অথবা মা অথবা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম লেখা যাবে। এই রায়ের ফলে বাবা-মায়ের উভয়ের নাম লেখার বাধ্যবাধকতা থাকলো না। শুধু মায়ের নাম লিখেও ফরম পূরণ করা যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সামনে ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন ও ২০৪১ সালে একটি উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, তাতে সকলকে কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক মুক্তির পাশাপাশি আমরা নারীমুক্তি; সর্বোপরি মানবমুক্তির লড়াইয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার সফলভাবে বাস্তবায়নের পর আমরা এখন নতুন কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। সেটি হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি এই চারটি মূল ভিত্তির ওপর গড়ে উঠবে ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ। এ দেশের সকল মানুষ তার জন্য এখন পুরোপুরি তৈরি৷
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক