একটি আদর্শ নতুন প্রজন্ম চাই


হীরেন পণ্ডিত
আজকাল নিজেদের প্রাপ্তির জন্য আমরা সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে কাজ করছি। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আছি। দেশ আর সমাজকে নিয়ে কী ভাবছি আমরা? আর কত সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় প্রয়োজন ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য? আর কতদিন অপেক্ষার প্রয়োজন হবে নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য? এই প্রশ্ন কার কাছে রাখা যায়? সমাজের কাছে? রাষ্ট্রের কাছে? সরকারের কাছে? সবাই তো নিজেকে নিয়েই শুধু ব্যস্ত রয়েছে, শুধু ভাবছি নিজেকে নিয়ে।
সরকার ব্যস্ত আছে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা নিয়ে দেশের উত্তরোত্তর কল্যাণের জন্য; আর বিরোধী দলগুলো ব্যস্ত রয়েছে তাদের ভাষায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য। তবে আমরা যারা সাধারণ জনগণ আছি, তাদের কী হবে? আমাদের নিয়ে কেউ কি ব্যস্ত আছেন অথবা ভাবছেন, কিংবা ভাবার সময় কি আছে তাদের? এটা কিন্তু মোটেই দৃশ্যমান নয়। আমরা কেমন জানি একটা বেড়াজালের মধ্যেই আছি। জাতি হিসেবে কি আমরা খুব একটা এগোতে পারছি? খুব একটা এগোচ্ছি বলে মনে হয় না।
কিছু ভালো অর্জন আমাদের আছে! সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায় কাদা ছোড়াছুড়িতে। তা ছাড়া সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় তো রয়েছেই। এ নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আমাদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের অর্জনকে ধরে রাখতে পারছি না।
প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন ও জাতীয় দৈনিকে নানারকম ভয়াবহ নেতিবাচক খবর দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন ও আঘাতের খবরের প্রাধান্যে এ মাধ্যমগুলো ভরা থাকে। অপরাধগুলো একটি শহরে কিংবা বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। দেশের প্রায় সব শহরে, বন্দরে, গ্রামেগঞ্জে, অভিজাত এলাকা কিংবা প্রত্যন্ত জনপদে এসব ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধীদের মধ্যে কুখ্যাত সন্ত্রাসী বা মাস্তান যেমন রয়েছে; তেমনি সাধারণ জীবনযাপনকারী পরিবারের সদস্যও রয়েছে।
বিশেষ করে, পারিবারিক পর্যায়ে যে নৃশংস ও অবিশ্বাস্য ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে; তাতে মনে হচ্ছে, অপরাধীরা আসলে মানসিক রোগী। মনোরোগে আক্রান্ত লোক ছাড়া এ ধরনের নৃশংস অপরাধ কেউ করতে পারে না। নৃশংস অপরাধকে এখনো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। সভা-সেমিনার, ওয়ার্কশপ কিংবা গোলটেবিল আলোচনায় সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, মনোচিকিৎসক ও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি বড় একটা দেখা যাচ্ছে না।
আমরা প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে এসব অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকি। সময় এসেছে, এখন আমাদের সমস্যার আরও গভীরে যেতে হবে। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি তার মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেখতে হবে, আমাদের দেহ-মনে এমন মারাত্মক কোনো জীবাণু বা রাসায়নিক দ্রব্য অবস্থান নিয়েছে কিনা, যা আমাদের দলে দলে মানসিক রোগী করে তুলছে। সুস্থ ব্যক্তিরা যাতে এ রোগে আক্রান্ত না হয়; সে জন্য আগেভাগে ব্যবস্থা নিতে হবে। কখনো ব্যক্তিপর্যায়ে, কখনো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।

আমাদের মেধা ও মননের সার্বক্ষণিক চর্চা অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতার পথ ছেড়ে কষ্টকর বিকল্প পথ ধরতে কার মন চায়? তাই প্রকৃত মেধাবীর সংখ্যা আমাদের সমাজে ক্রমেই কমে আসছে। সামাজিক অবক্ষয়ের পাল্লা ভারী হচ্ছে ধীরে ধীরে।
নানা কারণে আমাদের সমাজে মেধাবী কম না হলেও আদর্শনিষ্ঠ এবং সৎ ও নীতিপরায়ণ মেধাবী প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। কমে যাচ্ছে ব্যতিক্রমী ধারার জনস্বার্থবাদী চিন্তাবাদীদের সংখ্যা। স্বভাবতই হ্রাস পাচ্ছে বা শক্তিহীন হচ্ছে অনুরূপ গুণের বৈশিষ্ট্যযুক্ত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান; যেগুলো জনস্বার্থবান্ধব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো সাংস্কৃতিক শূন্যতার অন্যতম কারণ। আর এ অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণের পথ দেখাতে পারে প্রকৃত সংস্কৃতিচর্চা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়কে দূর করে জাতিকে নতুন যুগের পথ দেখাতে পারে।
এই যে আমাদের নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম আছে, আমরা কি তাদের কথা ভাবি? যারা ভবিষ্যতের হাল ধরবে; তাদের সেভাবেই তৈরি করতে হবে আমাদের। প্রতিটি বাবা-মা কি তাদের সন্তানের খোঁজখবর রাখেন? সন্তানকে কীভাবে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে কী ভাবেন? সন্তানের বাবা-মা ব্যস্ত রয়েছেন জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য। দিনরাত পরিশ্রম করে আনা অর্থ কোনো কাজে লাগছে কিনা সে বিষয়ে কারও চিন্তা করার সময় নেই।
সন্তান কী শিখছে, কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে; সে খেয়াল রাখার মতো অবস্থায় আমরা নেই। কিন্তু কেন? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! কেন এমন হলো তা নিয়ে সরকার ও নাগরিক সমাজকে ভাবতে হবে। সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এগুলো থেকে বের হয়ে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই নতুন প্রজন্মকে আদর্শবাদী করে তুলতে হবে।
একসময় ছিল মানি ইজ লস্ট, নাথিং ইজ লস্ট, হেলথ ইজ লস্ট, সামথিং ইজ লস্ট, হোয়েন ক্যারেক্টার ইজ লস্ট এভরিথিং ইজ লস্ট। কিন্তু এটার একটু পরিবর্তন হয়েছে এভাবে—ক্যারেক্টার ইজ লস্ট নাথিং ইজ লস্ট, হেলথ ইজ লস্ট সামথিং ইজ লস্ট, হোয়েন মানি ইজ লস্ট এভরিথিং ইজ লস্ট। এখন টাকাই সব।
টাকার জন্য সবকিছুই করা সম্ভব। আমরা শুধু টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছি। টাকার জন্য মানসম্মান, আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি! অন্যদিকে সমাজ বিনির্মাণে, রাষ্ট্রের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে আমাদের যে কিছু দায়িত্ব রয়েছে সেগুলো আমরা সঠিকভাবে পালন করছি কিনা, কিংবা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি কিনা, সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
নিজের কাছে যদি নৈতিকতা না থাকে তাহলে জাতি বা দেশ তার কাছ থেকে কী আশা করতে পারে? আমি আমার পবিত্র নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে দিই, তাহলে তো আর কিছু বলার থাকবে না। আমরা আমাদের ‘বাংলাদেশকে ভালোবাসি’ এ স্লোগানে আমাদের সবাইকে এক কাতারে এসে দাঁড়াতে হবে। এ জন্য নাগরিক সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ, আগে জাতি হিসেবে আমাদের সব সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় দূর করা উচিত।
নৈতিক অবক্ষয়ের দিক থেকে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। চলুন, আমরা ঘুরে দাঁড়াই। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নিই। একটি নতুন আদর্শ প্রজন্ম গড়ে তুলে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক আমাদের সবার লক্ষ্য।

(ইনসার্ট : আমাদের মেধা ও মননের সার্বক্ষণিক চর্চা অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতার পথ ছেড়ে কষ্টকর বিকল্প পথ ধরতে কার মন চায়? তাই প্রকৃত মেধাবীর সংখ্যা আমাদের সমাজে ক্রমেই কমে আসছে। সামাজিক অবক্ষয়ের পাল্লা ভারী হচ্ছে ধীরে ধীরে

লেখক : প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *