হীরেন পণ্ডিত: অফিসের কাজে দিনাজপুর প্রথম যাওয়া হয় ১৯৯৪ সালের মাঝামাঝি মূল কাজ ছিলো বিরল উপজেলায়, পরের বার যাওয়া হয় ১৯৯৮ সালে শেষ দিকে কিন্তু দু’বার গিয়েছি যখনই যাই সময়টা হয়ে যায় দুপুরের দিকে যখন মন্দির বন্ধ থাকে দেবতাকে দুপুরের প্রসাদ দেয়ার পর কয়েক ঘন্টার সময়ের জন্য মন্দির বন্ধ থাকে। আসলে প্রতিমা দর্শন করতে হলে ১২ টার আগে বা বিকেল ৪ টার পর গেলেই ভালো। আমার যাওয়া হয় ঠিক সে সময় যখন মন্দির বন্ধ থাকে।
দু’বারে প্রতিমা দর্শন করা হয়ে উঠেনি, নিজেকেই দোষারোপ করি সময়মত শিডিউল বের করতে না পারার জন্য। অফিসের গাড়ি দীর্ঘক্ষণ আটকিয়ে রাখার উপায় নেই অন্য সহকর্মীদের নিয়ে ফিরতে হবে ঢাকায়। দু’বার শুধু মন্দিরের বাইরের টেরাকোটা দেখেই ফিরে আসতে হলো। এরপর কি করা যায় ভাবছি পরিবার থেকে প্রস্তাব আসলো ছেলেমেয়ের পরীক্ষা শেষ হবার পর একবার কান্তজী দেখার পরিককল্পনা করলে কেমন হয়, উত্তম প্রস্তাব। কোনো বিলম্ব না করেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো। সবাই যাব কান্তজী দেখার জন্য সেই সাথে রামসাগর দীঘী। সেটা নিয়ে আরেকদিন হাজির হবো আপনাদের সামনে। বাসে প্রায় ১২ ঘন্টা লেগে যায়, রাতে গিয়ে পৌঁছি।
হোটেলে খেয়ে এক এনজিওতে থাকার ব্যবস্থা হলো। কিন্তু এবার আর কোনো ভুল নয় একদম ঘুম থেকে উঠেই রওয়ানা দিলাম ৮ টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ঘন কুয়াশার মধ্যে। মন্দিরের সব কিছু আশে পাশের শীতের সময় থাকার সরিষা ফুলের ক্ষেতে সরিষা ফুল সংগ্রহ, ছবি তুলে বাড়তি আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছে তাই বা কম কিসে। দোকান থেকে খাবার এনে গেস্ট হাউজে খাওয়া একটা পিকনিক, পিকনিক ভাব। সব খাবারই সুস্বাদু। হাঙ্গার ইজ দ্য বেস্ট সস একটা কথা তো আছেই। পরিবারের সদস্যরা আনন্দেই কাটলো যে কয়েকদিন ছিলাম দিনাজপুর। তবে আসার দিন অনেক কম সময়ে সকালে রওয়ানা দিয়ে ৫টার মধ্যেই ঢাকায় পৌঁছি।
দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির বা কান্তজী মন্দির বা কান্তনগর মন্দির বাংলাদেশের দিনাজপুরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরটি সনাতন ধর্মের কান্ত বা কৃষ্ণের মন্দির হিসেবে পরিচিত যা লৌকিক রাধা-কৃষ্ণের ধর্মীয় প্রথা হিসেবে বাংলায় প্রচলিত। ধারণা করা হয়, মহারাজা সুমিত হর কান্ত এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে এই মন্দির ধ্বংস হওয়ার আগে রাবণেষু, জন হেনরি এর ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে তোলা ছবিতে মন্দিরের নয়টি রত্ন বর্তমান।
দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে, দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরবর্তী গ্রাম কান্তনগরে অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দির। কান্তনগর মন্দির, দিনাজপুর, বাংলাদেশ, ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ছবিতে নয়টি রত্নের সাতটি দৃশ্যমান রয়েছে, একটি ভূমিকম্পে বিখ্যাত এই নবরত্ন মন্দিরের রত্নসমূহ বিলীন হয়ে যায়।
মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পরে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিলো ৭০ ফুট। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি ভূমিকম্পের কবলে পড়লে এর চূড়াগুলো ভেঙ্গে যায়। মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করলেও মন্দিরের চূড়াগুলো আর সংস্কার করা হয়নি।
মন্দিরের বাইরের দেয়াল জুড়ে পোড়ামাটির ফলকে লেখা রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫,০০০-এর মতো টেরাকোটা টালি রয়েছে। উপরের দিকে তিন ধাপে উঠে গেছে মন্দিরটি। মন্দিরের চারদিকের সবগুলো খিলান দিয়েই ভেতরের দেবমূর্তি দেখা যায়। মন্দির প্রাঙ্গণ আয়তকার হলেও, পাথরের ভিত্তির উপরে দাঁড়ানো ৫০ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে। দু’টো ইটের স্তম্ভ দিয়ে খিলানগুলো আলাদা করা হয়েছে, স্তম্ভ দু’টো খুবই সুন্দর এবং সমৃদ্ধ অলংকরণযুক্ত। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র ৩টি করে।
পঞ্চাশ ফুট বর্গাকৃতির ত্রিতলা বিশিষ্ট ইটের তৈরি এ মন্দিরটি একটি উচু মঞ্চের উপর নির্মিত। যদিও শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিল এক সময় ৭০ ফুট। এটি নবরত্ন মন্দির নামেও পরিচিত, কারণ তিনতলাবিশিষ্ট এই মন্দিরের নয়টি চূড়া বা রত্ন ছিল, তাই এ নাম। মন্দিরের নিচতলার ছাদ ও দ্বিতলের ছাদের চারকোনে চারটি করে আটটি অলংকৃত চুড়া বা রত্ন এবং ত্রিতলের ছাদের মধ্যস্থলে আছে বৃহদাকারের কেন্দ্রীয় চূড়ার ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরের গায়ে অপরূপ টেরাকোটার কাজের জন্য কান্তজীর মন্দির বিখ্যাত।
ভারতের তামিলনাড়ু– মাদুরাই মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দির প্রায় অনেকটাই এ রকম তবে মীনাক্ষী মন্দিরের উচ্চতা অনেক বেশি আর কান্তজী মন্দির টেরাকোটার হলেও মীনাক্ষী মন্দিরের কারুকাজগুলোর রং করা হয়েছে। তাছাড়া মীনাক্ষী আকারে বেশ বড় এবং মন্দিরের চূড়া অনেক লম্বা।
পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫ হাজারের মতো টেরাকোটা টালি রয়েছে যা আপনি মন্দিরের দেয়াল গায়ে টেরাকোটা দেখে বিস্মিত হয়ে যাবেন। ভাল করে দেখলে আবিষ্কার করবেন এই টেরাকোটাগুলোর একটা সঙ্গে অন্যটার কোনো মিল নেই। একেকটা টেরাকোটার চিত্রগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছে একেকটা গল্প। এসব পোড়ামাটির ফলকে মধ্যযুগের শেষদিকে বাংলার সামাজিক জীবনের নানা কাহিনী, রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণের কাহিনীর অংশ বর্ণনা করা হয়েছে।
আপনি যদি মন্দিরের টেরাকোটাগুলো দেখে বুঝতে না পারেন তাহলেও কোন সমস্যা নেই এইখানে যে পূজারী থাকেন তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা আপনাকে ছবি ধরে ধরে ব্যাখা করে বুঝিয়ে দিবে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এ চারটি শাস্ত্রীয় যুগের পৌরাণিক কাহিনীগুলো মন্দিরের চার দেয়ালে চিত্রায়িত। চিত্রকাহিনী সংবলিত টেরাকোটায় আচ্ছাদিত মন্দিরটি দেখলে মনে হবে এ যেন চার খণ্ডে শিল্পখচিত এক পৌরাণিক মহাকাব্যের দৃশ্যমান উপস্থাপনা। কান্তজীর মন্দিরের টেরাকোটা আপনাকে কখনো নিয়ে যাবে মধ্যযুগীয় বাংলায়, আবার কখনো উপস্থাপন করবে পৌরাণিক কাহিনী। একটা স্থাপত্য আপনার ভেতরে কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে তা কান্তজীর মন্দিরে না গেলে আপনি ধারণা করতে পারবেন না। প্রতিবছর নভেম্বর মাসে কান্তজী মন্দির প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় রাশ পূর্ণিমা মেলার। মাসব্যাপী এই মেলায় ভিড় জমান অসংখ্য দর্শনার্থী আর পুণ্যার্থী।
স্থাপত্য রীতি, গঠনবিন্যাস, শিল্পচাতুর্য মন্দিরটির সামগ্রিক দৃশ্যকে এতই মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছে যে এর চেয়ে সুন্দর, নয়নাভিরাম মন্দির বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। কান্তজীউ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
ঢাকা থেকে বাস এবং ট্রেনে দিনাজপুর যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সাধারণত ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে দিনাজপুরগামী বাসগুলো ছেড়ে যায়। বাস সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে নাবিল পরিবহন, এস আর ট্রাভেলস, এস এ পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, কেয়া পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন ইত্যাদি। নন-এসি এবং এসি বাস ভাড়া মানভেদে ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা এর মধ্যে। এছাড়া রাজধানীর উত্তরা থেকে বেশকিছু বাস দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ঢাকার কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দও রেলওয়ে স্টেশন থেকে আন্তঃনগর একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। শ্রেণীভেদে এইসব ট্রেনের টিকেটের মূল্য ৭০০ টাকা থেকে ২,০০০ টাকার মধ্যে। ঢাকা-সৈয়দপুর আকাশ পথেও যাবার সুযোগ রয়েছে। সৈয়দপুর থেকে মাইক্রোবাসে করেও যাওয়া অভ্যন্তরীণ সকল ফ্লাইটগুলোই ঢাকা-সৈয়দপুর রুটে চলাচল করে। এতে আসা যাওয়াতে একটু বেশি খরচ পড়তে পারে। দিনাজপুর থেকে অটোরিক্সা বা সিএনজি ভাড়া করে সহজেই কান্তজীর মন্দির দেখতে যেতে পারবেন। দিনাজপুর শহরে ভাল মানের হোটেলে থাকতে চাইলে পর্যটন মোটেলে এ ছাড়াও আরো কিছু হোটেল আছে থাকতে পারবেন।