নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে হবে


হীরেন পণ্ডিত
প্রতিটি দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে একজন বড় মাপের নেতা থাকেন। আমেরিকার ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন, রাশিয়ার ছিলেন লেনিন, চীনের ছিলেন মাও জেদং, ভারতের ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, ভিয়েতনামের হো চি মিন এবং বাংলাদেশের ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতা বা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বা স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা হিসেবে তাঁরা নিজ নিজ দেশে মর্যাদার আসনে চিরকাল অধিষ্ঠিত আছেন।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের গৌরবজনক ঘটনা বা অধ্যায় হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ৩০ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত, লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে একাত্তরের ৯ মাস যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেই বিজয় ছিনিয়ে আনা হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর। বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছেন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ-ল ঘটনা এবং যত দিন বাঙালি জাতি থাকবে, তত দিন এই মুক্তিযুদ্ধই থাকবে শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধ্যায় হিসেবে, অবিস্মরণীয় এক গৌরবগাথা হিসেবে। কারণ বাঙালি জাতি দীর্ঘকাল কোনো না কোনো শাসক দ্বারা শোষিত হয়েছে, অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। কখনো মোগল-পাঠান, কখনো ব্রিটিশ, কখনো পাকিস্তানিদের দ্বারা জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে। বাঙালির ইতিহাস মানেই শোষণ আর অধিকার থেকে বঞ্চনার ইতিহাস। বাঙালির ইতিহাস মানে না পাওয়া আর বেদনার ইতিহাস। আজকের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে উপস্থাপন করা, তুলে ধরা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লিখিত বই, মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত বিভিন্ন ছবি, নাটক এগুলো আরো বেশি করে প্রচার করা দরকার। আজকের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা দরকার যে মুক্তির জন্য বাঙালি জাতিকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা যে জীবনকে তুচ্ছ করে, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেশমাতা ও মাতৃভূমিকে মুক্ত করে, স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন, তা নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি জাতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ফলে তারা শ্রমজীবী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকসহ এ দেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করেছিল। বাঙালি জাতি কিভাবে তাদের পরাজিত করেছিল, তার যথাযথ ইতিহাস নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব ও কর্তব্য সবারই। কিন্তু আমরা সেটি কতটুকু করছি, সেই প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ হলো বাঙালি জাতির শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো আমাদের বাঙালি জাতির আজন্মলালিত স্বপ্ন, একটি জাতির চেতনার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন দোলা দিয়েছে আমাদের মনে, আমাদের স্বপ্নকে অনুপ্রাণিত করেছে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। সহায়তা করেছে স্বপ্ন বাস্তবায়নে এবং এই স্বপ্নকে বেগবান করেছে এবং এক নতুন আশা ত্বরান্বিত করেছে। যে চেতনা বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করেছিল একটি গণতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়। এই চেতনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মের চেতনাকে আরো শাণিত করতে হবে।

যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, কিন্তু শুনেছে গল্পের আকারে তাদের পরিবারের কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির কাছে, শিক্ষকের কাছে, কোনো নেতার কাছে, কোনো মুক্তিযোদ্ধার কাছে বা বইতে পড়েছে। সেই শোনা বা পড়া কতটুকু সঠিক বা তার বিস্তৃতি কতটুকু, তা আমরা জানি না।

একটি উদ্যোগ নিতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য আমরা কতটুকু সফল? আমরা লক্ষ করি, যে সময় যে সরকার আসে সে সময় সে সরকার তাদের মতো ইতিহাস পরিবর্তন করে প্রচার করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সঠিক ইতিহাস সঠিকভাবে সবাইকে জানাতে হবে। ইতিহাস তো ইতিহাসই! এর কি ইচ্ছামতো পরিবর্তন করার সুযোগ আছে? এই পরিবর্তন তো একটি জাতির জন্য সুখের বিষয় নয়। ইতিহাস বিকৃতি জাতিকে ধ্বংস আর বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। এই ইতিহাস বিকৃতির প্রবণতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত!

নাট্যকারদের উচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক লেখা, কথাসাহিত্যিকদের উচিত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প, উপন্যাস লেখা, কবিদের উচিত দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা নিয়ে কবিতা লেখা, গবেষকদের উচিত গবেষণা করে মুক্তিযুদ্ধের নতুন দিক উন্মোচিত করা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে সে বিষয়টি নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা। প্রকাশকদের উচিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রচুর বই প্রকাশ করা। যুগ যুগ ধরে সেসব বই পড়ে তরুণরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে এবং দেশকে ভালোবাসতে শিখবে। চলচ্চিত্রকারদের উচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসনির্ভর ছবি নির্মাণ করা, যা নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। চলচ্চিত্র এমন একটি মাধ্যম যা খুব দ্রুত তরুণ প্রজন্মসহ সবার কাছে বার্তা পৌঁছাতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসই হবে নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস, এই চেতনাকে শাণিত করতে আমাদের এখনই কাজ শুরু করা উচিত। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত একটি তরুণ প্রজন্ম গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে একটি গতিশীল জাতি গঠিত হবে। নতুন প্রজন্ম হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি আধুনিক প্রজন্ম, যারা বাস্তবায়ন করবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। এ যে আমাদের আজন্ম লালিত স্বপ্ন।

লেখক : প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *