হীরেন পণ্ডিত
প্রকাশ: বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৩:৪১ এএম | অনলাইন সংস্করণ Count : 54
একুশে ফেব্রুয়ারি এ দেশের মানুষকে আত্মত্যাগের চেতনা শিখিয়েছে, বাঙালিকে করেছে মহান। জাতি হিসেবে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শের সঙ্গে মিলিত অসাম্প্রদায়িক চেতনা গ্রহণ করেছি। মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে এসেছে স্বাধীনতার চেতনা। প্রকৃতপক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে জাতীয় ভাষা করার বড় ষড়যন্ত্র চলছে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিস প্রতিবাদ করে এবং বাংলা ও উর্দু উভয়কেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। আমরা মিটিং করে প্রতিবাদ শুরু করি। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যৌথভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে এবং ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষার দাবি’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।’
৭১ বছর আগে ১৯৫২ সালের এই মাসে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় গণ-আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল সব বাঙালি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার সাহসী ছেলেরা রাজপথে নেমে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে, শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা করার জন্য মাটির অনেক সাহসী সন্তান প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে
মাতৃভাষা বলার অধিকার, মাতৃভাষার মর্যাদা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে রয়েছে এর গৌরবময় অধ্যায়।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে অনেক ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু বাঙালির বীরত্ব এই বিরল আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তার ভাষাকে সম্মানজনক স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে, ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ^জুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাঙালির সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে তার অস্তিত্বের সংগ্রাম শুরু হয়। বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছে, এটা তাদের কাছে কম কৃতিত্ব নয়। সেই একটি ভাষায় তারা সকাল, সন্ধ্যা এবং রাতে সাবলীলভাবে কথা বলে এবং স্বপ্ন দেখে। বাংলাদেশে লোকসংখ্যা আজ প্রায় ১৭ কোটি।
১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি, যৌথ উদ্যোগে ‘অল-ইউনিয়ন সেন্ট্রাল স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্রাগল কাউন্সিল’ গঠিত হয়। সব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দল এবং কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে গঠিত সংগ্রাম পরিষদ একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দেয়। অন্যদিকে তৎকালীন নুরুল আমিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর অন্যায় ও অগণতান্ত্রিকভাবে গুলি চালায়, ফলে রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিউর রহমান শহিদ হন। অহিউল্লাহ নামে একজন, যিনি ঢাকার নবাবপুর রোডে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতারাতি প্রথম শহিদ মিনার নির্মিত হয় এবং উদ্বোধন করেন শহিদ শফিউরের বাবা। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালে, পাকিস্তানের গণপরিষদ বাংলাকে একটি জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৫৬ সালে, সাংবিধানিকভাবে বাংলাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়, যা বাঙালি জাতির গৌরবের ইতিহাসে অন্যতম অর্জন। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদরা উপলব্ধি করেন যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানত পাঞ্জাবি শাসক শ্রেণি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার আড়ালে ইসলামের নামে বৈষম্য ও শোষণ চাপানোর পরিকল্পনা করেছে। এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উর্দুভাষী পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও চাকরি থেকে বঞ্চিত করার এবং পূর্ব পাকিস্তানের উনয়নকে ব্যাহত করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। উল্লেখ্য, সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ শতাংশ মানুষ পাঞ্জাবি বলতেন, যেখানে উর্দু ছিল মাত্র ৪ শতাংশের ভাষা।
ভাষা আন্দোলনে উদ্ভূত চেতনাই আমাদের স্বাধীনতার বোধ নিয়ে আসে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এটিকে অপমান করতে থাকলে তা আরও তীব্র হয়। আমাদের অনন্য ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। এটি অনিবার্যভাবে আমাদের স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশে আমরা প্রত্যাশিত সবকিছু পেয়ে গেছি, এটা বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে শুরুতেই শিক্ষার কথা উল্লেখ করতে হবে। আমরা শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, এমনকি বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়াতে পেরেছি; প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিও কম নয়। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা কতটা নিশ্চিত হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার বিভিন্ন ধারা আমাদের নতুন প্রজন্মকে একই পায়ে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। ধনী পরিবারের সন্তানরা যেমন ভিন্ন ধরনের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যায়, তা আবার বৈষম্যের কারণ। আমরা মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করব বা সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করব এই ছিল আমাদের অঙ্গীকার। তা সম্পন্ন করার জন্য যে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন তা আমরা কতটুকু নিতে পেরেছি? উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বাংলা মানসম্পন্ন বই লেখা এমনকি অনুবাদেও কতটা অগ্রগতি হয়েছে? ভাষা আন্দোলনের অমর স্মারক মাসে বইমেলার আয়োজন করছে বাংলা একাডেমি।
ভাষা আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট এ দেশে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। পাকিস্তান আমলে আমর
সাংস্কৃতিক বিভাজন প্রত্যাখ্যান করেছি এবং গণতান্ত্রিক চেতনাকে লালন করে এগিয়েছি, যা এড়ানো উচিত নয়। বিভক্তি নয়, ঐক্যের পথে এগিয়ে যেতে হবে। প্রগতিশীলতার চর্চা করতে হবে। পরিবর্তিত বৈশি^ক পরিস্থিতিতে, প্রতিটি দেশে এই পশ্চাৎপদ উপাদানগুলোর মধ্যে আলাদাভাবে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। এই স্রোতে এগিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বাঙালির প্রশ্নে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সুবিধাবাদ ও আপস বরদাশত করা যায় না।
ভাষা আন্দোলন ও চেতনার মাস ফেব্রুয়ারি আমাদের আত্মদর্শনের সুযোগ এনে দেয়। আমরা এত বড় অর্জনের উচ্ছ্বসিত আলোচনায় আবদ্ধ না হই, যেগুলো এখনও অর্জিত হয়নি বা অবমূল্যায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।