হীরেন পণ্ডিত
বাংলা বর্ণের সংখ্যাধিক্যতাকে বাংলা সফটওয়্যারের মূল অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। অথচ চীনা, জাপানি প্রভৃতি ভাষার সহস্রাধিক বর্ণ অতি সহজে ২৬টি ইংরেজি মূল বর্ণ ব্যবহারের জ্ঞান দিয়ে টাইপ করার ব্যবস্থা সেসব দেশ করে নিয়েছে।
সম্ভাবনাময় ডিজিটাল বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রান্তিক পর্যায়ে মোবাইল, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপে ইন্টারনেট সংযোগের ফলে এ গতি আরও বেশি বেড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রচার ও প্রসারের ফলে গত এক দশকে বাংলাদেশ আমূল বদলে গেছে। তবে বাংলাদেশে প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবহার শুরু হয়েছে আরও পাঁচ-ছয় দশক আগে। আধুনিক কম্পিউটারের বিকাশ শুরু হয় ষাট দশকের প্রথম ভাগ থেকে। বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার স্থাপিত হয় ১৯৬৪ সালে পরমাণু শক্তিকেন্দ্র ঢাকায়।
বাংলাদেশে দ্বিতীয় কম্পিউটারটি স্থাপিত হয় ১৯৬৫ সালে আদমজী জুট মিলে। কম্পিউটারটি ছিল আইবিএম ১৪০০ সিরিজের। এরপর ষাটের দশকের শেষদিকে ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড (বর্তমানে জনতা ব্যাংক) স্থাপন করে আইবিএম ১৯০১ কম্পিউটার। স্বাধীনতার আগে ১৯৬৯ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোতে স্থাপিত হয়। ১৯৭৮-৭৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম কম্পিউটার স্থাপন করে।
১৯৮৫-৮৬ সালে অ্যাপল কম্পিউটার বাংলাদেশে আসে। ১৯৮৭ সালের ১৬ মে সেই কম্পিউটার দিয়ে আনন্দপত্র নামের একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৮৭ সালে এবং এ সাফল্যের কৃতিত্ব মাইনুল ইসলাম নামক একজন প্রকৌশলীর। তিনি নিজের উদ্ভাবিত বাংলা ফন্ট ‘মাইনুলিপি’ ব্যবহার করে অ্যাপল-ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে বাংলা লেখার ব্যবস্থা করেন। এ ক্ষেত্রে বাংলার জন্য আলাদা কোনো কিবোর্ড ব্যবহার না করে ইংরেজি কিবোর্ড দিয়েই কাজ চালানো হয়েছিল।
ইংরেজি ও বাংলার আলাদা ধরনের বর্ণক্রম এবং বাংলার যুক্তাক্ষরজনিত সমস্যা সমাধান করা হয়েছিল ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের চারস্তর কিবোর্ড ব্যবহারের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে। পরপরই ‘শহীদলিপি’ ও ‘জব্বারলিপি’ নামে আরও দুটো বাংলা ফন্ট উদ্ভাবিত হয় এবং একই পদ্ধতিতে ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে ব্যবহার করা হয়।
পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে আনন্দ কম্পিউটার্সের উদ্যোগে তৈরি হয় অ্যাপল-ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে ব্যবহার উপযোগী প্রথম ইন্টারফেস ‘বিজয়’। বিজয় ইন্টারফেসটি ছিল ম্যাকিনটোশ-ভিত্তিক এবং অ্যাপল-ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের মূল্য অত্যধিক হওয়ায় এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল সীমিত, মূলত প্রকাশনার কাজেই তা ব্যবহৃত হতো।
১৯৮৫ সালে আমেরিকাতে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ম্যাকিনটোশের জন্যে একটি বাংলা ফন্ট তৈরি করেন। তিনি ইংরেজি বর্ণমালার অনুকরণে বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের যেগুলো যুক্তাক্ষর তৈরি করে সেগুলোর একটি স্বাভাবিক মাপের আকৃতির পাশাপাশি একটি ছোট মাপের আকৃতি নির্মাণ করেন যুক্তাক্ষরের একটি অংশ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে।
বাংলা সফটওয়্যারের অভাবনীয় সংখ্যাধিক্যতা থেকে দু’টি বিষয় পরিষ্কার: কম্পিউটারে বাংলা লেখা সহজ নয় এবং অনেক নির্মাতাই চেষ্টা করেছেন এই মাধ্যমে বাংলা লেখার কাজটিকে সহজ করতে। কিন্তু বলা যেতে পারে কেউই এতে পুরো সফল হননি। এ যাবৎ প্রকাশিত বাংলা সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করার প্রধান সমস্যা হলো সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে সাজানো একটি নতুন কিবোর্ড লেআউট অনুশীলন করে মুখস্থ করা।
শুধু পেশাজীবী ছাড়া আর কেউ ইংরেজি কিবোর্ডের পাশাপাশি বাংলার জন্যে আর একটি কিবোর্ড মুখস্থ করবেন না এটাই স্বাভাবিক। তাই দুই ডজনাধিক বাংলা সফটওয়্যার বাজারে থাকলেও বাংলাদেশি কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের শতকরা পাঁচ জনেরও কম কম্পিউটারে বাংলা লিখতে পারেন। কিবোর্ড ব্যবহার করে বাংলা লেখা রপ্ত করা অত্যন্ত কঠিন।
বাংলা বর্ণের সংখ্যাধিক্যতাকে বাংলা সফটওয়্যারের মূল অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। অথচ চীনা, জাপানি প্রভৃতি ভাষার সহস্রাধিক বর্ণ অতি সহজে ২৬টি ইংরেজি মূল বর্ণ ব্যবহারের জ্ঞান দিয়ে টাইপ করার ব্যবস্থা সেসব দেশ করে নিয়েছে।
বাংলাদেশে কম্পিউটার ব্যবহারের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত একটির পর একটি বাংলা সফটওয়্যার প্রকাশিত হয়েছে। এর কোনোটিই ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টি লাভ করতে সক্ষম না হলেও বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বাধিক ব্যবহৃত বাংলা সফটওয়্যারের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিজয়। পেশাদার বাংলা সফটওয়্যার ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই বিজয় ব্যবহারকারী। পরে সম্ভবত মুনীর অপটিমা টাইপ রাইটারের অনুকরণে তৈরি মুনীর কিবোর্ডের স্থান যা বেশ কয়েকটি প্যাকেজের সঙ্গে বাজারজাত করা হয়েছে।
কম্পিউটারে বাংলা হরফ ব্যবহারের জটিলতার চূড়ান্ত সমাধান পদে পদে আটকে থাকছে। অ্যাস কি-ভিত্তিক পুরোনো ফন্টে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট প্রভৃতি ওয়েব ক্ষেত্রে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা যেত না। ফন্টের সর্বজনীন কারিগরি ব্যবস্থা ‘ইউনিকোড’ আসার পর এ জটিলতা দূর হয়েছিল। তাতে সে সংকট দূর হলেও ইউনিকোডের ফন্ট বিন্যাসে বাংলা নিয়ে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়। ইউনিকোডে বাংলা ভাষার সাংকেতিক ব্যবস্থা রয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে। ইন্টারনেটে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে বলে ভাষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সর্বশেষ হালনাগাদ ইউনিকোডে আরও কিছু অব্যবস্থা বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত যতিচিহ্ন দাঁড়ির বদলে এসেছে দেবনাগরী বর্ণমালার মোটা ও দীর্ঘ দাঁড়ি। এতে বাংলা ভাষার দ্বৈত দাঁড়ি রাখা হয়নি।
বাংলাদেশি টাকার চিহ্নকে অভিহিত করা হয়েছে রুপি হিসেবে। ভাষাবিজ্ঞানী ও ভাষা প্রযুক্তিবিদেরা বলছেন, ইউনিকোডে বাংলা ভাষার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইউনিকোডের বাংলার নিজস্ব ভাষারীতি অনুসারেই হওয়া উচিত।
ইউনিকোডের বাংলা ছকে সরাসরি এই অক্ষরগুলো না থাকায় বাংলায় ওয়েব ঠিকানা লিখতে সমস্যা হয়। আমরা যেভাবে লিখি, সেভাবেই পুরো অক্ষর তৈরি হতে হবে। ইউনিকোডের শুরু ১৯৮৭ সালে অ্যাপল কম্পিউটারের উদ্যোগে। পরে মাইক্রোসফটসহ বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এ উদ্যোগে যুক্ত হয়ে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম গঠন করে। অ্যাপলের পরিবেশক হিসেবে ১৯৮৮ সালে থাইল্যান্ডে অ্যাপলের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এর সদস্য ছিল না। ফলে ইউনিকোডে বাংলা ভাষার ছক কেমন হবে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে বিষয়ে কিছু বলা যায়নি।
২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে বিসিসি ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্য হয়। পরবর্তী সময়ে এসেছে ইন্টারনেটে অন্য ভাষার টপ লেভেল ডোমেইন ডট বাংলা নামের বিষয়টি। এখানেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব ছিল না।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন আইসিএএনএনের সদস্য হয়। ডাক, টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এক আলাপচারিতায় বলেন, ‘বাংলা ভাষা নিয়ে ইউনিকোডের বর্তমান ছক একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। হিন্দিতে যা-ই থাকুক, বাংলায় তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না থাকায় ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেই ইউনিকোডের বাংলা তৈরি করা হয়েছে। বিষয়টি সমাধানে সরকার একাধিক কমিটি গঠন করেছে। বিসিসি ও বিটিআরসি আইসিএএনএন ও ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সভাগুলোতে ইউনিকোডের বাংলায় বাংলাদেশের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরছে।’
কম্পিউটার, স্মার্টফোন থেকে শুরু করে একেবারে সরল বাটন ফোন, সবখানেই আপনি দিব্যি বাংলায় লিখে ফেলতে পারছেন যখনতখন, খুব সহজে। বাংলায় টাইপ করার ব্যাপারটি যত সহজ দেখছি আমরা আজকের দিনে, দেড় যুগ আগেও বিষয়টা অতটা সহজ ছিল না। আর অর্ধশতাব্দী আগে বাংলায় টাইপ ব্যাপারটিই ঠিকমতো ছিল না। অবাক করা হলেও ঘটনাটি এমনই।
এখনও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো বিজয় সফটওয়্যার ও অনলাইনের জন্য ইউনিকোড। কিন্তু যুক্তাক্ষর লেখার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হচ্ছে; পাঠক বা লেখককে সমস্যা ও লজ্জায় পড়তে হয়। যেমন অনেক সংযুক্ত অক্ষর লেখা যায় না এমনকি লেখার পর ভেঙে যায়।
অনেক সময় হয়তো পাঠক ভাবতে পারেন সংশ্লিষ্ট লেখক সঠিক বানানটি সম্পর্কে অবগত নন। বিষয়টি আসলে তা নয়, এটি সফটওয়্যারের সমস্যা। এই সমস্ত সমস্যা কীভাবে দূর করা যায় সেগুলো নিয়ে ইউনিকোড ও বিজয় সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছেন তাদের এই সীমাবদ্ধতা দূর করার বিষয়ে নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক