সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি


হীরেন পণ্ডিত

মহানগরীতে জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে শুধু সরকার কিংবা স্থানীয় প্রতিনিধিকে দোষারাপ করা ঠিক নয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে এসেছিল ‘বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে ঢাকা’! দেশের রাজধানী হওয়ায় কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে ও নানা কারণে প্রায় দেড় কোটি মানুষ ঢাকায় অবস্থান করে। আয়তন অনুযায়ী লোকসংখ্যা অধিক হওয়ায় অল্পতেই অধিক সমস্যা দেখা দেয়। যত দিন যাচ্ছে জনসংখ্যা বাড়ছে, ছোট হয়ে আসছে খাল-বিল আর নদীগুলো। ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুরবস্থার কারণে বৃষ্টিতে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোও পানিতে তলিয়ে যায়।

সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ার কারণে জনগণের ভোগান্তি ঢাকাবাসীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি এক সমস্যা। একটানা ৩-৪ ঘণ্টা বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় নগরীর নিম্নাঞ্চল। এমনিতেই খানাখন্দে ভরা, খোঁড়াখুঁড়ি, বিভিন্ন সব উন্নয়নের প্রকল্পের কাজ সব মিলিয়ে রাস্তা হয়ে যায় বেহাল, এর মধ্যে অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে কোথাও কোথাও হাঁটু পানি; কোথাও নোংরা কাদায় নগরীতে সৃষ্টি হয় এক চরম ভোগান্তি। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে এবছরই সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে পাওয়া তথ্য এমন- স্বাভাবিকের তুলনায় ২০২১ সালের সালের জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে বেশি বৃষ্টি হতে পারে। রাজধানীর মৌচাক, মগবাজার, শান্তিনগর, মালিবাগ, রামপুরা, রাজারবাগ, মতিঝিল, ধানমন্ডি, এয়ারপোর্ট রোড, মিরপুরসহ প্রায় ঢাকার প্রতিটি এলাকাতেই সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার শুরু হয় সেটা ১০ মিলিমিটার বা ৮০ মিলিমিটার হোক না কেন। এ ছাড়া রাজধানীর পুরানো ঢাকার অধিকাংশ এলাকা পোস্তাগোলা, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, বাসাবো, গোড়ান, মেরাদিয়া, রামপুরা, মালিবাগ, শান্তিনগর, গুলবাগ, রাজারবাগ, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, জিগাতলা, আগারগাঁও, বৌবাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন নিমাঞ্চলে পানি উঠে গিয়ে চলাচল ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

রাজধানীজুড়ে শুরু হয় যানজট ও জলাবদ্ধতা। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে বলে অভিযোগ রয়েছে এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের। প্রায়শ এ রাস্তায় রিকশা, সিএনজিসহ যানবাহন উল্টে পড়ে।

মহানগরীতে জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে শুধু সরকার কিংবা স্থানীয় প্রতিনিধিকে দোষারাপ করা ঠিক নয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে এসেছিল ‘বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে ঢাকা’! দেশের রাজধানী হওয়ায় কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে ও নানা কারণে প্রায় দেড় কোটি মানুষ ঢাকায় অবস্থান করে। আয়তন অনুযায়ী লোকসংখ্যা অধিক হওয়ায় অল্পতেই অধিক সমস্যা দেখা দেয়। যত দিন যাচ্ছে জনসংখ্যা বাড়ছে, ছোট হয়ে আসছে খাল-বিল আর নদীগুলো।

ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুরবস্থার কারণে বৃষ্টিতে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোও পানিতে তলিয়ে যায়। আর ভারী ও টানা বৃষ্টিতে এ সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ডাস্টবিন থাকা সত্ত্বেও ময়লা আবর্জনা ড্রেনে ফেলা হয়। ফলে পানি নিষ্কাশনে বাধার সৃষ্টি হয়। শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ ৩ হাজার টনের বেশি! যে ড্রেন দিয়ে পানি প্রবাহিত হয় সেই ড্রেনগুলো নিত্যদিনের বর্জ্য দিয়ে ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। অপ্রতুল ডাস্টবিন থাকায় মানুষ ড্রেন, রাস্তাঘাট, খাল-বিল কিংবা পুকুরকেই ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলছে! ফলে বন্ধ হয়ে পড়ছে পয়ঃনিষ্কাশনের পথ।

ঢাকা শহর নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মতো করে প্রকল্প তৈরি করে এবং তা পাসও হয়। সেগুলো নিজেদের মতো করে বাস্তবায়নও করে ফেলে। পুরো নগর ও পরিবহন পরিকল্পনার সঙ্গে তা মিলছে কি না বা একটি আরেকটির জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কি না, তা বিবেচনায় নেয়ার কেউ নেই। ঢাকা নগরের কোনো ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে কাজ করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, কোনোটি বাস্তবায়ন করছে রাজউক, কোনোটি সড়ক ও জনপথ। সত্যিই এক অদ্ভুত পরিস্থিতি!

বলা হয় যেকোনো সমস্যা সমাধানের অর্ধেক পথ এগোনো যায়, যদি সমস্যাগুলো কী তা জানা যায়। ঢাকার সমস্যাগুলো চিহ্নিত। বিভিন্ন সমীক্ষায় সমাধানের পথ দেখানো আছে। দরকার সুপারিশগুলোর সমন্বয় করে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা হাতে নেয়া এবং তা ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা নগরের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কোনো সমন্বয় কি আছে? ঢাকার পাশের ৪টি নদীর দখল-দূষণ মাত্রা ছাড়িয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গার পাড় ও নিকটবর্তী প্রায় দুই হাজার, শীতলক্ষ্যায় সাড়ে ৭০০ এবং তুরাগ ও বালু নদের এলাকার ছয় লক্ষাধিক কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি যাচ্ছে এ সব নদীতে। এ নদীগুলোই যে সভ্যতার প্রাণ!

২০১৯ সালের তালিকা অনুসারে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা। বসবাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ওই বছর ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৮তম। এখন বিশ্বে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় অযোগ্য শহর হিসেবে চতুর্থ অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী।

বসবাসযোগ্যতা ও নাগরিক সুবিধাগত দিক থেকে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর অবস্থান বিষয়ক জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) তাদের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নতুন কোনো সমস্যা নয়। একসময় ঢাকায় জালের মতো ছড়িয়ে ছিল আঁকাবাঁকা খাল-বিল-ঝিল। বৃষ্টি হলেই খাল-বিল-ঝিল হয়ে পানি নদীতে পড়ত। পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা ধুয়েমুছে পরিষ্কার হতো শহর।

ঢাকা ওয়াসার ২০১০-এর এক জরিপে প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে জলাবদ্ধতার নেপথ্যের কারণ। বেদখল হওয়া খাল অবৈধভাবে গত তিন থেকে চার দশক দখল করে। রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্স সেন্টারের ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী ঢাকায় ৭৩টি খাল আছে। ২০১৬ সালে করা ঢাকা জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ বলছে, খালের সংখ্যা ৫৮টি।

জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, উল্লিখিত খালের ৩৭টিতেই দখল হয়ে আছে। দখল ও দূষণের কারণে খাল স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে, কোনো কোনোটি পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে। আগে খাল রক্ষণাবেক্ষণে ঢাকা ওয়াসার জন্য নিজস্ব বরাদ্দ ছিল না। সংস্কারের জন্য স্থানীয় সরকার থেকে ৪০ থেকে ৬০ কোটি টাকা পেত। তাছাড়া প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালে ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ প্রকল্প গৃহীত হলেও এর অগ্রগতি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। বাস্তবতার নিরিখে সময় উপযোগী পদক্ষেপে দেশের নগরবিদরা দু’টি সিটি করপোরেশনের খাল উদ্ধারের দায়িত্ব প্রাপ্তির কার্যক্রমকে স্বাগত জানিয়েছে। দায়িত্ব পাওয়ার পর খাল ও নালার রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের কাছে ২৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। অতীতে ভারী ও মাঝারি বৃষ্টির পর রাজপথ ডুবে চলাচলে অযোগ্য হয়ে পড়া, এ নিয়ে লেখালেখি ও আলোচনা-সমালোচনা অনেক হয়েছে।

এক্ষেত্রে ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের পারস্পরিক দোষারোপ ও সমন্বয়হীনতার কথা অনেক শোনা গেছে। অবশেষে যখন রাজধানীর খাল পুনরুদ্ধার ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তখন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা ওয়াসার মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয়, সমঝোতা ও সহযোগিতা নিশ্চিত করতে এই সমঝোতা স্বাক্ষরিত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক।

সামান্য বৃষ্টির পানি নিতে পারে না ঢাকা সিটি, কোথাও হাঁটু কোথাও কোমরসমান পানি হয়। জনগণকে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়। বনানী, মিরপুর, এয়ারপোর্ট রোডেও পানি জমে। উত্তরের মেয়রের ভাষ্য অনুযায়ী, এ পানি ছয়টি রিটেনশন পন্ডে (পানি জমা হওয়ার জায়গা) জমা হওয়ার কথা। কিন্তু তা নেই, দখল হয়ে গেছে, যেমন কল্যাণপুর রিটেনশন পন্ডের ১৭১ একর জায়গার মধ্যে দখল হয়ে গেছে ১৭০ একর। কিন্তু প্রভাবশালীদের দখলদারিত্বের কারণে তা দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

তাহলে জলাবদ্ধতা নিরসন কীভাবে হবে? শুধু খাল ও নালা পরিষ্কার করলে হবে না, সঙ্গে সঙ্গে খালগুলো দখলমুক্ত করে সংযোগ নিশ্চিত করে ঢাকা চার পাশের নদীর (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) সঙ্গে পানির প্রবাহ যুক্ত করতে হবে। সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী পদ্মা সেতুর রেলপথ-মেট্রোরেলের কাজের কারণে কয়েকটি খালের পানিপ্রবাহের সংযোগ বন্ধ হয়ে আছে। এ সমস্যারও উপায় বের করতে হবে। তাহলে খালের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের কার্যক্রমের অগ্রগতি হবে।

তাছাড়া খালগুলোর বেহাল থেকে মুক্ত করতে হলে সিএস রেকর্ড মোতাবেক কাজ করতে হবে। অবৈধ স্থাপনায় পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ রয়েছে সেসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। নালা ও খালপাড়ে যাদের বাসাবাড়ি আছে, খালে পয়ঃনিষ্কাশনের প্রবাহ বন্ধ এবং বর্জ্য ফেলতে না পারে তা নজরদারিতে আনতে হবে। খালে স্বচ্ছ পানিপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে। বসবাসযোগ্যের জন্য খাল উদ্ধারে সিটি করপোরেশন আরও সোচ্চার হতে হবে। সবার এখন মনে রাখা দরকার, ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ কোনো সহজসাধ্য ও স্বল্পদিনের কাজ নয়। এর জন্য দরকার বাস্তব পরিকল্পনা, সঠিক সমন্বয় ও পরিকল্পিত কার্যকর ব্যবস্থা।

লেখক: প্রাবন্ধিক

4 thoughts on “সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি

  1. I was extremely pleased to uncover this great site. I wanted to thank you for your time just for this fantastic read!! I definitely liked every bit of it and i also have you bookmarked to see new things on your site.

  2. Good post. I learn something totally new and challenging on websites I stumbleupon on a daily basis. Its always exciting to read content from other writers and use something from other sites.

  3. I would like to thank you for the efforts youve put in writing this blog. I am hoping to see the same high-grade content by you later on as well. In fact, your creative writing abilities has motivated me to get my own website now 😉

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *