চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও অর্থনৈতিক মুক্তি


হীরেন পণ্ডিত
কাউকে পেছনে ফেলে না রেখে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নে অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একাধিক মেগাপ্রকল্প উদ্বোধন করা হবে ২০২২ সালে। দ্রুতগতিতে চলছে প্রবৃদ্ধি সঞ্চালক পদ্মা বহুমুখী সেতুসহ ১০ মেগাপ্রকল্প ও ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজ। ভবিষ্যতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখার ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রে এই ১০ মেগাপ্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এরই মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন এবং সহজেই নাগরিকসেবা প্রাপ্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবস্থাপনা, কর্মপদ্ধতি, শিল্প-বাণিজ্য ও উৎপাদন, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালনা করার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কাছে প্রযুক্তি যেমন সহজলভ্য হয়েছে, তেমনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে প্রযুক্তিনির্ভর সেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সব নাগরিকসেবা ও জীবনযাপন পদ্ধতিতে প্রযুক্তি হয়ে উঠেছে এক বিশ্বস্ত মাধ্যম।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরে জাতিসংঘের ই-গভর্ন্যান্স উন্নয়ন সূচকে সেরা ৫০টি দেশের তালিকায় থাকার চেষ্টা করছে। এক দেশ এক রেট কর্মসূচির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেটের আওতায় আনা হয়েছে পাঁচ হাজার ইউনিয়ন। ফাইভজি চালু হয়েছে, তবে বাণিজ্যিকভাবে কাজ করবে আরো কিছুদিন পর। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় তরুণরা গড়ে তুলছে ছোট-বড় আইটি ফার্ম, ই-কমার্স সাইট, অ্যাপভিত্তিক সেবাসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটসহ কয়েকটি বড় প্রাপ্তি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে পারলেই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা সঠিকভাবে এগোতে পারব। তাহলেই সম্ভব হবে অতিরিক্ত কর্মক্ষম জনমানবকে কাজে লাগানো, আর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্ব। সব কিছু যেন হাতের মুঠোয়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে পদার্পণ করেছি আমরা। বদলে যাচ্ছে আমাদের চিরচেনা সব কিছুই—সামাজিকতা, অফিস কাঠামো, কৃষি, জীবনযাপন থেকে শুরু করে সবই। কম্পিউটার সিস্টেমে কমান্ড দিয়েই মানুষ সব কিছু করছে। আমাদের পুরনো বিশ্বব্যবস্থায় বা ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় শ্রমবাজারের চিন্তা করা হতো তার পরিবর্তন হবে। পরে কয়েক শ মানুষের কাজ হয়তো একটি রোবট করে ফেলবে। কভিডকালে দীর্ঘ সময়ের মিটিং বা সভার আয়োজন—তা আজ আর হচ্ছে না। আমরা জুমে বা বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে আমাদের আলোচনা করে ফেলছি। সময়, শারীরিক উপস্থিতি, বিশাল আয়োজন—এসবের প্রয়োজন নেই।

একটি প্রযুক্তি বিপ্লবের সঙ্গে আমরা সময় অতিবাহিত করছি। পরিবর্তন সব সময় অবশ্যম্ভাবী। এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমরা শুরু করেছি। সব কিছুতেই আসছে আমূল পরিবর্তন। ঘরে বসেই বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালনা করছি আমরা। অনলাইনে অ্যামাজন, আলিবাবা বা রকমারিতে যে পরিমাণ অর্ডার করা হয়, তা দেখে আমরা আন্দাজ করতে পারছি ভবিষ্যতে কী হবে। ঘরে বসে অনলাইন বাজারে আমরা পেয়ে যাচ্ছি সব। যেকোনো সেবাও আমরা ক্রয় করতে চাইলে অনলাইন প্ল্যাটফরমে সব পেয়ে যাচ্ছি। প্রথম প্রথম হয়তো কিছুটা মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে বা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পড়ছি; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। আজকের চিকিৎসা বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রযুক্তির যে ছোঁয়া সবখানে লেগেছে, তাতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গেই আমরা দিনাতিপাত করছি।

ধারণা করা হচ্ছে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগাম ফসল হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ১০ শতাংশ মানুষের পরিধেয় বস্ত্র ও ১০ শতাংশ মানুষের চশমার সঙ্গে ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকবে। মানুষের শরীরে স্থাপনযোগ্য মোবাইল ফোন ও ৯০ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করবে। আমেরিকায় ১০ শতাংশ গাড়ি হবে চালকবিহীন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় হবে ৩০ শতাংশ করপোরেট অডিট। এমনকি কম্পানির বোর্ড পরিচালক হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট। আমেরিকায় এসে যাবে রোবট ফার্মাসিস্ট। এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি, সমাজ, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদির ওপর বিশাল প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন প্রযুক্তিবোদ্ধারা।

ইন্টারনেট অব থিংস, গুগল হোম, অ্যামাজন আলেক্সার কথা শুনেছি, যা আপনার ঘরের বাতি, সাউন্ড সিস্টেম, দরজাসহ অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। আপনার স্মার্ট ফ্রিজ নিজেই ভেতরে কী আছে তা জেনে আপনাকে জানাবে বা নিজেই সরাসরি অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কিনে ফেলতে পারবে। ক্লাউড কম্পিউটিং মানে আপনার কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের ওপর আর চাপ থাকছে না। যেকোনো স্টোরেজ, সফটওয়্যার ও যাবতীয় অপারেটিং সিস্টেমের কাজ চলে যাচ্ছে হার্ডডিস্কের বাইরে। শুধু ইন্টারনেট থাকলেই ক্লাউড সার্ভারে কানেক্ট হয়েই সব সুবিধা নেওয়া যাবে। কম্পিউটিংয়ের সফটওয়্যারগুলো আপনার আপডেট করার প্রয়োজন হবে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট হতে থাকবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে কম্পিউটার সায়েন্সের উত্কৃষ্টতম উদাহরণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যে চারটি কাজ মূলত করে তা হলো—কথা শুনে চিনতে পারা, নতুন জিনিস শেখা, পরিকল্পনা করা এবং সমস্যার সমাধান করা। ভবিষ্যতে মানুষেরই আয়ের পরিমাণ ও জীবনমান বাড়বে। সব কিছু সহজ থেকে সহজতর হবে এবং মানুষ তার জীবনকে বেশি মাত্রায় উপভোগ করবে। এ ছাড়া পণ্যসেবা উৎপাদন ও বিনিময় প্রক্রিয়ায়ও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ অনেক কমে আসবে।

বাংলাদেশ তথ্য-প্রযুক্তিতে অনেক ভালো করেছে। ভবিষ্যতের প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতেও শুরু করেছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে সমানভাবেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও ই-গভর্ন্যান্স, সার্ভিস ডেলিভারি, পাবলিক পলিসি অ্যান্ড ইমপ্লিমেনটেশন, তথ্য-প্রযুক্তি, বিকেন্দ্রীকরণ, নগর উন্নয়ন এবং এসডিজি বাস্তবায়ন নীতি ও কৌশল নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ হয়েছে এবং বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েও গেছে।

বাংলাদেশ এখন সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে সংযুক্ত। সারা দেশ কানেক্টিভিটির আওতায় এসেছে। আকাশে স্যাটেলাইট উড়িয়েছে। দ্বিতীয়টির প্রস্তুতি চলছে। ৩৯ অত্যাধুনিক হাইটেক পার্ক নির্মাণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের বিশ্বকে বাংলাদেশ জানান দিয়েছে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্বে রয়েছে বাংলাদেশও। আমাদের হাই-টেক পার্কগুলো হচ্ছে ভবিষ্যতের সিলিকন ভ্যালি। প্রযুক্তিনির্ভর এসব হাই-টেক পার্ক প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পায়ন, তরুণদের কর্মসংস্থান এবং হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার শিল্পের উত্তরণ ও বিকাশে সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে ৬৪ জেলায় সব ইউনিয়ন পরিষদ ডিজিটাল নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের প্রধান সেবাগুলো, বিশেষ করে ভূমি নামজারি, জন্ম নিবন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বা চাকরিতে আবেদন ইত্যাদি ডিজিটাল পদ্ধতিতে হচ্ছে। ১০০টি বিশেষায়িত রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশকে টেকসই করতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্য-প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও উচ্চতর প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষাদান, গবেষণা ও জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম অনেক মেধাবী। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় আমাদের পরিকল্পিত প্রস্তুতি নিয়ে এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং শিক্ষকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ করা। তাই পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। আমাদের প্রায় আট কোটি ১৫-৩৫ বছরের যুবকই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বিশাল সম্পদ। বাংলাদেশের মতো এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ও ডিজিটাল বিপ্লবের ফল একসঙ্গে কাজে লাগানোর সুযোগ খুব কম দেশেরই রয়েছে। ২০২৫ সালের পর দেশে আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব মোকাবেলা করতে আমাদের তরুণরাই সক্ষম হবে। দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে উঠছে আমাদের নতুন প্রজন্ম।

বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে বেরিয়ে গেলে বর্তমান শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা শুধু ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইইউ বাজারে পাওয়া যাবে। এ কারণে আগামী পাঁচ বছরের প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিবিদরা এসডিজি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং টেকসই ট্রানজিটের জন্য পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে শক্তিশালী ট্রানজিট কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ দিচ্ছেন। আগামী দিনে অগ্রগতির জন্য স্থানীয় বাজার ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, দুর্নীতি হ্রাস, মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন ৪৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন অর্থনৈতিক মুক্তি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *