বরফে ঢাকা সিকিমের সাঙ্গুলেক




হীরেন পণ্ডিত : বিশ্ব ভ্রমণে বের হওয়ার আগে ভারত ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লেই নাকি সব দেখা যায়। কাশ্মীর গেলে ভূস্বর্গ দেখা যায়। আবার রাজস্থান গেলে মরুভূমি, আর আসামের চেরাপুঞ্জি গেলে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। তাই অনেকে বলেন বিশ্ব ভ্রমণে আগে ভারত ঘুরে দেখতে। বিজ্ঞজনেরাও বলে ভারত দেখলে নাকি পৃথিবীর অনেক দেখা হয়ে যায়। ভারতে, হিমবাহ থেকে শুরু করে মরুভূমি সব আছে। পর্বতশৃঙ্গ থেকে অধিক বৃষ্টিপাতের অঞ্চল, সবই আছে। ভারত ভ্রমণে জন্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখান্ড, কেরালা ও সিকিমকে প্রথম সারিতে রাখে অনেকে।

ভ্রমণ করতে সবার ভালো লাগে। হয়তো ব্যস্ত জীবনের অজুহাতে তা হয়ে উঠে না। এর প্রেক্ষিতেই ঘুরতে বের হওয়া। প্রথমে কোলকাতা দেখা হলো, দ্বিতীয়ত শান্তিনিকেতন দেখা হলো। এবার কোথায় যাওয়া যায়, সবাই বলে দার্জিলিং, উত্তম প্রস্তাব, কেউ অমত করেন নি, বাসে শিড়িগুড়ি হয়ে দার্জিলিং। পাহাড়, সেভেন পয়েন্টস, মিরিক, টাইগার হিল সব তো দেখা হলো এখন কি করা যায়। হোটেল ম্যানেজার পরামর্শ দিলেন সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে চীনের সীমান্তের কাছে সাঙ্গুলেক এর বরফে ঢাকা লেক ও পাহাড় দেখতে পারেন। কি আর করা সবাই নিয়ে সিদ্ধান্ত হলো সাঙ্গুলেক দেখতে যাব।

ভারতের কয়েকটি প্রদেশ ভ্রমণ করা হলেও সিকিম যাওয়া হয়নি। যেখানে ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন অপরূপ। আবার সেই সঙ্গে ভারত, চীন, নেপাল, ভুটান এই চারটি দেশের মানুষ ও সংস্কৃতি মিলে মিশে একাকার। অনেক ছবিতে অপরূপ গ্যাংটক দেখে শুধু আনন্দ পেয়েছি। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দেথে ভালোই লেগেছে। একটি বিষয় আমাদেরও জানা ছিলোনা যে ভারতের এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে গেলে সেই প্রদেশের সীমান্তে বিদেশীদের পাসপোর্টকে তাদের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) গার্ডের খাতায় তালিকাভুক্ত করে নতুন প্রদেশে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু দার্জিলিংয়ের জীপওয়ালা আমাদের সেই তথ্য না দিয়ে প্রবেশ করিয়েছে ভেবেছে, আমরা যেহেতু দার্জিলিং থেকে হয়েছি তাহলে আমরা হয়তো পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। কিন্তু গ্যাংটকে হোটেল ম্যানেজার যখন এসে বললো আমরা সিকিম সীমান্তে পাসপোর্ট এন্টি করিয়েছি কিনা। না উত্তর দিতেই কিছুটা কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তাহলে এখন উপায় সিকিম পুলিশ বা আর্মি হোটেলে আসলে আমরা যেন বলি আমরা দার্জিলিং থেকে এসেছি জীপওয়ালা সেই ভুলটা করেছে। প্রায় সিকিমে থাকার কয়েকদিন এক অজানা আশঙ্কায় কেটেছে আমাদের সকলের এই কারণে। পরে অবশ্য ফিরে আসার দিনের জীপওয়ালাকে হোটেল ম্যানেজার বলে দেয় আমরা যেন কোনো ঝামেলায় না পড়ি।

পরদিন হোটেল ম্যানেজার একটি জীপ ঠিক করে দিলেন আমাদের সাঙ্গু লেক দেখিয়ে নিয়ে আসার জন্য। সেদিন খুব সকালই আমাদের জীপ আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। আমাদের আজকের গন্তব্য পূর্ব সিকিমের পর্যটন কেন্দ্র সাঙ্গুলেক। দূরত্ব গ্যাংটক থেকে ৩৫ কিলোমিটার। সময়ের হিসেবে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথে প্রায় দুই ঘণ্টা। সিকিম হাউস তাশিভিউ পয়েন্টসহ গ্যাংটক শহরের চড়াই উৎরাই পার করে এগিয়ে চললাম। রাস্তায় অনেক চেক পোস্ট চীনের সীমান্ত এলাকার কাছে বলেই মনে হয় এতো কড়াকড়ি। সেদিন রাস্তায় এক আর্মি চেক পোস্টে কোনে এক অনুষ্ঠানের কারণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা মিষ্টি বিতরণ করছেন। আমরাও সবাই জীপ থেকে নামলাম এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেয়া মিষ্টি খেলাম। পাশেই ঝর্না থেকে পানি পড়ছে আমি একটু কৌতূহলী হয়ে হাতে নিয়ে ঝর্নার পানি পান করলাম। ঝকঝকে টলটল করছে দু’হাতে পানি নিয়ে কিছুটা খেলাম ভালোই লাগলো বিশুদ্ধ পানি পাহাড় থেকে পড়ছে। ঝর্না মানে পাহাড়ের কান্না।

প্রথম দিকে সবুজের দেখা মিললেও কিছু দূরে গিয়ে প্রকৃতির রূপে বিবর্ণতার ছোঁয়া। চীন-ভারত সীমান্ত হওয়ায় একটু পর পর সেনা ছাউনি ভারতীয সেনাবাহিনীর সদস্যরা পাহাড়া দিচ্ছে।

যাত্রা পথের বিরতিতে। বিশাল আকাশকে মনে হচ্ছে। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবো। এখানে সুউচ্চ পাহাড়ের সঙ্গে হয়েছে আকাশের মিতালী। রোমাঞ্চকর এ পথ ভ্রমণ বাস্তবে যে কত সুন্দর তা না আসলে হয়তো বোঝাই যেত না। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে নেপালি ড্রাইভার উপরে উঠতে থাকল।

রাস্তার দুইপাশের বরফের স্তূপ বলে দিচ্ছে আমাদের গন্তব্য নিকটে। সাঙ্গুর কাছাকাছি পসরা সাজানো এক দোকানে দাঁড়ালো জীপগাড়িটি। জুতা ও জ্যাকেট ভাড়া করে উষ্ণ কফিতে চুমুক দিতে দিতেই চলে এলাম সাঙ্গুলেক। পর্যটন মৌসুম হওয়ায় লোকে লোকারণ্য।

দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি ইয়র্ক থেকে উঠে পড়লাম একটায়। ছবি তুলে ভিড় ঠেলে এবার ক্যাবল কারে চড়ার পালা। ১৪,৫০০ ফিট উপরে ওঠা ক্যাবল কার থেকে আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ ও সাঙ্গুর দৃশ্য ছিল অসাধারণ। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে এই লেক অতি পবিত্র। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লেকের পানির রঙ্গের আসে পরিবর্তন। আর শীতে তো লেকের পানি জমে বরফ হয়ে যায়।

বরফের পাহাড়ে উঠার জুতা, পাঞ্জা ভাড়া নিয়ে পরে সবাইকে নিয়ে বরফের পাহাড়ে উঠার চেষ্টা করলাম দুই হাত উপরে উঠি আর তিন হাত নিচে নেমে যাই পা পিছলে অভিজ্ঞতা না থাকলে যা হয় অবশেষে অন্য বন্ধুর হাত ধরে উঠলাম ২০০ ফুটের মত। আমার ব্যাগ যার মধ্যে সবার টাকা পয়সা কি আর করা ব্যাগ নিয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ থেকে সবাই নেমে আসা দু’ধরনের বরফের দেখা পেলাম একটা লবণ বা চিনির দানার মত আর একটা শক্তবড় বড়। আর মনে পড়ে তখন বৈশাখ মাসে শিলাবৃষ্টির শিলার টুকরা কুড়ানোর বিষয়ে। যাক এখানের আবহাওয়া দুপুর গড়িয়ে খারাপ হতে থাকে। কফি, নুডুলস মোমো ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায় না তবে প্রায় সবখানেই হার্ড ও সফট ড্রিংকসের ব্যবস্থা আছে দোকানগুলোতে এটা গ্যাংটক শহরেও দেখতে পেয়েছি যেটা কোলকাতা বা দার্জিলিং পাওয়া যায়নি। কিছুক্ষণ পর আমরাও ফিরতি পথ ধরলাম গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে সেই ভাড়া করা জীপ দিয়ে।

বলে রাখা দরকার- সিকিম একটি উচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টিত ভারতীয় রাজ্য। রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি ছাড়াও আরও কিছু অঞ্চলে প্রবেশের জন্য আলাদা অনুমতি নিতে হয়। আরও কিছু অঞ্চল আছে যেগুলোর অনুমতি পাওয়া যায় না। এম জি মার্গের সিকিম ট্যুরিজম অ্যান্ড সিভিল এভিয়েশন অথবা সিকিম সরকার নিবন্ধিত ভ্রমণ এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করতে হয়।

সিকিম ভারতের প্রথম রাসায়নিক মুক্ত বা অর্গানিক রাজ্য। পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে সিকিম সরকার উত্তর সিকিমের লাচুং ও লাচেন গ্রামে নিষিদ্ধ করেছে প্লাস্টিকের জলের বোতল। নির্দেশ অমান্যকারীকে গুনতে হয় মোটা অংকের জরিমানা।

সাঙ্গুলেক এ অক্সিজেনের কোন সমস্যা নেই। সেখানে পর্যাপ্ত বাতাস পাবেন গাছপালা আছে এজন্য নিঃশ্বাস নিতে কোন সমস্যা হবেনা। ক্যাবল কারে চলতেই হলে আপনাকে ৩৮০ ভারতীয় রুপি গুণতে হবে। ক্যাবল কারে আপনি যে দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন সেটি হচ্ছে সিকিমের সিটি টা সম্পূর্ণ দেখা যায় এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় যা সবার পরিচিত একটি নাম কাঞ্চনজঙ্ঘা এটি খুব কাছ থেকে দেখা যায়। প্রায় ৪০ মিনিটের মধ্যে আপনি ফিরে আসতে পারবেন। সাঙ্গুলেক যেতে অনেক ছোট ছোট পাহাড়ের ঝর্না দেখতে পাবেন। সেই সাথে একটা মজার জিনিস উপলব্ধি করবেন, সিকিমে মূলত ছেলে অথবা পুরুষ মানুষ অলস প্রকৃতির হয় এবং সবচেয়ে কর্মঠ হয় নারীরা।

8 thoughts on “বরফে ঢাকা সিকিমের সাঙ্গুলেক

  1. Nice post. I learn something totally new and challenging on blogs I stumbleupon every day. It will always be interesting to read through content from other writers and use a little something from their web sites.

  2. This is the perfect webpage for everyone who wants to understand this topic. You understand so much its almost hard to argue with you (not that I personally will need toÖHaHa). You certainly put a new spin on a subject that has been discussed for a long time. Great stuff, just wonderful!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *